বাসস
  ০২ জুলাই ২০২৫, ১৮:০২
আপডেট : ০২ জুলাই ২০২৫, ১৯:৩১

জুলাই আমাকে একতা আর সংহতির অবিশ্বাস্য শক্তি ও সাহস দেখিয়েছে : মাহিন সরকার

মাহিন সরকার । ছবি : ফেসবুক

মোহাম্মদ আফজাল হোসেন তানভীর

ঢাকা, ২ জুলাই, ২০২৫ (বাসস): ২০২৪ সালের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখপাত্র নাহিদ ইসলামের জোরপূর্বক গ্রেপ্তারের পর রাষ্ট্রীয় বাহিনী কর্তৃক টেলিভিশনে জবরদস্তিমূলক স্বীকারোক্তি প্রদান করানোর পর নেতৃত্বশূন্য অবস্থায় জুলাই আন্দোলন সংকটের মুখে পড়ে। নেতৃত্বহীন অবস্থায় ছাত্র আন্দোলন যখন প্রায় দমে যাওয়ার পথে সেই ভয়াবহ সংকটকালে মাহিন সরকার সাহসিকতার সঙ্গে এই আন্দোলনের হাল ধরেন। 

শহীদ ও আহত সহযোদ্ধার ত্যাগ দেখে এই তরুণ তখনই হয়ে উঠলেন প্রতিরোধের এক মূল স্তম্ভ।

অকল্পনীয় চাপ আর গ্রেপ্তারের অব্যাহত হুমকির মুখেও ২৮ জুলাই থেকে নতুন করে ঝুঁকিপূর্ণ বিক্ষোভের ডাক দিয়েছেন মাহিন সরকার।

মাহিন সরকারের জন্ম ও পৈতৃক নিবাস সিরাজগঞ্জের বেলকুচিতে। তিনি সোহাগপুর এস কে পাইলট মডেল হাই স্কুল থেকে মাধ্যমিক আর ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক সম্পন্ন করেন। পরবর্তীতে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। বর্তমানে জাতীয় নাগরিক পার্টির একজন নেতা।

আন্দোলনে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মাহিন সরকার কীভাবে টিকে ছিলেন সেই অভিজ্ঞতা তিনি বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা বাসস এর কাছে। এখানে ছাত্রনেতা মাহিন সরকারের সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হল।

বাসস: একদম শুরুতে এটা ছাত্রদের সম্মান ও অধিকার বিষয়ক একটা আন্দোলন ছিল। পরবর্তীতে এটি সরকার বিরোধী আন্দোলনে রূপ নেয়। যারা হলে থাকে তাদের একটা মোটামুটি একটা কমন সমস্যা ছিল যে, আমাদেরকে একটা বলয়ের ভিতর থাকতে হতো। ওই সময়টাতে বলয়ের বাইরে গিয়ে বিপরীত সাইডে বা আন্দোলনে যাওয়াটা আপনার জন্য কেমন ছিল? আর কীভাবে এই আন্দোলনে সম্পৃক্ত হলেন?

মাহিন : জি, আন্দোলনে যাওয়াটা আসলে আমার জন্য খুবই চ্যালেঞ্জিং ছিল। কারণ আপনারা সবাই জানেন যে যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে তারা হলের ভিতরে কি পরিমাণ প্রতিকূলতা ফেস করে! ওই সময় আবার সব জায়গায় নিয়ন্ত্রণে ছিল ছাত্রলীগ। তো আন্দোলনে যুক্ত হওয়ার জায়গাটা ছিল তার আগের বছরের মোটামুটি শেষ ভাগে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সবাই মোটামুটি জানে যে ২০২৩ সালের নভেম্বরের দিকে একটি মুভমেন্ট হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সেন্ট্রাল লাইব্রেরীতে। সেই আন্দোলনের নেতৃত্বের জায়গায় আমি ছিলাম। তো সেখান থেকে কিভাবে একটা অধিকার আদায়ের আন্দোলন পরিচালনা করতে হবে এবং এই ধরনের সংগ্রামের একটা অভিজ্ঞতা আমার ছোটো পরিসরে হয়েছিল। তো সেই জায়গা থেকে পূর্বের ৫৬% কোটা ব্যবস্থা ফিরিয়ে এনে কোটার বিষয়টা যখন চাপিয়ে দেয়া হয়। এর বিরুদ্ধে আমরা তখন আন্দোলন শুরু করি।

