বাসস
  ৩১ জুলাই ২০২৫, ১২:০০
আপডেট : ৩১ জুলাই ২০২৫, ১৯:১৯

জুলাই গণঅভ্যুত্থান আমাদের প্রজন্মের আত্মচেতনার জাগরণ: নাফসিন মেহেনাজ

নাফসিন মেহেনাজ আজিরিন। ছবি : ফেসবুক

রুদ্র আল মুত্তাকিন

ঢাকা, ৩১ জুলাই, ২০২৫ (বাসস): নাফসিন মেহেনাজ আজিরিন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে তিনি নারী শিক্ষার্থীদের একত্রিত করার চেষ্টা করেছেন। নাফসিন মনে করেন, নারীরা যখন রাস্তায় নেমে আসে তখন ইতিহাস পাল্টে যায়। নারী শক্তি রাজনীতিতে যুক্ত হলে দেশের রাজনীতি পাল্টে যাবে।

নাফসিন এমন এক বাংলাদেশ চান যেখানে কেউ প্রশ্ন করলে গুম হবেন না, প্রতিবাদ করলে গুলি খাবেন না। যেখানে ভিন্নমত প্রকাশ করলে অপরাধ হবে না। তিনি একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেন।

সম্প্রতি তিনি বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থাকে (বাসস) দেওয়া সাক্ষাৎকারে জুলাইয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে তার সম্পৃক্ততা ও ভবিষ্যতে কেমন বাংলাদেশ চান সেসব নিয়ে কথা বলেছেন।

বাসস: জুলাই গণঅভ্যুত্থানকে কীভাবে দেখেন?

নাফসিন মেহেনাজ আজিরিন: জুলাই গণঅভ্যুত্থান আমাদের প্রজন্মের আত্মচেতনার জাগরণ। এটা শুধু একটি সরকার পতনের আন্দোলন ছিল না, এটি ছিল একদল তরুণ-তরুণীর বিবেকের ডাকে সাড়া দেওয়ার এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত। আমি এই অভ্যুত্থানকে দেখি একটি নবজাগরণ হিসেবে, যেখানে সত্য, সাহস ও স্বপ্ন একসাথে মিশে একটি নতুন বাংলাদেশের ভিত্তিপ্রস্তর গড়ে তোলে।

গণঅভ্যুত্থান ছিল এক নতুন আশার আলো, বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর মতো একটি ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র গড়ার পথে একটি সাহসী পদক্ষেপ। নিম্নশ্রেণি থেকে উচ্চশ্রেণির মানুষ যেন সমানভাবে বাঁচতে পারে, সেই স্বপ্নের বাস্তবায়নের লড়াই। আমরা এমন একজন সৎ ও নীতিবান শাসক দেখার অঙ্গীকার নিয়েই পথে নেমেছিলাম। হয়তো এখনও সে স্বপ্ন পুরোপুরি বাস্তব হয়নি, কিন্তু আমাদের লড়াই ছিল সেই স্বপ্নেই বিশ্বাস রেখে, সমগ্র বাংলাদেশের মানুষের জন্য।

বাসস : বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েও কখন মনে করলেন আন্দোলনে নামা উচিত?

নাফসিন মেহেনাজ আজিরিন : আমার আন্দোলনের শুরুটা হয়েছিল ১৫ জুলাই থেকে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্টরা আসলে অনেকে কোটার বিষয়টা ঠিকমতো করে জানেও না। তবুও তারা আন্দোলনে নেমেছিল শুধু বিবেকের তাড়নায়। যখন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইদের অত্যাচার করা হচ্ছিল এবং তাদের সাথে অন্যায় হয়েছিল; তাদের ওপর পুলিশ লাঠিচার্জ এবং গুলি করেছিল তখনই আমরা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্টরা মনে করেছিলাম আমাদের এখনই আন্দোলনে নামা উচিত। তাই কোনো কিছু না ভেবে আন্দোলনে নেমে পড়ি। পুরো সময়টা এতই ভয়ঙ্কর ছিল যে বলার মতো না। মাঠে না নেমে উপায় ছিল না।

বাসস : জুলাই অভ্যুত্থানে কবে থেকে অংশগ্রহণ করলেন?

নাফসিন মেহেনাজ আজিরিন : ১৫ জুলাই আমি সরাসরি জুলাই অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিই। তারপর থেকে ধারাবাহিকভাবে আন্দোলনে যাই। অন্যদের একত্রিত করার কাজটা করছিলাম।

বাসস : জুলাইয়ে নারীদের অংশগ্রহণের ফলে আন্দোলন বেগবান হয়েছে। এ ব্যাপারে কিছু বলুন ...

