শিরোনাম
ঝালকাঠি, ৩১ জুলাই, ২০২৫ (বাসস): পেয়ারার হাট বলতে আসলে খোলা মাঠ বা রাস্তার পাশে কোন প্রশস্ত জায়গা নয়। ঝালকাঠির পেয়ার হাট মানে খালের পানিতে বা জলের মধ্যে সারি সারি নৌকায় পেয়ারা বেচা-কেনা। আর দক্ষিণাঞ্চলের ভাসমান হাটের কথা বললেই প্রথমেই আসে ঝালকাঠির ভিমরুলি পেয়ারা হাটের কথা। প্রতিবছর পেয়ারার মৌসুমে দেশের নানা প্রান্ত থেকে ক্রেতা, বিক্রেতা, ব্যবসায়ী ও পর্যটকদের পদচারণায় জমে ওঠে ভাসমান পেয়ারার এই ভীমরুলি হাট। তবে ভ্রমণ পিপাসুদের মূল টার্গেট থাকে ছোট নৌকা বা ট্রলারে করে পেয়ারা বাগানের ভেতর সরুখালের কান্দি ঘুরে দেখা।
ছোট খালের ভেতর দিয়ে সরু অলিগলির পাড়ে পাড়ে পেয়ারা বাগানের সৌন্দর্য অবলোকন করেন পর্যটকরা।
কৃীর্ত্তিপাশা ইউনিয়নের সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান ও ভিমরুলি হাটের সভাপতি সাবেক প্রধান শিক্ষক ভবেন্দ্রনাথ হালদারের বর্ণনা অনুযায়ী, পেয়ারা বাগানে প্রচুর কান্দি (মাটির সারি) আছে। দুটি কান্দির মধ্যে থাকা খালটিই হলো নালা। যাতে জলাবদ্ধ না হয়ে জোয়ারের পানি ওঠানামা করতে পারে। পেয়ারার কান্দিতেই রয়েছে ভালো ফলনশীল আমড়া, যা দেখে যেকোনো পর্যটকই মুগ্ধ হন। কান্দিতে শিমের বিচি ও কলাগাছও লাগানো হয়েছে। এছাড়া লেবু, বাতাবিলেবু, পেঁপে ও আম চাষের পাশাপাশি রবি শস্যও রোপণ করা হয় এই কান্দিতে।
পুরুষের পাশাপাশি নারী চাষিরাও নৌকা চালিয়ে বাগানের অলিগলিতে প্রবেশ করে। তারা বাগান থেকে পেয়ারা নৌকায় করে ভাসমান হাটে বিক্রির জন্য নিয়ে যায়। সেখানে রোদ কিংবা বৃষ্টি, সব সময়ই ক্রেতার জন্য নৌকায় অপেক্ষা করে চাষি। হঠাৎ তুমুল বৃষ্টি হলেও উদাম গায়ে চাষিকে সইতে হয় আকাশের গর্জন।
প্রতিদিন সকাল ৭টা থেকে বেলা ১২টা পর্যন্ত চলে হাটে বেচা-কেনা।
পেয়ারার মৌসুমে ভিমরুলি ভাসমান হাটে ট্রলারযোগে সকাল থেকে দলে দলে আসতে থাকেন ভ্রমণ পিপাসুরা। এক টুকরো প্রশান্তি এবং প্রকৃতি থেকে অক্সিজেন নিতে সবাই আসেন এখানে। যেদিকে তাকাবেন দিগন্ত জুড়ে শুধু গাছ আর গাছ।
তিনি আরো জানান, ২০০ বছরেরও বেশি সময়জুড়ে এই এলাকায় পেয়ারার চাষ হচ্ছে। তার আগে তার বাবা-দাদারাও পেয়ারা এবং সবজি চাষের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। বর্তমানে এই বিশাল বাগানে তার ১৫ একর জায়গায় পেয়ারা, আমড়া, লেবু, বাতাবিলেবু, কলা ও আমসহ রবি শস্যের চাষ হচ্ছে। বর্তমানে ভিমরুলি, ডুমুরিয়া, শতদশকাঠি, জগদীশপুর, আতা, জামুয়া, কাপুড়কাঠি, রামপুর ও মীরাকাঠিসহ আশপাশের এলাকার শত শত চাষি পেয়ারা বাগানের সঙ্গে জড়িত।