আমার তখন পড়শোনা অনার্স শেষের দিকে ছিল। সেই জায়গা থেকে তো আমি চাকরির পূর্ণ প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। এমন সময়ে আসলো সেটা আমার ভেতরে একটা ক্ষোভ জাগ্রত করে।

আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা হলে থাকে প্রত্যেকেই মোটামুটি একটু দরিদ্র মধ্যবিত্ত পরিবারের। আর যাদের একটু অর্থ আছে তারা বাইরে আরেকটু উন্নত ব্যবস্থায় থাকে।

এইখানে যারা থাকত প্রত্যেকেই কিন্তু পেটের দায়েই হয়তো ছাত্রলীগের বিভিন্ন অন্যায় আবদার মেনেই থাকতে হত। সেই জায়গা থেকে যখন পেটের দায়ের প্রশ্ন আসে, সেখানে কিন্তু সবাই এক এবং ঐক্যবদ্ধ হয়। তারাই মূলত আমাকে সর্বাত্মক সহায়তা করেছে এবং আমার যারা বন্ধু, ছোট ভাই, বড় ভাই প্রত্যেকেই আমাকে অভয় দিয়েছে যে, ‘মাহিন এগিয়ে যাও। আমরা সবাই তোমার সাথে আছি। তুমি তোমার মত কাজ চালিয়ে যাও।’

আর এর পাশাপাশি একটা অংশ ছিল যারা হলো ছাত্রলীগের বিদ্রোহী অংশ। পরবর্তীতে ১৫ই জুলাই এর পরে তারা মোটামুটি সবাই পদত্যাগ করে। তারা পিছন থেকে আমাকে সব ধরনের সহায়তাই করেছিল। তারাআমাকে বলত যে,  তুমি এগিয়ে যাও। আমরা হয়তো ছাত্রলীগে আছি, কিন্তু তোমাকে কোনোভাবে কোনো বাধা দেওয়া হবে না।
তো সবকিছু মিলিয়ে আসলে আমার পেছনে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেকের সমর্থন ছিল। সেই জায়গা থেকে আমি আসলে এই আন্দোলনে যুক্ত হতে পেরেছি এবং এগিয়ে যেতে পেরেছি।

বাসস: জুলাই মাসে যখন নতুনভাবে আবার আন্দোলন শুরু হয়। ছাত্ররা অবশ্যই সম্পূর্ণ ক্লাস বয়কট করে। ওই সময়টাতে আসলে আপনার ভূমিকা কেমন ছিল?

মাহিন: তখন শিক্ষকদের একটা সর্বত্মক কর্ম বিরতি চলছিল পেনশন সম্পর্কিত একটি দাবি নিয়ে। কিন্তু ওই মুহূর্তে যেহেতু আন্দোলন শুরু হয়ে গেছে এবং আন্দোলনে বেশ বিপুল জনসমাগম হচ্ছিল তখন কিন্তু শিক্ষার্থীরা আর ক্লাসে ফিরে যেতে চায়নি এবং বৈষম্য বিরোধীর পক্ষ থেকে আমাদের প্রত্যেকের আহ্বান ছিল যে, প্রত্যেকটি ডিপার্টমেন্ট যেন আমাদের সাথে সম্মতি প্রকাশ করে তাদের জায়গা থেকে ক্লাস পরীক্ষা বর্জন করে। এক দুইটি ডিপার্টমেন্ট য়খন ক্লাস পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণা দেয়, তার দেখাদেখি কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল ডিপার্টমেন্টও একই ঘোষণা দেয়।

আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যখন ক্লাস পরীক্ষা বয়কটের ঘোষণা দেয়া শুরু করে তখন কিন্তু সারা বাংলাদেশের সকল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি স্কুল পর্যায়েও এই স্ট্রাইক ছড়িয়ে পরে। সেই জায়গা থেকে আসলে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন সবসময়ই চেষ্টা করেছে ঢাকার মধ্যে যারা আছে, তাদের সাথে ফিজিকালি বসার জন্য এবং  বসেছেও। আর বিভিন্ন সময় আমাদের ক্যাম্পাসে আন্দোলনকারী পরিচয়ে তারা এসেছে। এর পাশাপাশি আমাদের পক্ষ থেকেও প্রতিনিধিরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে কলেজে গিয়েছে। কিন্তু যেখানে যাওয়া সম্ভব হয় না সেখানে আমরা ইন্টারনেটের মাধ্যমে, মোবাইলের মাধ্যমে তাদের সাথে আমরা কানেক্ট হয়েছি।

বাসস: আচ্ছা, যখন আন্দোলন একটা সহিংস পর্যায়ে চলে যায় তখন আপনি কি শঙ্কার মধ্যে ছিলেন?

