বাসস
  ৩১ জুলাই ২০২৫, ১৯:২৭

আন্দোলনে কওমী মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ ছিল অতুলনীয় : বাঁধন

নূরুল আলম বাঁধন। ছবি : ফেসবুক

পলিয়ার ওয়াহিদ

ঢাকা, ৩০ জুলাই, ২০২৫ (বাসস) : জুলাই গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরাচার আওয়ামী সরকারের বিরুদ্ধে নিজেদের জীবনবাজি রেখে লড়াই করেছিলেন এ দেশের আপামর ছাত্র-জনতা। সেই গণঅভ্যুত্থানের আন্দোলন সংগ্রামে উত্তাল হয়ে উঠেছিল সারাদেশ। শিক্ষার্থী ও ছাত্রনেতাদের সাহসী ও সংগ্রামী কার্যক্রম স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারের পতনকে আরও ত্বরান্বিত করেছিল। সেই সময় হাজারো শিক্ষার্থীকে সংগঠিত করে আন্দোলন পরিচালনায় সম্মুখসারিতে নেতৃত্ব দেন জাতীয় ছাত্র সমাজের সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক ছাত্রনেতা নূরুল আলম বাঁধন। তিনি ২০১৮ সালে নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনেও যুক্ত ছিলেন ।

নূরুল আলম বাঁধনের জন্ম ১৬ অক্টোবর ১৯৯৭ সালে রাজধানীর জুরাইনে। বাবা জাহাঙ্গীর আলম ও সেলিনা বেগমের সন্তান তিনি। লেখাপড়া করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য বিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগে।

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার বিশেষ আয়োজন ‘জুলাই জাগরণ’-এর মুখোমুখি হয়ে রাজপথের স্মৃতি ও অভিজ্ঞতা শুনিয়েছেন তিনি। সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন পলিয়ার ওয়াহিদ।

বাসস : জুলাই গণঅভ্যুত্থানের এক বছর পূর্ণ হলো। জুলাইয়ের সেই সংগ্রামী সময়ের স্মৃতি এখনো অনুভব করেন?

নূরুল আলম বাঁধন : জুলাই আন্দোলন ছিল আমাদের জন্য একটি বিভীষিকাময় সময়। প্রতিনিয়ত জীবনবাজি রেখে আন্দোলনে নামতে হতো। ওই সময়ের প্রতিটি দিন ছিল আমাদের কাছে একেকটি কালো অধ্যায় এবং অগ্নি পরীক্ষা। জুলাইয়ের সেসব দিন কখনো ভুলে যাওয়ার মতো নয়।

বাসস : কোটা সংস্কার আন্দোলনে আপনার সংগঠনের ভূমিকা কি ছিল?

নূরুল আলম বাঁধন : ৫ জুন কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে থেকে  কোটা প্রথার বিরুদ্ধে আমরা এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করি। আমাদের সংগঠন বাংলাদেশ জাতীয় ছাত্রসমাজ কেন্দ্রীয় কমিটির সিদ্ধান্ত মোতাবেক আমাদের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা কমিটি এবং জেলা মহানগর ছাত্র সমাজের নেতৃবৃন্দ মাঠে ছিল। বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী হিসেবে আমি এবং আমাদের সংগঠনের আহ্বায়ক সাইফুল ইসলাম ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করি।

বাসস : জুলাই গণঅভ্যুত্থান নিয়ে এখনো কাউকে বলেননি এমন কোনো স্মৃতি জানাতে চাই।

নূরুল আলম বাঁধন : জুলাই গণঅভ্যুত্থানের অনেক স্মৃতি রয়েছে। ওই সময় ব্যক্তিগতভাবে আমার ক্ষেত্রে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করা খুবই কষ্টের ছিল। কারণ পড়ালেখা করার পাশাপাশি আমি একটি পেশায় নিয়োজিত ছিলাম। পুলিশের বাধার মুখে পড়ে অনেক সময় কর্মক্ষেত্রে আমাকে নানান সমস্যায় পড়তে হয়েছে এবং আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসী বাহিনী  আমার বাসায় এসে হুমকি দিয়েছিল। তারা আমার বাসায়  পুলিশ পাঠিয়ে আমাকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করে। সেসব দিনগুলো ছিল বড়ই নিদারুণ ও নির্মম।

বাসস : আন্দোলনে আপনার সামনে শহীদ হয়েছেন এমন কোনো স্মৃতি আছে? থাকলে সেই শহীদ কে? সেই ঘটনা শুনতে চাই।