প্রসঙ্গত, সরকার-নির্ধারিত ঝালকাঠি জেলার দুটি ব্রান্ডিং পণ্যের একটি হলো পেয়ারা। 'পেয়ারা আর শীতলপাটি, এই নিয়ে ঝালকাঠি' এটি জেলা প্রশাসনের ওয়েবসাইটে ট্যাগ করা আছে। ট্যাগের পাশাপাশি জেলা প্রশাসনের লোগো করা হয়েছে পেয়ারা আর শীতলপাটির ছবি যুক্ত করে। এ ছাড়া জেলা প্রশাসন কার্যালয়ের সামনের ফোয়ারার মাঝখানে আকর্ষণীয়ভাবে নির্মাণ করা হয়েছে শীতলপাটির ওপরে পেয়ারার ভাস্কর্য।
জেলার সদর উপজেলার কীর্ত্তিপাশা ইউনিয়নের ভিমরুলি, মীরাকাঠি, ডুমুরিয়া, ভৈরমপুর, খেজুরা, খোদ্দবরাহর, বেশাইনখান, শংকরধবল, বেউখান, স্থানসিংহপুর ও কীর্ত্তিপাশা এই ১১টি গ্রামসহ নবগ্রাম ইউনিয়নের নবগ্রাম, হিমানন্দকাঠি, দাড়িয়াপুর, সওরাকাঠি ও কঙ্গারামচন্দ্রপুর এই ৫টি গ্রাম এবং গাভারামচন্দ্রপুর, বিনয়কাঠি ও শেখেরহাট ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রাম মিলিয়ে ঝালকাঠি সদর উপজেলার ২০টিরও বেশি গ্রামে পেয়ারার বাণিজ্যিক চাষ হয়ে আসছে বহু বছর ধরে। জেলায় এ বছর ৬০০ হেক্টর জমিতে পেয়ারার আবাদ হয়েছে। যার মধ্যে হেক্টর প্রতি ফলন প্রায় ১০ হাজার কেজি।
পেয়ারা গাছে সাধারণত মাঘ-ফাল্গুন মাসে ফুল আসে। পরপর তিনবার ফুল আসে। আষাঢ় মাস থেকে পেয়ারা পাকা শুরু হয়। ভাদ্র মাস পর্যন্ত পেয়ারা পাওয়া যায়। আষাঢ় ও শ্রাবণ মাস পেয়ারার ভরা মৌসুম।
কলাপাতার ভাঁজে চার কোনা ঘর করে পেয়ারা যখন পাইকারি ক্রেতারা উঁচু করে সাজান, সে দৃশ্যটিও তাকিয়ে থাকার মতো। এছাড়া প্লাস্টিকের কেস ভরে বড় ট্রলাওে পেয়ারা ওঠানো এ মৌসুমের নিয়মিত দৃশ্য।
এ বছর পেয়ারা চাষিরা খুব একটা ভালো দাম পাচ্ছেন না বলে জানিয়েছেন স্থানীয় ব্যবসায়ী শুভ্রজিৎ হালদার।
তিনি জানান, গত দুই-তিন সপ্তাহ ধরে পর্যটক বেড়েছে। এই হাটে পর্যটকদের জন্য নৌকার ঘণ্টাপ্রতি ভাড়াও নির্ধারণ করা থাকে বলে জানান তিনি।
বরিশাল থেকে আসা পর্যটক শাহরিয়ার রাইয়ান বলেন, ঝালকাঠির ভিমরুলির এই ভাসমান হাট অনেক সুন্দর। তার মতে চায়না ও ভিয়েতনামের মতো এটি এমন একটি হাট যেখানে সবুজের নিসর্গ। পরিবারের সবাইকে নিয়ে নৌকা ভ্রমণ করে অনেক আনন্দ পেয়েছেন বলে জানান তিনি।
এককজন বয়োজ্যেষ্ঠ দর্শনার্থী বলেন, সম্প্রতি পরিবারের সবাইকে নিয়ে ভিমরুলি ভাসমান বাজারে ঘুরতে আসছি। এখানে আমড়া-বাগান আছে। মূলত পেয়ারা বাগানই সবাইকে অকৃষ্ট করে। এখানে সমস্যা হচ্ছে, থাকার ব্যবস্থা নাই, হোটেলে খাবারের মানও ভালো না। এগুলো উন্নত করা প্রয়োজন।
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ফাতিমা তুজ জোহরা জানান, ভিমরুলি পেয়ারা-বাগানে এসে আমাদের অনুভূতি অনেক মজার। আমরা সারাদিন অনেক আনন্দ করেছি ফ্যামিলির সঙ্গে ঘুরেছি। অনেক ভালো জায়গা। প্রতিবছরই এখানে আসি এবং আসতে চাই।