মাহিন: আন্দোলন যখন সহিংস পর্যায়ে চলে গিয়েছিল, তখন আসলে তার প্রস্তুতি আমাদের আগে থেকেই ছিল যে এমন কিছু হতে পারে। কিন্তু যেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আক্রমণ হয় তার আগের দিন মানে ১৪ জুলাই, সেদিন আমাদের একটি কর্মসূচি ছিল, আমরা রাষ্ট্রপতির কাছে একটি স্মারকলিপি দিতে গিয়েছিলাম। সেদিন যখন আমরা কর্মসূচিতে ছিলাম ওই সময় ওসমানি মিলনায়তনে শেখ হাসিনা এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে 

আমাদেরকে রাজাকারের নাতিপুতি বলে মন্তব্য করেন। তখন সংঘাত অনিবার্য হয়ে যায় এবং তারই প্রতিফলন আমরা দেখেছি সেদিন অর্থাৎ ১৪ জুলাই রাতে।

সেদিন রাতে ঢাকা মহানগরের যারা ছাত্রলীগের নেতাকর্মী সবাই কিন্তু এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আশেপাশের এলাকায় অবস্থান নিয়েছিল। এবং তার পাশাপাশি ঢাকা শহরের যে তৎকালীন মেয়র থেকে শুরু করে ঢাকার বিভিন্ন আসনের যারা এমপি তারা কিন্তু প্রত্যেকে এইখানে তাদের কর্মী সমাবেশ বা সেই টাইপে একটা মিটিং করেছিল। এবং তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আক্রমণ করতে চেয়েছিল। কিন্তু সেদিন ১৪ জুলাই তারিখে রাতে, অর্থাৎ ১৫ জুলাই এর প্রথম প্রহরে আপনি হয়তো জেনে থাকবেন যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারা বাংলাদেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আরেকটি ছোট্ট উম্মাদনা তৈরি হয় শেখ হাসিনার একটি কথাকে ঘিরে। সবাই প্রতিবাদী সুরে তুমিকে আমিকে রাজাকার রাজাকার স্লোগানে ফেটে পরে।

বাসস: যখন বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের কর্মসূচিগুলো দেয়া হতো তখন প্রত্যেকটা হল থেকে আলাদা আলাদা মিছিল বের হতো। তো ওই সময়টাতে আসলে আপনি আপনি কি ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হন? যেহেত ুহলের কোঅর্ডিনেশন আপনার করা লাগতো!

মাহিন: জিয়া হলে আমি জুলাই মাসের ২ তারিখে একটি মিছিল করি। সেটি রাজু ভাস্কর্যের সামনে গিয়ে শেষ হয় এবং সেখানে আমরা অবস্থান কর্মসূচি চালাই। সেখানে উপস্থিত ছিল তিনশো থেকে চারশো জন শিক্ষার্থী। সেদিন মিছিল শেষে, হলের যারা ছাত্রলীগের পোস্টেড সদস্য এবং সম্ভাব্য হল ক্যান্ডিডেট, তারা আমাকে ফোন করে। তারা আমাকে ডেকে নিয়ে হুমকি দেয় যে, আমার সিট ক্যানসেল করে দেবে এবং আমাকে হল থেকে বের করে দেবে। আমি তাদের ভদ্রভাবে বলি, ‘দেখুন, এটি এক বা দুইজনের আন্দোলন নয়। আমি না থাকলেও এই আন্দোলন চলবে। সবাই আমার ডাকে আসছে এমনটি নয়।’

তবে এই হলপাড়ায় ছাত্রলীগের একটি অংশ চেষ্টা করেছিল আমাকে দূরে সরিয়ে দেওয়ার। যদিও তারা সংখ্যায় খুব বেশি ছিল না, তবে তারা বয়সে কিছুটা সিনিয়র হওয়ায় এই কাজ করতে পেরেছে। সেই অবস্থান থেকেও আমি কিছু শিক্ষার্থীর সর্বাত্মক সহায়তা পেয়েছিলাম বলেই হলে থেকেই আন্দোলন পরিচালনা করতে পেরেছি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিল, তাদের মধ্যে মাত্র দুুতিনজন ছিল যারা হলে থাকত। তাই এই দায়িত্ব আমার কাঁধেই এসে পড়ে এবং আমাকে ঝুঁকি নিতেই হয়। তবে সর্বাত্মক সহায়তা পাওয়ায় আমি অতটা সমস্যায় পড়িনি।

তবে, যখন আন্দোলন ধীরে ধীরে সংঘাতমুখী হতে লাগল, তখন বিজয় একাত্তর হলের গার্ডেন থেকে আমাকে ধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়া হয়। এরপর জসিম উদ্দিন হল থেকেও একইভাবে বের করে দেওয়া হয় এবং আমাকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করা হয়। এফ রহমান হলে আমার কলার ধরে টানা-হেঁচড়া করা হয়। জহুরুল হক হলে ছাত্রলীগ সদস্যরা ক্রমাগত পাথর ও ইট নিক্ষেপ করে। ফলে আমি বাধ্য হয়ে সেখান থেকে মাইক নিয়ে সরে আসি। জগন্নাথ হলে আমাকে মাত্র সাত সেকেন্ড সময় দেওয়া হয় হল ছাড়ার জন্য, না হলে আমাকে মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হয়। সব মিলিয়ে একটি অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং পরিবেশ ছিল। যদিও হলে সাধারণ শিক্ষার্থীরা পাশে না দাঁড়ালে এটা সম্ভব হতো না।

বাসস: আপনি বললেন যে, বিভিন্ন হল থেকে আপনাকে বের করে দেওয়া হয়েছিল। এটা কি বিভিন্ন সময়ে হয়েছে, নাকি একসাথে?

মাহিন: বিভিন্ন সময়ে, হ্যাঁ। বিশেষ করে যখন আন্দোলন সংঘাতের দিকে এগোচ্ছিল, তখন। বাংলা ব্লকেড আন্দোলন যখন চলছিল, তখন থেকেই হুমকির সূত্রপাত। কারণ ছাত্রলীগ বুঝতে পারছিল যে সরকার এই আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। তাই তারা স্বাভাবিকভাবেই আমাদের মুখোমুখি হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এই আভাস পাওয়ার পর থেকেই তারা আগ্রাসী হয়ে ওঠে, হুমকি দিতে শুরু করে এবং শেষ পর্যন্ত আমার ওপর হামলা চালায়।

বাসস : সতেরো তারিখে ক্যাম্পাস বন্ধ হয়ে যায়। আমরা যারা হলে থাকতাম, তাদের তো একমাত্র আশ্রয়স্থল ছিল হল। ওই সময় হল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর আন্দোলন কীভাবে পরিচালনা করলেন? কোথায় থাকতেন ঢাকায়? নিরাপত্তার তো একটা বড় প্রশ্ন ছিল, যেকোনো সময় ধরে নিয়ে যেতে পারত বা হামলা হতে পারত। তখন বিভিন্ন জায়গায় ব্লক রেইড হতো, ধরে নিয়ে যেত। ছাত্রলীগ ও যুবলীগের লোকজন পয়েন্টে পয়েন্টে দাঁড়িয়ে থাকত। সেই সময় আপনি কীভাবে টিকে ছিলেন?

মাহিন: ১৫ই জুলাই যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আক্রমণ হয়, তখনই আমি হলে না থেকে বাইরে চলে যাই এবং সেদিনই মিরপুরে চলে যাই। সেখানে এক বন্ধুর মামার বাসায় উঠার কথা থাকলেও সে লোকেশন ভালোভাবে চিনত না। তার ওখানে জীবনে মাত্র একবারই গিয়েছিলাম। ফলে আমরা ১৫ জুলাই রাতটা মূলত রাস্তায় কাটাই। ১৬ জুলাই কোটা আন্দোলনের একাত্তর এক দফার মধ্যে প্রথম দফা ছিল—শেখ হাসিনাকে দুঃখ প্রকাশ করতে হবে এবং দায় স্বীকার করতে হবে। এই বিষয় নিয়েই একটি বিতর্ক তৈরি হয়। অনেক সমন্বয়ক বলছিলেন, ‘আমরা তো কোটার দাবিতে আন্দোলন করছি, সেটা যদি মানা হয়, তাহলে আর কিছু চাওয়ার দরকার নেই।’ তবে আমাদের অবস্থান ছিল ভিন্ন—এটা শুধুই কোটা সংস্কার নয়, এটা এক ধরনের গণহত্যা।