নূরুল আলম বাঁধন : বেশিরভাগ সময় আন্দোলনে সক্রিয় ছিলাম শাহবাগ এবং যাত্রাবাড়ীতে। যাত্রাবাড়ী ছিল আন্দোলনের সবচেয়ে একটি হটস্পট। সেখানে অনেককে শহীদ হতে দেখেছি। রাজপথে তো কেউ কাউকে চিনতাম না। কিন্তু মনে হতো চিরচেনা। তার মানে হলো আপনার পক্ষে যেই দাবি তুলুক সেই আপনার স্বজন। ফলে রাজপথে জুলাইয়ে যেই রাজপথে নেমেছে সবাই ছিল আমাদের বন্ধু। বেশির ভাগই তো অপরিচিত। কিন্তু আমার সামনে ইরফান ভূঁইয়া নামে এক ব্যক্তি ১৮ জুলাই পুলিশের গুলিতে শহীদ হন।

বাসস : জুলাই যোদ্ধা হিসেবে আপনি কি এক দফা ঘোষণার আগে বুঝতে পেরেছিলেন হাসিনা পালিয়ে যাবে?

নূরুল আলম বাঁধন : আমরা যেহেতু ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি জড়িত সেহেতু হাসিনা পতনের চিন্তা-ভাবনা শুরু থেকেই ছিল। একটা সময় আমরা বুঝতে পারি এই আন্দোলন আর কোটা আন্দোলনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। আন্দোলনটা পর্যায়ক্রমে গণজোয়ারে পরিণত হচ্ছিল। পরবর্তীতে তা এক দফার আন্দোলনে রূপ নেয়। আমাদের সংগঠনের দায়িত্বশীল জায়গায় থেকে সকল নেতাকর্মীদের বলেছি যার যার অবস্থান থেকে হাসিনার বিরুদ্ধে জোরালো পদক্ষেপ নিতে এবং এ নির্দেশনা অনুযায়ী আমাদের কর্মীরা যাত্রাবাড়ী-রামপুরাসহ সকল স্থানে সংক্রিয় ছিল। আমরা মনে প্রাণে স্বৈরাচারী হাসিনার পতনের জন্যই রাজপথে ছিলাম। তার পতন ঘটানোই আমাদের লক্ষ্য ছিল। কিন্তু খুনি হাসিনা পালিয়ে যেতে পারে সেটা কখনো ভাবিনি। দেশে থাকলে তার বিচার করা সহজ হতো।

বাসস : ৫ আগস্ট বা ৩৬ জুলাই কোথায় ছিলেন? হাসিনা পালানোর খবর কখন কার কাছে পান? সে সময়ের অনুভূতি কেমন ছিল?

নূরুল আলম বাঁধন : ৫ আগস্ট আমি ছিলাম ঢাকার কেরানীগঞ্জে। যেহেতু নিজ বাসায় থাকতে পারতাম না সেহেতু তখন আত্মীয়-স্বজনের বাসায় লুকিয়েছিলাম। আমি যখন কেরানীগঞ্জ থেকে রওনা হই যাত্রাবাড়ীর উদ্দেশ্যে তখন মায়ের কণ্ঠে শুনতে পাই ‘হাসিনা হেলিকপ্টারে করে পালিয়েছে, তোকে আর লুকিয়ে থাকতে হবে না।’ মায়ের কণ্ঠে এমন খবর শুনে আমি আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়ি। আল-হামদুলিল্লাহ বলে আমি নিজে কান্না করে দিই। আসলে ওই সময়ের অনূভুতি কখনোই বলে বুঝানো সম্ভব নয়।

বাসস : আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলা সাধারণ শিক্ষার্থীদের কীভাবে প্রভাবিত করেছিল?

নূরুল আলম বাঁধন : দেখুন ১৫ জুলাই ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের বর্বর হামলার পর পুরো বাংলাদেশ ক্ষোভে ফেটে পড়েছিল। ছাত্রলীগের এমন নৃশংসতা সাধারণ মানুষ মেনে নিতে পারেনি। এছাড়াও ছাত্রলীগ অনেক জায়গায় সাধারণ শিক্ষার্থীদের বাসায় গিয়ে হুমকি-ধামকি দিয়ে আসতো। এসবের প্রতিবাদে শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ মাঠে সংক্রিয় ছিল। আমরা তো ভাবতাম আজ তো আন্দোলন ভালোই হলো। কাল যদি মানুষ মাঠে না নামে? কিন্তু প্রতিদিন সাধারণ মানুষের আন্দোলনে অংশগ্রহণ আমাদের বিস্মিত করেছে। তারা নিজেদের তাগিদেই আন্দোলন অব্যাহত রেখেছে।

বাসস : আন্দোলনে নারী শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ কেমন ছিল?