স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুর রহিম জানান, ভিমরুলি বাজার বেশ পুরোনো হলেও ৩০ বছর ধরে দারুণ জমে উঠেছে। দক্ষিণাঞ্চলের এখন সবচেয়ে বড় ভাসমান বাজার ঝালকাঠি জেলার এই ভিমরুল বাজার। এই বাজার দেখতে গত ২৭ জুলাই ভীমরুলি এসেছিলেন আলজেরিয়ার রাষ্ট্রদূত আবদেলোহাব সায়দানি। এর পূর্বে এসেছিলেন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, নেপাল ও ভারতের রাষ্ট্রদূতরাও এসেছেন একাধিকবার। এ ছাড়া মন্ত্রী, এমপিসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও পেয়ারা বাগান পরিদর্শনে আসছেন।
ঝালকাঠি প্রেসক্লাবের সভাপতি কাজী খলিলুর রহমান বাসসকে বলেন, মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা, ভারতীয় হাইকমিশনার হর্ষ বর্ধন স্রিংলা ও রীভা গাঙ্গুলি ভিমরুলি ভাসমান হাট দেখতে এসেছিলেন। তখন তাদের কাছে ভিমরুলির উন্নয়নে সহযোগিতার আহ্বান জানানো হয়েছিল।
ঝালকাঠি জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, জেলায় ৫৬২ হেক্টর জমিতে এ বছর পেয়ারার চাষ হয়েছে। এর মধ্যে সদর উপজেলার কীর্ত্তিপাশা ও নবগ্রাম এই দুই ইউনিয়নের ১৬টি গ্রাম এবং পার্শ্ববর্তী গাভারামচন্দ্রপুর, বিনয়কাঠি ও শেখেরহাট ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রাম রয়েছে।
সদর উপজেলা ও পিরোজপুরের নেছারাবাদ (স্বরূপকাঠি) উপজেলার পাশাপাশি বরিশাল জেলার বানারীপাড়া উপজেলারও ১৫টি গ্রামে পেয়ারার বাণিজ্যিক চাষ হয়।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফারহানা ইয়াসসিন বাসসকে বলেন, ভিমরুলির চাষীরা অনেক সময় আশানুরূপ দাম পান না। কারণ, পেয়ারা খুব দ্রুত বিক্রি করতে হয়। হিমাগারেও সংরক্ষণ করা সম্ভব না।
চাষিদের নিয়ে পেয়ারার জ্যাম জেলি কীভাবে বানানো যায়, সে বিষয়ে উপজেলা প্রশাসনের পরিকল্পনা আছে।
ব্র্যান্ডিং পণ্য পেয়ারার বিষয়ে ঝালকাঠি জেলা প্রশাসক আশরাফুর রহমান বাসসকে বলেন, ভিমরুলি ভাসমান বাজারের পাশে পর্যটকদের জন্য ওয়াচ ব্লক, সিটিং জোন, গোসলের জায়গা এবং নদীতে ঘাটলা তৈরি করে দেওয়া হয়েছে ট্যুরিজম বোর্ড ও এলজিইডির অর্থায়নে। ফ্রি ওয়াই-ফাই জোন করে দেওয়া হয়েছে আইসিটি অধিদপ্তরের মাধ্যমে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আরও কিছু উন্নয়ন কাজের পরিকল্পনা রয়েছে। বিশেষত হোটেল মোটেল করা যায় কি না সেদিকে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে চেষ্টা করা হচ্ছে। এ ছাড়া শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষায় উচ্চ শব্দের সাউন্ড সিস্টেম ও ডিজে পার্টি নিষিদ্ধ করা হয়েছে।