সাংবাদিক কাঙাল হরিনাথের জীবন দর্শন সবকালে অনুসরণীয়
আব্দুর রাজ্জাক
কুষ্টিয়া, ৭ ডিসেম্বর ২০২৫ (বাসস) : গ্রামীণ সাংবাদিকতার প্রবাদ পুরুষ কাঙাল হরিনাথ মজুমদার। গ্রাম বাংলার সাধারণ মানুষের জীবন মানের উন্নয়ন এবং তাদের ওপর ইংরেজ ও তৎকালীন সমাজপতিদের শোষণ-পীড়নের বিরুদ্ধে তিনি সারা জীবন আন্দোলন করেছেন। অত্যাচারিত ও অসহায় কৃষকদের রক্ষার জন্য সাংবাদিকতা পেশা গ্রহণ করেছিলেন। এ অঞ্চলের গ্রামীণ শিক্ষা বিস্তারেও তিনি ছিলেন অগ্রপথিক।
সাংবাদিক কাঙাল হরিনাথ বাংলা ১২৪০ সালের (১৮৩৩ ইংরেজি) ৫ শ্রাবণ কুষ্টিয়া জেলার (তৎকালীন নদীয়া জেলা) কুমারখালী উপজেলার কুণ্ডুপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন।
কাঙাল হরিনাথ প্রথমে ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকায় লিখতেন। ১২৭০ বঙ্গাব্দে (১৮৬৩ ইংরেজি) তিনি নিজেই ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’ নামের একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। পত্রিকাটি পরে পাক্ষিক ও ১২৭৭ বঙ্গাব্দের বৈশাখ মাস থেকে এক পয়সা মূল্যের সাপ্তাহিকে রূপান্তরিত হয়। এতে সাহিত্য, দর্শন ও বিজ্ঞানবিষয়ক প্রবন্ধ প্রকাশিত হলেও কৃষকদের প্রতি তখন নীলকর ও জমিদারদের শোষণ-অত্যাচারের কথা বিশেষ গুরুত্বের সাথে প্রকাশ করা হতো।
বিশিষ্টজনদের মতে, গ্রামীণ সাংবাদিকতার প্রাণপুরুষ, ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম প্রবাদ পুরুষ কাঙাল হরিনাথ মজুমদার। সাংবাদিকতা পেশার নৈতিকতা ও দায়িত্ব বুঝতে হলে তাকে জানতে হবে। নতুন প্রজন্মকে কাঙাল হরিনাথের আদর্শ ও দর্শনের সাথে পরিচয় করাতে হবে। কাল থেকে কালান্তরে তাঁর আদর্শের বাণী মানুষের কাছে তুলে ধরতে তারা কাঙাল হরিনাথ স্মৃতি জাদুঘরে তাঁর সব কর্ম ও স্মৃতির নিদর্শন সংরক্ষণের আহ্বান জানান।
স্থানীয় সাংবাদিকদের মতে, বর্তমান সাংবাদিকতাকে এগিয়ে নিতে কাঙাল হরিনাথ মজুমদারের জীবন, দর্শন সামনে নিয়ে আসা প্রয়োজন। তার আদর্শ ও সমাজ চেতনা সমাজে ছড়িয়ে দিতে হবে, যাতে আজকের গণমাধ্যম তার কাছ থেকে শিক্ষা নিতে পারে।
কুমারখালী প্রেসক্লাবের সাংগঠনিক সম্পাদক তানভীর লিটন বলেন, নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও কৃষক-প্রজা-রায়ত-শ্রমজীবী মানুষ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির স্বার্থের অনুকূলে ত্ার কলম সদা সোচ্চার ছিল। সাপ্তাহিক, পাক্ষিক ও মাসিক পত্রিকা হিসাবে ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’ কুমারখালীর নিভৃত মফস্বল থেকে টানা ২২ বছর প্রকাশিত হয়েছে। গণমাধ্যমের পেশাদারিত্বকে অটুট রাখতে আজও কাঙাল হরিনাথ এক উজ্জ্বল আদর্শ।
কুমারখালী প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক সোহাগ মাহমুদ বাসসকে বলেন, অতীতে প্রচুর সুনাম অর্জনকারী গ্রামবার্তা পত্রিকা বন্ধ হওয়ার বেশ কয়েক যুগ পেরিয়ে গেলেও পত্রিকাটি আজ অবধি সাংবাদিক,- সাহিত্যসেবী ও গুণিজনদের কাছে চিরস্মরণীয়। ইতিহাস-ঐতিহ্যের নিদর্শন প্রাচীন বাংলার প্রথম মুদ্রণযন্ত্রটি কালের সাক্ষী হিসেবে এখন কুমারখালীর কুণ্ডুপাড়ায় কাঙাল কুঠিতে সংরক্ষিত আছে। জরাজীর্ণ ও ক্ষয়িষ্ণু সেই এম এন প্রেসসহ মুদ্রণযন্ত্র ও ছাপায় ব্যবহৃত ধাতব অক্ষরগুলো ব্রিটিশরাজের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ লেখনীর এক উজ্জ্বল নিদর্শন। ইতিহাসের অংশ হিসেবে আজও তা কাঙাল হরিনাথ স্মৃতি জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে।
