রাশিয়ার আক্রমণের মুখে আরেকটি শীতের প্রস্তুতি নিচ্ছে কিয়েভ
ঢাকা, ২২ নভেম্বর, ২০২৫ (বাসস) : যুদ্ধকালীন কিয়েভে সূর্যাস্তের পর এখন অন্ধকার রাস্তায় কেবল যেন ছায়ামূর্তিরা চলাচল করে আর মাঝেমধ্যে কুকুরের আলো-ঝলমলে গলাবন্ধ থেকে কিছুটা আলো জ্বলে ওঠে।
যুদ্ধ শুরুর পর থেকে এবারই সম্ভবত ইউক্রেন সবচেয়ে কঠিন শীতের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।
খবর বার্তা সংস্থা এএফপি’র।
রাশিয়ার ২০২২ সালে আগ্রাসন শুরুর পর থেকেই ইউক্রেনের জ্বালানি অবকাঠামোর ওপর দেশটি লাগাতার আঘাত হেনে আসছে। কিন্তু এ বছর আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় রেকর্ডসংখ্যক ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালাচ্ছে রাশিয়া।
সূর্যাস্তের পর যুদ্ধকালীন কিয়েভ মানে এখন অন্ধকার রাস্তা আর ক্ষণস্থায়ী সিলুয়েট, মাঝে মাঝে ম্লান আভা থেকে আলো।
শান্তির বিনিময়ে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করার জন্য মার্কিন পরিকল্পনা উপস্থাপনের ফলে ইউক্রেন যখন বিচলিত হচ্ছে, ঠিক তখনই যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত ইউক্রেনের রাজধানীর বাসিন্দারা সবচেয়ে কঠিন শীতের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।
রাশিয়া ২০২২ সালে আক্রমণের পর থেকে ইউক্রেনের জ্বালানি অবকাঠামোতে নিরলসভাবে আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে।
যাদের পূর্ববর্তী বছরগুলোতে কৌশল ছিল সহ্য করা, তারা অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করছে।
দিমিত্রো কুস্তভের নৃত্য স্টুডিওর আলো রাস্তায়ও পড়ছিল। ভেতরে ছিল উষ্ণতা এবং বৈদ্যুতিক স্পিকার থেকে পপ সঙ্গীত ভেসে আসছিল।
স্টুডিওটির মালিক দিমিত্রো কুস্তভ এএফপিকে বলেন, ‘শেষ ব্ল্যাকআউট শুরু হওয়ার সাথে সাথেই আমি ফোন করে সিদ্ধান্ত নিলাম যে এই সব কিছু ঠিক করে নেওয়া দরকার।’
তিনি আরো বলেন, এটি ছাড়া, বিদ্যুৎ প্রতিদিন দুবার চার ঘন্টার জন্য বন্ধ হয়ে যেত।
২৯ বছর বয়সী কুস্তভ বলেন, ‘মানুষের জন্য এখন উষ্ণ থাকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, মানুষের জন্য কিছু আশা থাকাও গুরুত্বপূর্ণ।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমার এখানে সর্বদা আলোর প্রয়োজন, যাতে মানুষ আসতে পারে, প্রশিক্ষণ নিতে পারে ও যোগাযোগ করতে পারে। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং এর মাধ্যমেই তারা এই সমস্ত আবেগ প্রকাশ করতে পারে।’
রাশিয়ার ক্রমবর্ধমান হামলায় জর্জরিত ইউক্রেন দেশটির গ্যাস নেটওয়ার্কের ক্ষতির পরিমাণ প্রকাশ করেনি।
তবে স্থানীয় মিডিয়া অনুমান করেছে যে দেশটির উৎপাদন ক্ষমতার ৬০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে।
কিয়েভ বলেছে, এই শীতকাল কাটানোর জন্য তাদের কাছে পর্যাপ্ত জ্বালানির মজুদ রয়েছে। তবে ট্রান্সমিশন অবকাঠামো নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে।
এছাড়াও এমন আশঙ্কাও করা হচ্ছে যে নতুন আক্রমণের ফলে ইউক্রেনের রাজধানীতে হিমাঙ্কের তাপমাত্রার সময় ব্যাপক তাপীকরণ বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
কিয়েভে প্রায় ৩৫ লাখ মানুষ বাস করে।
কুস্তভ স্বীকার করেন, ‘এই বিষয়টি একটু চাপের।’