নাফসিন মেহেনাজ আজিরিন : জুলাইয়ে নারীদের অংশগ্রহণের ফলে আন্দোলনটা আরো অনেক বেশি তীব্র এবং বেগবান হয়েছে। কারণ আমি মনে করি, নারীরা যখন রাস্তায় নেমে আসে তখন ইতিহাস পাল্টে যায়। এই জুলাই অভ্যুত্থানে নারীরা ন্যায় বিচারের দাবিতে রাস্তা নেমেছিল আর স্লোগান দিয়েছিল তুমি কে? আমি কে? রাজাকার রাজাকার! কে বলেছে, কে বলেছে স্বৈরাচার স্বৈরাচার! নারীদের জুলাই গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণের উপস্থিতি ছিল স্বৈরাচারের নির্যাতনের বিরুদ্ধে স্পষ্ট ঘোষণা। এ সরকার চেয়েছিল আমাদের দমিয়ে রাখতে, আমাদের চুপ করাতে কিন্তু তারা ভুলে গিয়েছিল যেখানে নারীরা দাঁড়ায় সেখানে ইতিহাস পাল্টে যায়। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নারীরা শুধু নিজেদের অধিকারের জন্য নয় বরং সমগ্র জাতির পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন। জাতির মুক্তির লড়াইয়ে নারীরা যুগে যুগে অংশগ্রহণ করে প্রমাণ দিয়েছে যে ন্যায্যতার প্রশ্নে তারা পিছপা হন না। লড়াই চালাতে জানে তারা।

নারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে পারলে দেশের রাজনীতিতে পরিবর্তন আসবে। জুলাই সেই সম্ভাবনা তৈরি করেছিল। রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত সেদিকে নজর রাখা।

বাসস : আওয়ামী লীগ বা ছাত্রলীগ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জুলাইয়ে নারী যোদ্ধাদের বুলিং করছে। অন্যান্য গোষ্ঠীও নারীদের অসম্মানিত করছে ...

নাফসিন মেহেনাজ আজিরিন : হ্যাঁ, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে যে সকল নারীদের অবস্থান একদম সামনের সারিতে ছিল তাদের নানাভাবেই হেনস্তার শিকার হতে হয়েছে। অভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশে এটা কোনোভাবেই মানা যায় না। তাদের বিভিন্ন ভিডিও এবং ছবি সোশ্যাল মিডিয়াতে ভাইরাল হয়েছে এবং এখনো যে সকল নারীরা কাজ করে যাচ্ছে প্রতিনিয়তই তারা হেনস্থার শিকার হচ্ছেন। এআই জেনারেটেড ছবি ছড়িয়ে নারীদেরকে অসম্মান করা হচ্ছে। পথে ঘাটে বুলিং করছে! প্রতিনিয়তই নারীদেরকে বুলিং করা হচ্ছে। আমি মনে করি এসব বন্ধ করতে কঠোর ব্যবস্থা ও পদক্ষেপ প্রশাসন থেকেই নেয়া উচিত। তাছাড়া এদের বিরুদ্ধে সামাজিক শক্তি গড়ে তোলা দরকার। প্রত্যেককে আইনের আওতায় এনে শাস্তির ব্যবস্থা করে এমন একটা উদাহরণ সৃষ্টি করা উচিত যেন কেউ এ রকম করে হেনস্তা করার সাহস না পায়।

বাসস : দেখা যায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ছাত্র রাজনীতিতে আসতে চায় না। আপনি এ বিষয়ে কী ভাবছেন?

নাফসিন মেহেনাজ আজিরিন : বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্টরা ছাত্র রাজনীতিতে আসতে চায় না তার কারণ বেশিরভাগ স্টুডেন্টদেরই পড়াশোনা শেষে বিদেশে পাড়ি জমানোর একটা চিন্তাভাবনা থাকে। আরো একটা কথা হচ্ছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে তেমন করে রাজনীতি করার বৈধতা নেই। ফলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্টরা সেরকম করে রাজনৈতিক চর্চা করতে পারেও না। কিন্তু আমি মনে করি জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ওপর বিশ্বাস করে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা রাজনীতির ব্যাপারে অনেক বেশি সচেতন হয়েছে। এখন তারাও রাজনীতি করতে ইচ্ছুক। দেখুন রাজনীতি করা সকলের গণতান্ত্রিক অধিকার। বাংলাদেশের যে কেউ যখন চায় যেভাবে চায় রাজনীতি করতে পারে। আমি তো মনে করি ছাত্রদের অবশ্যই রাজনীতি করা উচিত। কারণ রাজনীতি ছাত্ররা করবে না তো কারা করবেন! আগামীর ভবিষ্যতের হাল কারা ধরবে এই ছাত্ররাই তো! তরুণ এবং শিক্ষিতরাই আগামী বাংলাদেশের হাল ধরবে এবং বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।

বাসস : নতুন বাংলাদেশের সম্ভাবনা কেমন?

নাফসিন মেহেনাজ আজিরিন : দীর্ঘ ১৫ বছর আমাদেরকে শাসন ও শোষণের মাধ্যমে রাখা হয়েছিল। আমাদের মতামত প্রকাশ থেকে বিরত রেখেছিল গত স্বৈরাচার সরকার। আগামীর নতুন বাংলাদেশ হবে সত্যিই আমাদের স্বপ্নের বাংলাদেশ। যেখানে ঘুষ, চাঁদাবাজি আর দুর্নীতি থাকবে না। জুলাই আমাদেরকে সেই বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখায়। আমার আকাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশে দুর্নীতিবাজ, চাঁদাবাজদের কোনো স্থান হবে না।

বাসস : জুলাই গণঅভ্যুত্থান নিয়ে এখনো কাউকে বলেননি এমন কোনো ব্যক্তিগত স্মৃতি জানতে চাই।

নাফসিন মেহেনাজ আজিরিন : ১৮ জুলাই আন্দোলন শেষ করে আমি বাসায় ফিরতে পারছিলাম না; কারণ কোন যাতায়াত ব্যবস্থা ওই সময় ছিল না। কোনো যানবাহন মিরপুরে  আমাকে নিয়ে আমার বাসায় আসতে চাচ্ছিল না। তখন আমি অনেক জনকে কল করেও কারো বাসায় থাকার আশ্রয় পাইনি, এ কথাটা অনেক জনকেই বলা হয়নি। কষ্ট নেই, তবে দিনগুলোর কথা মনে পড়লে আজও স্তব্ধ হয়ে যাই।

বাসস : আন্দোলন চলাকালীন সময়ে আপনি কি ধরনের হুমকির সম্মুখীন হয়েছেন?

নাফসিন মেহেনাজ আজিরিন : আন্দোলন চলাকালীন আমাকে পুলিশ খুঁজতেছিল; এই কথা আমি জানতে পারি। সেই সময়ে আমি আমার বোনের বাসায় গিয়ে আশ্রয় নিই। আন্দোলনের মধ্যে বেশি করে হুমকি পাচ্ছিলাম। কিন্তু দমে যাইনি। আন্দোলনের পরেও হুমকির সম্মুখীন হয়েছি। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা আন্দোলনের পরেও অনেক বেশি খুনের ভয় দেখিয়েছিল। কিন্তু এসব আর পাত্তা দেই না। ন্যায্য দাবির প্রসঙ্গ আসলে আমি কখনো আপস করব না। সংগ্রাম চালিয়ে যাব।

বাসস : শেখ হাসিনা পালাবে বুঝতে পেরেছিলেন?

নাফসিন মেহেনাজ আজিরিন : ৩ আগস্ট শহীদ মিনারে ছাত্র জনতার ঢেউ দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম হাসিনা আর টিকতে পারবে না। ওর স্বৈরশাসনের সময় শেষ। বাংলার মানুষ ওকে আর ঠাঁই দেবে না।

বাসস : নতুন বাংলাদেশ কেমন দেখতে চান?

নাফসিন মেহেনাজ আজিরিন : আমি এমন এক বাংলাদেশ দেখতে চাই, যেখানে কেউ প্রশ্ন করলে গুম হয় না, প্রতিবাদ করলে গুলি খায় না। যেখানে ভিন্নমতের অপরাধ নেই, বরং তা গণতন্ত্রের শক্তি হিসেবে মূল্যায়িত হয়। আমি এমন একটি দেশ চাই, যেখানে রাষ্ট্রের মালিকানা রাজনীতিবিদদের নয়, বরং জনগণের কাছে থাকে। যেখানে একজন নারী নির্ভয়ে রাস্তায় হাঁটতে পারে, একজন শ্রমিক ন্যায্য মজুরি পায়, আর একজন শিক্ষার্থী নিঃসংকোচে সত্য বলতে পারে।

এমন একটা বাংলাদেশ চাই, যেখানে অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলাকে সাহস না, বরং নাগরিক দায়িত্ব বলে গণ্য করা হয়। আমি এমন এক বাংলাদেশ চাই, যেখানে আমরা সবাই বুক উঁচিয়ে গর্ব করে বলতে পারি: ‘এটাই আমার দেশ, বাংলাদেশ।’