জানা যায়, কাঙাল হরিনাথ যখন সাংবাদিকতা করেছেন তখন ইংরেজ শাসনের পাশাপাশি সমাজপতিদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে সাংবাদিকতা করতে হতো। সে সময় কলকাতা ছাড়া কোথাও মুদ্রণযন্ত্র ছিল না। কলকাতা থেকে সংবাদপত্র ছাপিয়ে গ্রামগঞ্জে এনে হরিনাথ যেন অসাধ্য সাধন করেছিলেন। তাঁর জীবনে কখনো সচ্ছলতা ছিল না। কিন্তু তা সত্ত্বেও পত্রিকা প্রকাশের সুবিধার্থে তিনি ১২৯২ বঙ্গাব্দে (১৮৭৩ ইংরেজি) একটি ছাপাখানা (মুদ্রনযন্ত্র) স্থাপন করেন। রাজশাহীর রানি স্বর্ণকুমারী দেবীর অর্থানুকূল্যে পত্রিকা প্রকাশের পর বেশ কয়েকবার অর্থাভাবে বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু বন্ধুদের অর্থ সাহায্যে পত্রিকাটি সাময়িক রক্ষা পায়। তবে ১২৯২ বঙ্গাব্দের আশ্বিনে (১৮৮৫ ইংরেজি) পত্রিকাটি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়।
ব্রিটিশ আমলে সামাজিক সমস্যা, নিপীড়ন, শোষণ কিংবা যে কোনো অত্যাচারের বিরুদ্ধে নিয়মিত সংবাদ প্রকাশ করে আলোচনায় আসে গ্রামবার্তা পত্রিকা। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে শুধু নয়, নারী শিক্ষাসহ সমাজ সংস্কারের জন্য নানা কর্মকাণ্ডের জন্য তিনি সবার কাছে স্মরণীয়। তাঁর স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য ২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় কাঙাল হরিনাথ স্মৃতি জাদুঘর। পরে তার ব্যবহৃত বিভিন্ন জিনিসপত্র এবং তার ব্যবহৃত ছাপাখানার বিভিন্ন যন্ত্রাংশ স্থান পায় জাদুঘরে।
জাদুঘর কর্তৃপক্ষ জানায়, স্থানীয় অনেকের কাছেই কাঙাল হরিনাথের অনেক স্মৃতি সংরক্ষিত আছে। সেগুলো যদি তারা জাদুঘরে সংরক্ষণের জন্য দিতো তাহলে আগামী প্রজন্মের পাশাপাশি অনেক গবেষক তার সম্পর্কে জানার ও গবেষণার সুযোগ পেতো।
কাঙাল হরিনাথ স্মৃৃতি জাদুঘরের ইনচার্জ তাপস কুমার মন্ডল বাসসকে বলেন, সংবাদপত্র ও সাহিত্যসেবী কাঙাল হরিনাথ মজুমদার তেমন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করতে না পারলেও, শিক্ষা-সাহিত্য ও জ্ঞানচর্চায় তার ছিল প্রবল আগ্রহ। তাই কাঙাল হরিনাথের জীবন আদর্শ বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় বড় ভূমিকা রাখবে বলে মনে করেন সুধীজনেরা।
কাঙাল হরিনাথ খুব ছোটবেলায় তার পিতা-মাতাকে হারান। তার পিতার নাম হরচন্দ্র মজুমদার। বাল্যকালে কৃষ্ণনাথ মজুমদারের ইংরেজি স্কুলে কিছুদিন অধ্যয়ন করেন। অর্থাভাবে প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যাশিক্ষায় বেশি দূর অগ্রসর হতে পারেননি। কিন্তু নিজে সারাজীবন অবহেলিত গ্রামবাংলায় শিক্ষাবিস্তারের জন্য ও শোষণের বিরুদ্ধে সংবাদপত্রের মাধ্যমে আন্দোলন করেছেন।
পরে গোপাল কুণ্ডু, যাদব কুণ্ডু, গোপাল স্যান্যাল প্রমুখ বন্ধুদের সাহায্যে ১৮৫৫ সালের ১৩ জানুয়ারি নিজ গ্রামে একটি ভার্নাকুলার বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন হরিনাথ মজুমদার। এরপর বেশ কিছুদিন ঐ বিদ্যালয়েই বিনাবেতনে শিক্ষকতা করেন। পরবর্তীকালে তারই সহায়তায় ২৩ ডিসেম্বর, ১৮৫৬ সালে কৃষ্ণনাথ মজুমদার কুমারখালীতে কুমারখালী সরকারি পাইলট বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন।