শখের হাত ধরে সফলতার পথে : জান্নাতুলের ‘ভূমি আর্টিজান’
ঢাকা, ২৬ নভেম্বর, ২০২৫ (বাসস) : স্থপতি হওয়ার স্বপ্ন থেকেই পথচলা শুরু। কিন্তু সেই স্বপ্নই একসময় তাকে নিয়ে যায় সম্পূর্ণ নতুন এক জগতে-উদ্যোক্তা হওয়ার সাহসে। সেখানেই নিজের শখ, নকশা আর সৃজনশীলতাকে হাতিয়ার করে গড়ে তোলেন তিনি ‘ভূমি আর্টিজান’। জান্নাতুল ফেরদৌসের গল্প তাই শুধু একজন নারীর সাফল্যের গল্প নয়-এটি এক অনুপ্রেরণার যাত্রা, যেখানে আবেগ, পরিশ্রম আর দৃঢ় সংকল্প মিলেমিশে জন্ম দিয়েছে নতুন এক সম্ভাবনার।
স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশে স্থাপত্যবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনার সময় থেকেই নকশা তাকে টানত। তবে ঘরবাড়ির জাঁকজমকপূর্ণ ডিজাইনের চেয়ে তার আগ্রহ ছিল দেশীয় ক্র্যাফট পণ্যে-মাটির জিনিস, বাঁশ-বেতের নকশা, হস্তশিল্পের নানান ধরন। ক্লাস শেষে যখন বন্ধুরা আড্ডায় মেতে উঠত, তিনি তখন ছুটে যেতেন ধানমন্ডির ৩২ ও ২৭ নম্বরের দেশীয় ব্র্যান্ডের শোরুমে। আড়ং, যাত্রা, অরণ্য-সব জায়গাতেই তার নিয়মিত যাতায়াত ছিল। দোকানিরাও মাঝে মাঝে ভাবত, তিনি হয়তো চাকরি খুঁজতে গেছেন! নকশার প্রতি সেই আগ্রহই হয়তো আজকের সফল উদ্যোক্তার ভিত গড়ে দিয়েছিল অজান্তেই।
২০২০ সাল। বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়া করোনার কারণে থামা দুনিয়া, থেমে গেছে তার পড়াশোনা ও ক্যাম্পাস জীবনও। এই সময় তৃতীয় বর্ষে পড়া অবস্থাতেই তার বিয়ে হয় এবং থিসিস জমা দেওয়ার প্রস্তুতির মাঝেই জন্ম নেয় প্রথম সন্তান। মহামারির কারণে সন্তানকে নিয়ে নারায়ণগঞ্জে বাবার বাড়িতে চলে যান জান্নাতুল। ঘরে বসে অবসর সময় কাটছিল ঠিকই, কিন্তু সৃজনশীলতার উচ্ছ্বাস থেমে থাকেনি। নিজের ঘর সাজানোর শখ ছিল তার দীর্ঘদিনের। সেই শখ থেকেই হঠাৎ একদিন ফেসবুকে খুলে ফেলেন ‘গৃহকাব্য’ নামে একটি পেজ। সেখানে তিনি নিজের হাতে সাজানো ঘরের ছবি প্রকাশ করতে থাকেন।
প্রথমদিকে এটি ছিল নিছকই শখ। কিন্তু একদিন নিজের নকশায় তৈরি কিছু পট প্ল্যান্টের ছবি পোস্ট করতেই দৃশ্যপট বদলে যায়। কমেন্টে প্রশংসা, ইনবক্সে মেসেজ-একটার পর একটা। কেউ দাম জানতে চাইছে, কেউ সংগ্রহ করতে আগ্রহ দেখাচ্ছে। অবাক হয়ে দেখলেন, মানুষ তার কাজ পছন্দ করছে, চায় তার তৈরি পণ্য। এরপরই আসতে থাকে অর্ডার। মাটি, বাঁশ ও বেত দিয়ে তৈরি প্ল্যান্ট-করোনার অবসর সময়েই শখের কাজ সংসারে সাহায্য করার মতো আয় দিতে শুরু করে।
ঠিক তখনই জন্ম নিল ‘ভূমি আর্টিজান’। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সিনিয়র আপুকে তিনি একটি অর্থবহ নাম দিতে বলেন। বাংলা ভাষায় পারদর্শী সেই আপু নাম দেন ‘ভূমি’। আর কারিগরদের সম্মান জানাতে যুক্ত করা হয় ‘আর্টিজান’। এভাবেই জন্ম হয় আজকের জনপ্রিয় ব্র্যান্ড ‘ভূমি আর্টিজান’-এর।
তবে শুরুটা এত সহজ ছিল না। যখন উদ্যোগের প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়ছিল, তখনই পরিবার চাপ দিতে শুরু করে চাকরি করার জন্য। বাধ্য হয়ে ধানমন্ডির একটি আর্কিটেক্ট ফার্মে যোগ দেন জান্নাতুল। কিন্তু মন পড়ে থাকতো ফেসবুকের সেই ছোট্ট ব্যবসাতেই। নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকা গিয়ে কাজ করা, আবার সন্তানকে সামলানো-সব মিলিয়ে একসময় ক্লান্তি আর মানসিক চাপ তাকে গ্রাস করে। তবুও তিনি টানা দেড় বছর চাকরি করেন। শেষমেশ সাহস নিয়ে চাকরি ছেড়ে দেন, আর ঠিক সেই সময়েই দাঁড়িয়ে যায় ‘ভূমি আর্টিজান’। চাকরি থেকে পাওয়া দেড় বছরের সঞ্চয় পুরোপুরিই বিনিয়োগ করেন নিজের ব্র্যান্ডে।
আজ ‘ভূমি আর্টিজান’ শুধুই একটি অনলাইন উদ্যোগ নয়-এটি একটি প্রতিষ্ঠিত হস্তশিল্প ব্র্যান্ড। নারায়ণগঞ্জের জালকুড়িতে রয়েছে এর তিনটি ওয়্যারহাউস। রয়েছে পাঁচজন স্থায়ী কর্মী এবং প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যুক্ত আরও ৩৪ জন দক্ষ কারিগর। বেকার যুবকদের কর্মসংস্থান তৈরি করতে পারা তার কাছে সবচেয়ে আনন্দের বিষয়।
জান্নাতুলের তৈরি মাটি, বাঁশ-বেতের পণ্যগুলোতে থাকে আন্তর্জাতিক নকশার ছাপ। হালকা ওজন, নান্দনিক ডিজাইন এবং হাতে তৈরি কারিগরির ছোঁয়া-সব মিলিয়ে পণ্যগুলো দ্রুতই ক্রেতাদের মন জয় করে। সাধারণ মাসে লাখ টাকার বেশি বিক্রি হয়; আর ঈদ, পূজা বা পহেলা বৈশাখে চাহিদা কয়েকগুণ বেড়ে যায়। অনেক ক্রেতাই বিদেশে উপহার হিসেবে তার পণ্য নিয়ে যান।
শুরুর দিকে পরিবারের কিছু সদস্য তার উদ্যোগ নিয়ে সমালোচনা করতেন। ‘মেয়েকে স্থপতি বানিয়ে লাভ কী হলো? এখন মাটির জিনিসপত্র বানায়!’- এই ধরনের কথায় মানসিকভাবে আঘাত পেলেও তা তাকে থামাতে পারেনি। বরং মনকে আরও শক্ত করেছে। আজ সেই সমালোচকরাই তার সাফল্যে বিস্মিত।
জান্নাতুলের সাফল্যের বড় অংশজুড়ে আছে তার মা এবং স্বামী সোহাগ হাসানের ভূমিকা। মা সবসময় ছায়ার মতো পাশে থেকেছেন, আর স্বামী উৎসাহ দিয়েছেন প্রতিটি সিদ্ধান্তে।
‘ভূমি আর্টিজান’ বর্তমানে সম্পূর্ণ অনলাইননির্ভর হলেও খুব শিগগিরই রাজধানীর ধানমন্ডির ‘ফ্রেন্ডশিপ কালার অব দ্য চর’-এ পাওয়া যাবে তাদের নির্দিষ্ট কিছু পণ্য। ভবিষ্যতে দেশ-বিদেশে নিজস্ব শোরুমের স্বপ্ন দেখেন জান্নাতুল।
তিনি মনে করেন, দেশের অগ্রযাত্রায় নারী-পুরুষ উভয়ের সমান অংশগ্রহণ জরুরি। নতুন উদ্যোক্তাদের তিনি উৎসাহ দিয়ে বলেন, ‘লেগে থাকতে হবে। মানুষের কথা শুনে থেমে গেলে চলবে না। আত্মবিশ্বাস আর পরিশ্রম-এই দুই-ই সাফল্যের আসল শক্তি।’ তার মতে, সহজ শর্তে ঋণ, ট্রেড লাইসেন্সের সুবিধা এবং সরকারি সহযোগিতা বাড়ানো গেলে নারী উদ্যোক্তার সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পাবে।
মাটি, নকশা, সৃজনশীলতা আর অধ্যবসায়ের মিশেলে এক লিভিংরুম থেকে শুরু হওয়া জান্নাতুল ফেরদৌসের ‘ভূমি আর্টিজান’ এখন হয়ে উঠেছে একটি সম্ভাবনাময় ব্র্যান্ড। আর তার গল্প হয়ে উঠেছে অনুপ্রেরণার এক উজ্জ্বল উদাহরণ-যেখানে শখ পরিণত হয়েছে পেশায়, আর স্বপ্ন বাস্তবে।