এরপরের সময়গুলোতে আমি মিরপুরে ছাত্রদের একটি মেসে আশ্রয় নিয়েছিলাম। ছাত্ররা সব সময় আমার নিরাপত্তার কথা চিন্তা করত এবং নিরাপত্তাবলয় ও সেইফ এক্সিটের ব্যবস্থাও করেছিল যাতে পুলিশের হাতে না পড়ি।

বাসস: ১৭ তারিখের ইন্টারনেট শাটডাউন হয় এবং এর পর যখন নাহিদ ইসলামকে গ্রেফতার করা হয় তখন আপনারা কী ভেবেছিলেন?

মাহিন: এই সময়ে আন্দোলন কার্যত নেতৃত্বশূন্য হয়ে পড়ে। বিশেষত যখন নাহিদ ইসলামকে তুলে নেওয়া হয়, তখন আমরা দিশেহারা হয়ে যাই। ইন্টারনেট বন্ধ, ফোন চালু করলে ট্র্যাকিংয়ের সম্ভাবনা—সবকিছু মিলে সেই সময়টা ছিল ভীষণ সংকটময়। তখন আমরা গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালকে আমাদের যোগাযোগকেন্দ্র বানাই এবং জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যারা আসতে পেরেছিলাম, তারা সেখানেই মিটিং করে পরবর্তী কর্মসূচি নির্ধারণ করি।

এই সময়েই আমরা প্রথমবারের মতো প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করি। এর আগে তারা পৃথকভাবে আন্দোলনে অংশ নিলেও সরাসরি আমাদের সঙ্গে যুক্ত ছিল না।

বাসস: শাটডাউনের সময় শিক্ষার্থীদের সাথে কীভাবে আপনারা সমন্বয় করেছেন?

মাহিন: তাদের অনেক প্রতিনিধি আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল। তবে পূর্ণাঙ্গ সংযুক্তি তখনো হয়নি। এরপর বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দায়িত্বপ্রাপ্তরা বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে অবস্থান করলেও যার যেখানে আশ্রয় ছিল, সেখানে স্থানীয় শিক্ষার্থীদের সংগঠিত করার চেষ্টা চালায়। আমি যখন ১৭ জুলাই আবার মিরপুরে আশ্রয় নিই, তখন সেখানে থাকা শিক্ষার্থীরা আমাকে রক্ষা করে। যাতে গণগ্রেপ্তারের সময় আমি ধরা না পড়ি, সেজন্য তারা তাদের মেসে আশ্রয় দেয়।

আমরা ছাত্র শিবির, ছাত্রদলসহ অন্যান্য রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনের সঙ্গেও যোগাযোগ করি যেন আমাদের সেফ এক্সিটের ব্যবস্থা করা যায়। রিফাত রশিদ, আব্দুল হান্নান, মাসুদ এবং আব্দুল কাদের—আমরা কয়েকজন ছিলাম গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে। নাহিদ ইসলাম আগে থেকেই আমাদের সতর্ক করেছিল এবং পূর্বপরিকল্পনা জানিয়ে রেখেছিল।সেজন্য আমরা মানসিকভাবে কিছুটা প্রস্তুত ছিলাম।

কিন্তু যখন তাকে জোরপূর্বক বিবৃতি দিতে বাধ্য করা হয় এবং ভিডিওতে ছয়জন সমন্বয়ক সারিবদ্ধ বসে থাকে, তখন আমরা হতভম্ব হয়ে পড়ি। আমরা তিনজন একসঙ্গে ছিলাম—ভীষণভাবে ভেঙে পড়ি, কাঁদতে থাকি। শুধু নিজেদের জন্য নয়, আমাদের পরিবার নিয়ে চিন্তিত ছিলাম। আমরা জানতাম, যদি পিছু হটি, তবুও বাঁচব না। ফলে আমাদের সামনে কোনো বিকল্প ছিল না।

তারপর আমরা একটি রুদ্ধশ্বাস মিটিং করি, সেদিনকার সব সাংবাদিকদের জানিয়ে দিই যে সামনে কঠিন কর্মসূচি আসছে। ২৮ জুলাই থেকে ৩ আগস্ট পর্যন্ত আমরা মাঠ পর্যায়ের নেতৃত্ব দিই, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যোগাযোগ করে কর্মসূচি নির্ধারণ করি। এই সময়টা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং ‘গেম চেঞ্জিং’ মুহূর্ত।

২৮ জুলাই সন্ধ্যার পর নাহিদ ইসলামের স্টেটমেন্ট যখন ছড়িয়ে পড়ে, তখন দেশের মানুষ বুঝে যায় এটা নাটক। তবে সরকার সবাইকে বাধ্য করেছিল তা স্বীকার করতে।

বাসস: আন্দোলনের সময় কি ধরণের চাপের মধ্য দিয়ে গিয়েছেন?

