শিরোনাম

ঢাকা, ২৮ ডিসেম্বর, ২০২৫ (বাসস): পঞ্চাশের দশকের রক্ষণশীল সমাজে যার সুঠাম দেহগঠন ও উদার জীবনযাপন তোলপাড় সৃষ্টি করেছিল, সেই চূড়ান্ত যৌন প্রতীক ব্রিজিত বারদো একসময় পুরুষের দৃষ্টির কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েন এবং সব ছেড়ে দিয়ে প্রাণীদের সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করেন।
শুরুর দিকে তার অনিন্দ্য দেহ-সৌষ্ঠব, কাজল-ঘেরা চোখ ও পুরুষ্ট ঠোঁট ফরাসি চলচ্চিত্রের পোস্টারে ছাপা হলে, ‘বিবি’ নামে পরিচিত এই অভিনেত্রীর সঙ্গে মেরিলিন মনরোর তুলনা টানা হতো।
কিন্তু ১৯৭৩ সালে একদিনেই তিনি খ্যাতির জগৎকে পেছনে ফেলে পরিত্যক্ত প্রাণীদের দেখভালের সিদ্ধান্ত নেন। তখন তিনি বলেছিলেন, তিনি ‘প্রতিদিন সুন্দর থাকতে থাকতে ক্লান্ত’।
স্বল্প চলচ্চিত্রজীবনে বারদো জনপ্রিয় সাফল্যের একের পর এক স্বাদ পেলেও সমালোচকদের কাছ থেকে তেমন স্বীকৃতি পাননি।
তার প্রায় ৫০টি ছবির অধিকাংশই ছিল মজার কিন্তু ভুলে যাওয়ার মতো ব্যর্থতা- কয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া।
১৯৫৬ সালে, তৎকালীন স্বামী রজার ভাদিম পরিচালিত ‘অ্যান্ড গড ক্রিয়েটেড ওম্যান’-এ ১৮ বছর বয়সী এক তরুণীর ভূমিকায় তিনি পর্দা মাতান। ছবিতে তিনি প্রেমের ত্রিভুজে জড়িয়ে পড়েন।
ভাদিমের এই ভবিষ্যদ্বাণী- তরুণ এই নৃত্যশিল্পী ‘সব বিবাহিত পুরুষের অধরা কল্পনা’ হয়ে উঠবেন- সত্য প্রমাণিত হয়।
অদম্য যৌন শক্তিতে ভরপুর একটি দৃশ্যে কোমর পর্যন্ত চেরা স্কার্ট পরে মাম্বো নাচে বারদো চলচ্চিত্র দেবীর মর্যাদা নিশ্চিত করেন, যদিও এতে সেন্সরদের ক্ষোভও ডেকে আনে।
সাত বছর পর, জঁ-লুক গদারের ‘কঁতঁপ্ত’ ছবিতে এক চিত্রনাট্যকারের গুমোট ও হতাশ স্ত্রীর চরিত্রে অভিনয় করে তিনি সিনেমার লোককথার অংশ হয়ে ওঠা কিছু দৃশ্য উপহার দেন।
প্রযোজক ও দর্শকদের নগ্ন বারদোর প্রত্যাশাকে উল্টে দিয়ে, গদার বিছানায় স্বামীর পাশে শুয়ে থাকা বারদোর দেহের বিভিন্ন অংশের এক মন্টাজ নির্মাণ করেন, যেখানে তিনি স্বামীকে জিজ্ঞেস করেন- তার শরীরের কোন অংশটি তার সবচেয়ে পছন্দ।
‘নৈতিকতার যেখানে শেষ, সেখানেই রানী বারদো দাঁড়িয়ে আছেন,’ ১৯৫৮ সালে লিখেছিলেন ফরাসি লেখক মার্গারিট দুরাস।
‘তিনি যা খুশি তাই করেন, আর সেটাই অস্বস্তিকর,’ এক বছর পর বলেছিলেন দার্শনিক সিমোন দ্য বোভোয়ার।
কিন্তু উদারচরিত্রের এই ভূমিকায় আনন্দ পাওয়ার বদলে বারদো ভোগ্যপণ্যে পরিণত হওয়ার যন্ত্রণা বয়ে বেড়ান।
১৯৬০ সালে, নিজের ২৬তম জন্মদিনে তিনি আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। পরে ১৯৭৩ সালে, ৪০ বছরে পা দেওয়ার আগেই তিনি সবকিছুকে বিদায় জানান।
