নীলফামারীর রাজিয়া : শূন্য থেকে দাঁড়িয়ে নয় দেশে পণ্য পাঠানো এক অনুপ্রেরণার গল্প
ঢাকা, ২ ডিসেম্বর, ২০২৫ (বাসস) : উত্তরের জেলা নীলফামারীর সৈয়দপুর শহরের নিয়ামতপুর মুন্সিপাড়ায় এক সাধারণ পরিবারে জন্ম নিয়েছিলেন রাজিয়া সুলতানা। সাধারণ হলেও তার স্বপ্ন ছিলো অসাধারণ। জীবনের কঠিন বাস্তবতা পেরিয়ে আজ তিনি হয়ে উঠেছেন এক অনুকরণীয় নারী উদ্যোক্তা, যার তৈরি পাট ও সুতার নান্দনিক পণ্য রপ্তানি হচ্ছে জাপান, সৌদি আরব, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ বিশ্বের নয়টি দেশে। অথচ তার উদ্যোক্তা হওয়ার পথচলা শুরু হয়েছিলো মাত্র পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে, অনেকটা নিরুপায় অবস্থায়।
রাজিয়া সুলতানা মাস্টার্স শেষ করার পর চাকরি করার প্রবল ইচ্ছে ছিলো। চাকরির জন্য আবেদন করেছেন অনেক জায়গায়। একের পর এক চেষ্টা চালিয়েছেন, কিন্তু কোনো চাকরি জুটছিলো না। ক্রমেই হতাশা বাড়ছিলো। পড়াশোনা শেষ করেও যখন ঘরে বসে থাকতে হচ্ছিলো-এটা তাকে মানসিকভাবে চাপে ফেলে দেয়। তবু তিনি ভেঙে পড়েননি। বরং মনের ভেতর জন্ম নেয় এক নতুন সংকল্প। চাকরি না হলে তিনি নিজেই কিছু করবেন। সেই তাগিদই তাকে এগিয়ে নেয় এক ভিন্ন পথে।
এক বান্ধবীর পরামর্শে রাজিয়া যুক্ত হন অনলাইনে নারীদের উদ্যোক্তা প্রশিক্ষণের একটি প্ল্যাটফর্মে। সেখানে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের সফল নারীদের গল্প তাকে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত করে। পাশাপাশি ইউটিউব ভিডিও দেখে পাট ও সুতার কারুশিল্প শেখা শুরু করেন। পরে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর এবং মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর থেকে অ্যাডভান্সড প্রশিক্ষণ নেন, যা তার দক্ষতাকে আরও শানিত করে। তবে সবকিছুর মাঝেই বড় সমস্যা ছিলো পুঁজি। প্রশিক্ষণ থাকলেও অর্থের অভাবে কাজ শুরু করতে পারছিলেন না। শেষ পর্যন্ত সন্তানের জন্য জমিয়ে রাখা মাত্র পাঁচ হাজার টাকা দিয়েই তিনি নিজের সাহসী সিদ্ধান্ত নেন ব্যবসা শুরু করার। ফেসবুকে ‘নান্দনিক ক্রাফট’ নামে খুলেন একটি পেজ। এখান থেকেই শুরু হয় তার উদ্যোক্তা জীবনের প্রথম পদক্ষেপ।
অনলাইনে সাড়া পেতে সময় লেগেছিলো। তবে উপজেলা প্রশাসনের আয়োজিত বিভিন্ন মেলায় অংশগ্রহণ তার কাজকে নতুনভাবে পরিচিত করে। সেখানে স্থানীয় ক্রেতাদের নজরে পড়ে তার পাট ও সুতার নান্দনিক পণ্য। ধীরে ধীরে অর্ডার বাড়তে থাকে, বিক্রিও বাড়ে। সাফল্যের পথে এগোতে এগোতেই রাজিয়া বাড়ির পাশেই ছোট একটি কারখানা গড়ে তোলেন। হাতে গোনা কয়েকজন শ্রমিক নিয়ে শুরু হওয়া সেই কারখানায় এখন কাজ করেন ১৫ জন নারী ও তিনজন পুরুষ। তাদের মাসিক বেতন ৮ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত। কারখানাটি আজ বহু নারীর জীবনে আশার আলো নিয়ে এসেছে।
কারখানায় কাজ করা নারীদের একজন রায়হানা আক্তার। স্বামী তাকে দুই সন্তান নিয়ে ফেলে চলে গেলে সংসার চালানোর দায়িত্ব একাই নিতে হয় তাকে। তখন জীবন হয়ে উঠেছিলো দুর্বিষহ। এমন সময়ে তিনি আশ্রয় খুঁজে পান নান্দনিক ক্রাফটে। চার বছর ধরে এখানে কাজ করছেন। রায়হানা জানান, এখন তিনি মাসে ১২ হাজার টাকা আয় করেন। এতে তিনি সন্তানদের পড়ালেখা চালাতে পারছেন, মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন, ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করিয়েছেন। একসময়ের অসহায় দিনশেষে তিনি এখন স্বাবলম্বী নারী। রাজিয়ার তৈরি এই কর্মপরিবেশ তার জীবনে নতুন আলো জ্বালিয়েছে।
একইভাবে নান্দনিক ক্রাফটে কাজ করছেন কলেজছাত্রী তানজিনা আক্তার। নিম্ন আয়ের পরিবারে বড় হওয়ায় পড়ালেখা চালানো কঠিন হয়ে পড়েছিলো তার জন্য। প্রতিবেশীর মাধ্যমে চাকরির সুযোগ পান রাজিয়ার কারখানায়। এখন তিনি প্রতি মাসে প্রায় ১৫ হাজার টাকা আয় করেন-যা দিয়ে নিজের শিক্ষা খরচ চালানো থেকে শুরু করে পরিবারকেও সহায়তা করতে পারেন। তাঁর কথায়, ‘এই কাজটি আমাকে শুধু আর্থিক সহায়তাই দেয়নি, আত্মবিশ্বাসও দিয়েছে। মনে হয় আমিও কিছু করতে পারি।’
অনটনে থাকা রাহেদা বেগমও জানান, বিয়ের পর সংসারের চাপে জীবন যুদ্ধ কঠিন হয়ে পড়েছিলো। নান্দনিক ক্রাফটে কাজ শুরু করার পর তাঁদের দুর্দশা অনেকটা কমেছে। তিনি বলেন, ‘আগে আমাদের সংসারে প্রতিনিয়ত অভাব ছিলো। এখন নিজের আয় দিয়ে পরিবারকে সাহায্য করতে পারছি। ভালোই আছি।’
এভাবে রাজিয়া শুধু নিজের জীবনই বদলাননি, বদলে দিয়েছেন বহু নারীর জীবনও। তিনি বলেন, ‘আমি যখন চাকরি না করে হতাশায় ভুগছিলাম, তখন যে কষ্ট পেয়েছি- বেকার নারীদের সেই কষ্ট আমি বুঝি। তাই যতোটা পারি তাদের পাশে থাকতে চাই।’
ছোট পরিসরে শুরু হওয়া নান্দনিক ক্রাফট এখন এক সফল উদ্যোক্তা ব্র্যান্ড। তার পাট ও সুতার তৈরি পণ্য দেশের বহু জেলায় জনপ্রিয়। পাশাপাশি বিদেশেও ব্যাপক সাড়া পেয়েছে। বর্তমানে জাপান, সৌদি আরব, কাতার, ওমান, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ মোট নয়টি দেশে রপ্তানি হয় রাজিয়ার পণ্য। প্রধানত প্রবাসী বাংলাদেশিদের মাধ্যমে। এখন তার মাসিক আয় প্রায় এক লাখ টাকা। দিন দিন বাড়ছে কাজের পরিধি, বাড়ছে অর্ডার।
রাজিয়া সুলতানার সাফল্য স্থানীয়ভাবে স্বীকৃতিও পেয়েছে। তিনি সৈয়দপুর উপজেলায় তিনবার ‘জয়িতা’ পুরস্কার পেয়েছেন সফল উদ্যোক্তা হিসেবে। তাকে দেখে অনুপ্রাণিত হচ্ছেন এলাকার অনেক তরুণী ও গৃহবধূ। কেউ কেউ নিয়মিত তার কাছে আসছেন শিখতে বা নিজের ব্যবসা শুরু করতে। রাজিয়াও তাঁদের সহায়তায় এগিয়ে এসেছেন। ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রায় শতাধিক পিছিয়ে পড়া নারীকে কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছেন তিনি।
স্থানীয় নারী সংগঠক শিউলী বেগম জানান, রাজিয়া সুলতানা এখন সৈয়দপুরে নারী উদ্যোক্তাদের আইকন। তার সৃজনশীলতা, কঠোর পরিশ্রম এবং সততা তাঁকে আলাদা করে তুলেছে। তিনি বলেন, ‘রাজিয়ার মতো নারীরা দেশের অর্থনীতিতে নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলছে। বিদেশে পণ্য রপ্তানি করে তিনি বাংলাদেশের ইতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি করছেন।’
সৈয়দপুর উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা নূরনাহার শাহজাদীও জানান, উপজেলা প্রশাসন এবং সরকারি দপ্তরগুলো নারীদের আত্মনির্ভরশীল করার জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি ও প্রশিক্ষণ পরিচালনা করছে। রাজিয়া সুলতানা সেই সুবিধা কাজে লাগিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এখন তিনিও অন্য নারীদের উৎসাহিত ও সহায়তা করছেন।
উদ্যোক্তা হিসেবে সাফল্যের পেছনে পরিবারের বিশেষ ভূমিকার কথা উল্লেখ করতে ভোলেন না রাজিয়া। তিনি জানান, স্বামী ও সন্তানরা শুরু থেকেই তাকে অনুপ্রেরণা ও সহযোগিতা দিয়েছেন। ‘ওরা পাশে না থাকলে আমি এতদূর আসতে পারতাম না,’ বলেন তিনি।
দীর্ঘ সংগ্রাম, অদম্য পরিশ্রম আর দৃঢ় মনোবল-এই তিনের সমন্বয়ে দরিদ্রতা, হতাশা আর ব্যর্থতাকে জয় করে নান্দনিক ক্রাফটকে দাঁড় করিয়েছেন রাজিয়া সুলতানা। পাঁচ হাজার টাকা থেকে শুরু হওয়া তার ক্ষুদ্র ব্যবসা আজ আন্তর্জাতিক বাজারে জায়গা করে নিয়েছে। শুধু ব্যবসায়িক সাফল্য নয়, সমাজের পিছিয়ে পড়া নারীদের কর্মসংস্থান ও আত্মনির্ভরতার অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছেন তিনি।
রাজিয়ার নিজের কথায়ই যেন তার জীবনের গল্পের সারসংক্ষেপ- ‘নারীরা চাইলে সবকিছু পারে। শুধু সাহস আর ধৈর্য থাকতে হয়। আমি চাই আমার মতো আরও অনেক নারী নিজের আলোয় আলোকিত হোক।’