মাহিন: ১৭ তারিখ বিকেলের দিকে যখন হল ফাঁকা হতে থাকে, তখন আমি একটি কল পাই। ধরার পর জানতে পারি, একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা আমাকে ফোন করেছেন। তিনি বলেন, ‘মাহিন, আমি তোমার বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক বড় ভাই। তুমি আমার সাথে বসো, তোমার যা যা দরকার—সরকার তোমাকে সব দেবে।’

তিনি বলেন, ‘তুমি তো অনেক কষ্ট করছো। হলে হলে গিয়ে মাইকিং করে সবাইকে নিয়ে আসছো। তোমার ফেইস হওয়া দরকার। ফেইস তখনই হওয়া যাবে যখন উপরের পর্যায় থেকে বলা হবে যে, ‘ওকে হাইলাইট করো।’

আমি তখন বলি, ‘আমি এখন পর্যন্ত কোনো গোয়েন্দার সাথে বসিনি, বসবও না। কারণ আপনারা সরকারকে সার্ভ করেন, আমাদের নয়। আপনারা যদি এই আন্দোলন নষ্ট করেন, তাহলে হয়তো র‌্যাংক পাবেন, পুরস্কৃত হবেন। কিন্তু ইতিহাস আমাকে ডাকছে, আমি সেই ডাক ফেলতে পারি না।’

তিনি বলেন, ‘এক ঘণ্টা সময় দিচ্ছি, ভেবে দেখো।’ আরও বলেন, “তোমার কোনো কষ্ট থাকবে না, পরিবারকে সব দেবে সরকার। রাজনৈতিক হোক বা অরাজনৈতিক—সবই পাবে।’ আমি স্পষ্টভাবে সেটা প্রত্যাখ্যান করি।
এরপর আমার বাবার কাছে ফোন যায়—মাহবুবুল আলম হানিফ ফোন করে বলেন, ‘আপনার ছেলেকে থামান, না হলে বিপদে পড়বে।’ আব্বু খুব ভয় পেয়ে যান। পরিবার থেকে বারবার ফোন আসে। বাধ্য হয়ে একটি ফোন ধরি, পরিবারের সবাই কান্নাকাটি করে দেখা করতে চায়।
আমি তখন থেকে ফোন বন্ধ রাখি। কারণ আমি পরিবারের একমাত্র ছেলে, আমার একটি ছোট বোন আছে। ছাত্রলীগের কিছু সদস্য তখন আমার বোন সম্পর্কেও অশালীন মন্তব্য করে। আমার পরিবার তখন চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিল।

বাসস : এইযে এতকিছুর পর আজকের এই অবস্থানে এসে আপনার অনুভূতি কী?

মাহিন : আমার পরিবারের জন্য ভয়, সহিংসতা আর নিপীড়নের মানসিক আঘাত, শহীদ বা আহত বন্ধু, এই বোঝাগুলো এখনো আমি বহন করি। এসব আমাকে তাড়া করে বেড়ায়। এই আন্দোলন আমাকে একতা আর সংহতির অবিশ্বাস্য শক্তি  ও সাহস দেখিয়েছে।

এই আন্দোলনে শুধু সরকারের পতনই ঘটায়নি, এটি চিত্রপট বদলে দিয়েছে। এটি প্রমাণ করেছে যে, প্রতিরোধের চেতনা, ন্যায়বিচার আর মর্যাদার দাবিকে লাঠি, গুলি বা জবরদস্তিমূলক স্বীকারোক্তি দিয়ে দমানো যায় না। এটাই তার স্থায়ী উত্তরাধিকার। আমরা রাজাকারের নাতি নই, আমরা তাদের নাতি যারা ইতিহাস জুড়ে স্বাধীনতা আর ন্যায়বিচারের জন্য লড়েছে।