নূরুল আলম বাঁধন : বিশেষ করে ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় নারী শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ ছিল অভূতপূর্ব। ১৫ জুলাই ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের হামলায় বহু শিক্ষার্থী আহত হয়।

সেদিন হামলায় মারাত্মকভাবে আহত রক্তমাখা এক নারী শিক্ষার্থীর মুখ ভাইরাল হয়। ছাত্রলীগ সেদিন কোনো ধরনের বাছ-বিচার ছাড়াই নারী শিক্ষার্থীদের ওপর নেক্কারজনকভাবে হামলা করে। ফলে সারাদেশের মানুষ ফুঁসে ওঠে। এ আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণ আন্দোলনের গতিকে ত্বরান্বিত করেছে। 

বাসস : কওমী মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে আন্দোলন জোরালো হয়। সে বিষয়ে কিছু বলুন।

নূরুল আলম বাঁধন : অবশ্যই এই আন্দোলনে কওমী মাদ্রাসার শিক্ষাথীদের অংশগ্রহণ ছিল অতুলনীয় ও নজিরবিহীন। তারা যাত্রাবাড়ীতে গুলির সামনে বুক পেতে দিয়েছে।

তাদের ভূমিকার কথা এই জাতি মনে রাখবে। কেউ যেন তাদের কথা ভুলে না যায়।

বাসস : আন্দোলন দমনে প্রশাসন ও পুলিশের ভূমিকা কেমন ছিল?

নূরুল আলম বাঁধন : এই আন্দোলন দমনে পুলিশ বাহিনী ছিল অত্যন্ত কঠোর। তারা হাসিনা সরকারের চাকরে পরিণত হয়েছিল। আপনি একবার ভাবুন। এই পুলিশ কি আমাদের পুলিশ? হাসিনা পালানোর পরও কেন তারা গুলি চালালো? ৫ আগস্ট বিকেল পর্যন্ত আমাদের যাত্রাবাড়ীতে গুলি চালায় পুলিশ। শত শত মানুষের মৃত্যু হয়। এরা মানুষকে মানুষ মনে করেনি। এদের কারণে কয়েকশ’ মানুষ শহীদ হয়েছে। আমাদের হাজার হাজার ভাই এখনো হাসপাতালে আহাজারি করছে। কারো চোখ নেই। কারো হাত নেই। কারো নেই পা। এসব মানুষ পুলিশের পশুত্বের বলি হয়েছে। এদিকে পুলিশ যত গুলি করেছে আন্দোলন তত বেগবান হয়েছে।

বাসস : আন্দোলনে শহীদ ও আহতদের জন্য আপনারা কি কি পদক্ষেপ নিয়েছেন?

নূরুল আলম বাঁধন : বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি বিজেপির চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থ ভাই সব সময় গণমানুষের পক্ষে কাজ করেছেন। আমাদের মহাসচিব আব্দুল মতিন সাউদ ভাই ঢাকার যাত্রাবাড়ী ও ডেমরা এলাকার আহতদের জন্য দলের পক্ষ থেকে সব রকমের সাহায্য করেছেন। তিনি পাশে ছিলেন এবং এখনো আছেন। তিনি সকলের সাথে সার্বিক বিষয়ে যোগাযোগ বজায় রেখেছেন।

বাসস : গণঅভ্যুত্থানের স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন কতটা হয়েছে?

নূরুল আলম বাঁধন : একটি সরকার পতনের পর নতুন একটি সরকার বাংলাদেশে এসেছে। সেক্ষেত্রে প্রতিটি সেক্টরে আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে কিছু সময় লাগবে। স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা সরকারের শাসনামলের তুলনায় বর্তমানে ক্যাম্পাসগুলোতে শিক্ষার্থীরা অনেক ভালো  অবস্থানে রয়েছে বলে আমি মনে করি।

বাসস : নতুন বাংলাদেশে আপনার প্রত্যাশা কি?

নূরুল আলম বাঁধন : নতুন বাংলাদেশে আমার প্রত্যাশা হলো সাম্য ও মানবিকতা নিয়ে দেশ এমন পথে আসুক, যে বাংলাদেশে সকল ধর্মের মানুষ নির্দ্বিধায় তার নিজ ধর্ম পালন করতে পারবে। দেশে রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা থাকবে কিন্তু প্রতিহিংসা থাকবে না। আমি এমন একটি বাংলাদেশ প্রত্যাশা করি।

বাসস : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থাকে সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

নূরুল আলম বাঁধন : আপনাকেও ধন্যবাদ।