‘আমি জানতাম, আমার ক্যারিয়ার পুরোপুরি আমার শারীরিক গড়নের ওপর দাঁড়িয়ে,’ ১৯৭৮ সালে তিনি বলেছিলেন, ‘তাই আমি সিনেমা ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি ঠিক যেভাবে আমি সবসময় পুরুষদের ছেড়েছি সবার আগে।’
১৯৩৪ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর প্যারিসে জন্ম নেওয়া বারদো বেড়ে ওঠেন একটি সচ্ছল, ঐতিহ্যবাহী ক্যাথলিক পরিবারে।
চারবার বিয়ে করা বারদোর একটি সন্তান রয়েছে- দ্বিতীয় স্বামী অভিনেতা জাক শারিয়েরের সঙ্গে নিকোলা-জাক।
চলচ্চিত্র ছাড়ার পর প্রাণী-অধিকার আন্দোলনই হয়ে ওঠে তার জীবনের প্রধান অধ্যায়। মাত্র ৩৯ বছর বয়সে তিনি ফরাসি রিভিয়েরা অঞ্চলের সাঁ-ত্রোপেজে স্থায়ীভাবে চলে যান।
২০১১ সালে সংরক্ষণবাদী সংস্থা ডব্লিউডব্লিউএফ-কে লেখা এক চিঠিতে তিনি আশির দশকে কানাডা সফরের কথা স্মরণ করেন, যেখানে তিনি সিলশাবক নিধনের বার্ষিক দৃশ্য প্রত্যক্ষ করেন।
‘এই ছবিগুলো আমি কখনো ভুলব না- ব্যথার চিৎকার এখনো আমাকে কুরে কুরে খায়। কিন্তু এগুলোই আমাকে প্রাণীদের রক্ষায় আমার পুরো জীবন উৎসর্গ করার শক্তি দিয়েছে,’ তিনি লেখেন।
১৯৮৬ সালে তিনি প্রাণী সুরক্ষায় নিবেদিত ‘ব্রিজিত বারদো ফাউন্ডেশন’ প্রতিষ্ঠা করেন। সিলশাবক ও হাতির পক্ষে তিনি আন্দোলন করেছেন, ধর্মীয় পশুবলি বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন এবং ঘোড়ার কসাইখানা বন্ধের দাবি তুলেছেন।
পরবর্তী দশকগুলোতে বারদো চরম ডানপন্থার দিকে ঝুঁকে পড়েন। সমকামী, মুসলিম ও অভিবাসীদের বিরুদ্ধে অবমাননাকর মন্তব্যের কারণে তিনি পাঁচবার বর্ণবিদ্বেষ উসকে দেওয়ার দায়ে দণ্ডিত হন।
২০০৩ সালে প্রকাশিত তার বই ‘আ ক্রাই ইন দ্য সাইলেন্স’-এ তিনি ‘ফ্রান্সের ইসলামিকরণ’ এবং ‘গোপন, বিপজ্জনক ও নিয়ন্ত্রণহীন অনুপ্রবেশ’-এর বিরুদ্ধে সতর্ক করেন।
২০১২ ও ২০১৭ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনি প্রকাশ্যে চরম ডানপন্থী নেত্রী মারিন লে পেনকে সমর্থন করেন। লে পেন তাকে ‘একবিংশ শতাব্দীর জোয়ান অব আর্ক’ বলে আখ্যা দেন।
ফ্যাশন ও চলচ্চিত্র জগতকে দীর্ঘদিন এড়িয়ে চলা বারদো পশম পরিধানের বিরুদ্ধে সরব ছিলেন এবং কখনো প্লাস্টিক সার্জারির আশ্রয় নেননি বলে গর্ব করতেন।
২০১৭ সালে হার্ভি ওয়াইনস্টাইন কেলেঙ্কারিকে কেন্দ্র করে #মিটু আন্দোলন যখন বিশ্বজুড়ে আলোড়ন তোলে, তখনও তিনি ভিন্ন সুরে কথা বলেন।
২০১৮ সালে প্যারিস ম্যাচকে তিনি বলেন, ‘অধিকাংশই ভণ্ড ও হাস্যকর,’ নির্যাতনের অভিযোগ নিয়ে এগিয়ে আসা অভিনেত্রীদের প্রসঙ্গে।
‘অনেক অভিনেত্রীই কোনো ভূমিকা পেতে প্রযোজকদের সঙ্গে ইচ্ছাকৃতভাবে খুনসুটি করেন। পরে আলোচনায় আসার জন্য বলেন, তারা হয়রানির শিকার হয়েছেন। পুরুষেরা আমাকে সুন্দর বললে বা আমার নিতম্বের প্রশংসা করলে আমি সেটাকে বরং মনোরমই মনে করতাম।’