কিন্তু তিনি আরও বলেন, ‘আমার মস্তিষ্ক সম্ভবত এর সঙ্গে এতটাই খাপ খাইয়ে নিয়েছে যে দুর্ভাগ্যবশত, বিদ্যুৎ বিভ্রাট কেবল দৈনন্দিন জীবন হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা এতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি।’
তার ব্যাটারি হয়তো আলো জ্বালাতে পারে। কিন্তু যদি ঘন্টার পর ঘন্টা গরম করার যন্ত্র বন্ধ থাকে, তাহলে তার কাছে আর কোন সমাধান নেই।
তিনি আরো বলেন, ‘আমরা অপেক্ষা করব।’
রাতভর বেশ কয়েকটি রাশিয়ান ড্রোন এবং ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা হয়েছে।
এই হামলা সম্পর্কে বিমান বাহিনীর একটি প্রতিবেদন এবং জাতীয় জ্বালানি সরবরাহকারী ইউক্রেনারগোর একটি বার্তা রয়েছে।
রাশিয়ার হামলার এ ধরনের খবর ইউক্রেনের নাগরিকদের জন্য নিয়মিত ঘটনা। প্রতিদিনই প্রায় একই ধরণের খবর প্রচার হয়।
খবরে আরো বলা হয়, ‘রাশিয়ান আক্রমণের ফলে, ইউক্রেনের বেশ কয়েকটি অঞ্চলে বিদ্যুৎ বিভ্রাট আরোপ করা হবে।’
খবরগুলোতে কখনও কখনও, ‘বেশিরভাগ অঞ্চল’ জুড়ে বিদ্যুৎ বিভ্রাট। মাঝে মাঝে, ‘সমস্ত অঞ্চলে’ বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কথাও জানানো হয়।
কিয়েভের বিভিন্ন অঞ্চল পর্যায়ক্রমিক ব্ল্যাকআউটের সময়সূচিতে রয়েছে।
৬৬ বছর বয়সী ভলোদিমির ও তার স্ত্রী ৬৪ বছর বয়সী তেতিয়ানা রাতে ঘুম থেকে উঠে গোসল করেন, কাপড় ধৌত এবং ব্যাটারি রিচার্জ করেন।
রাজধানীর নিজের ছোট্ট বাড়িতে বাস করা ভলোদিমির এএফপিকে বলেন, ‘আমি আমাদের পূর্বপুরুষদের ব্যবহৃত জিনিসে ফিরে এসেছি -- কেরোসিনের বাতি।’
ধীরে ধীরে বৈদ্যুতিক চাহিদা মেটাতে তারা ব্যাটারি, জেনারেটর, রিচার্জেবল লাইটবাল্ব ও গ্যাস ক্যানিস্টার ‘মজুদ’ করছেন।
ভলোদিমিরের বারান্দায় একটি ধুলোময় গ্যাসের চুলা সেই দিনের জন্য অপেক্ষা করছে, যখন তার সমস্ত ব্যাক-আপ পাওয়ার উৎস ফুরিয়ে যাবে।
তিনি বলেন, ‘যদি গ্যাস না থাকে, তাহলে জ্বালানি কাঠ দিয়ে চাহিদা মেটাতে হবে। এগুলো আমার কাছে আছে।’
কিন্তু তেতিয়ানা অতোটা নিশ্চিত নন।
তিনি বলেন, ‘আমার স্বামী বলছেন যে তিনি চিন্তিত নন, কিন্তু আমি চিন্তিত।’
তিনি তার ৮৫ বছর বয়সী খালার জন্য চিন্তিত, যিনি একা একটি অ্যাপার্টমেন্টে থাকেন এবং এত প্রস্তুতি নিতে পারেন না।
যুদ্ধের প্রথম পূর্ণ শীতকাল ২০২২ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বিদ্যুৎ গ্রিডে অকার্যকর থাকার কারণে বিদ্যুৎ বিভ্রাট দেখা দেয়। অনেক ইউক্রেনীয়র জন্য এই পরিস্থিতি বিশেষভাবে কঠিন ছিল।
তিনি বলেন, ‘মানুষ অনেক দিন ধরেই ভেবেছিল যে এই পরিস্থিতি নিজেই সমাধান হয়ে যাবে, এটা কেটে যাবে।’
"ঠিক যেমন আমরা ভেবেছিলাম যুদ্ধ শুরু হবে না।"
তিন বছর পর, সেই মানসিকতা পরিবর্তন হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে।
গৃহ উন্নয়ন হাইপারমার্কেট চেইন এপিসেন্টার, ৩ অক্টোবরের একটি বড় বিদ্যুৎ বিভ্রাটের পর জেনারেটর বিক্রি তিনগুণ এবং পাওয়ার ব্যাংক ও ক্যাম্পিং বার্নারের দাম আটগুণ বেড়ে যাওয়ার কথা জানিয়েছে।
এ সব খরচ ও সামর্থ অবশ্যই একটি বড় বাধা।
ভলোদিমির বলেন, ‘সবাই জেনারেটর বা হিটার কিনতে পারে না। সবার সেই সামর্থ নেই।’
কুস্তভ তার স্টুডিও ঠিক করার জন্য প্রায় ১ হাজার ১০০ ডলার খরচ করেছেন, যা গড় মাসিক বেতনের দ্বিগুণ।
মহড়া থেকে বিরতির সময়, নৃত্যশিল্পীদের লিফট বন্ধ থাকা অবস্থায় ২০ তলায় উঠতে হয়।
নৃত্যশিল্পীদের একজন বলেন, বোমা হামলা ‘ক্রমশ খারাপ হচ্ছে’ এবং এটা ‘অনেকটাই ২০২২ সালের অভিজ্ঞতা পুনরায় ফিরে আসার মতো অবস্থা।’