শিরোনাম
ফারাজী আহম্মদ রফিক বাবন
নাটোর, ১ জুলাই, ২০২৫ (বাসস) : দেওয়ালের ক্যানভাস জুড়ে নবজাগরণের গ্রাফিতি। জুলাই গণঅভ্যুত্থান উত্তর সময়ে শত শিক্ষার্থীদের আঁকা এসব গ্রাফিতির ভাষা যেন একই। শহিদ আবু সাঈদের চির উন্নত মম শির, কারবালা প্রান্তরে মুগ্ধর ছুটে চলা, আর আছে কাজী নজরুলের দ্রোহের আগুন।
৩৬ জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর নাটোর শহরে যেন নতুন জাগরণ তৈরি হয়। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের মধ্যে তৈরি হয় মেলবন্ধন। ১০ আগস্ট তারা ছড়িয়ে পড়ে শহরময়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দেওয়ালগুলো রংতুলির আঁচড়ে জীবন্ত হয়ে ওঠে। জাতীয় জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়কে ধারণ করা এসব গ্রাফিতি যেন তুলির আঁচড়ে নয়, হৃদয়ের তুলিতে আঁকা।
শহরের নবাব সিরাজ-উদ্দৌলা সরকারি কলেজের দেওয়াল জুড়ে আঁকা হয়েছে অর্ধ শতাধিক ছবি। এসব গ্রাফিতির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘৩৬ শে জুলাই’, ‘দড়ি ধরে মারো টান, রানি হবে খান খান’, ‘প্রতিরোধের আগুন জ্বালো’, ‘শেকল ভাঙার গান’, ‘স্বাধীনতা এনেছি সংস্কারও আনবো’ ইত্যাদি। যেন বিদ্রোহের আগুনে জ্বলজ্বল করছে এসব দেওয়াল লিখন।
নাটোর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের দেওয়ালে ত্রিশের অধিক গ্রাফিতির মধ্যে নজর আটকে যায়,‘বিকল্প কে? তুমি আমি আমরা’ গ্রাফিতিটিতে। অর্থাৎ রাষ্ট্র ব্যক্তি নির্ভর নয়, সামষ্টিক বিষয়।
নাটোর সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের দেওয়ালে প্রায় বিশটি গ্রাফিতির মধ্যে বেশিরভাগই ইংরেজিতে লেখা। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য, ‘ইউনিটি ইজ স্ট্রেনথ’, ‘ইউনাইটেড উই রাইজ, ডিভাইডেড উই ফল’, ‘উই আর ওয়ান’। আরো আছে ‘কারো বাপের প্রয়োজনে এখানে আসিনি’। তবে লাল জমিনে লেখা ‘জুলাই স্কাই’ গ্রাফিতিটিতে যেন বেদনা ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
এই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শোয়াইব রানা গণঅভ্যুত্থানের সময় রাবার বুলেটে আহত হন। তিনি শরীরে সাতটি স্প্রিন্টার বহন করে চলেছেন। ব্যথায় কাতর শোয়াইব তবুও অংশ নেন গ্রাফিতি তৈরির আনন্দ আয়োজনে।
বাসসের সাথে আলাপকালে শোয়াইব রানা বলেন, এখন থেকে আমরা আলোর পথের যাত্রী, আর পিছনে ফিরে যাব না।
মহারাজা জগদিন্দ্র নাথ উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের দেওয়ালে আঁকা হয়েছে ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’, ‘আমি দুর্বার, আমি ভেঙে করি সব চুরমার’, ইঞ্চি ইঞ্চি মাটি, সোনার চেয়ে খাঁটি,’ ‘এই বাংলা তোমার আমার, কোন শোষকের নয়’ । এখানে কাজী নজরুল যেন বিপ্লবের শাশ্বত প্রতীক।
রাণী ভবানী সরকারি মহিলা কলেজের দেওয়াল লিখন; ‘নাম আমার জনগণ, আমিই বাংলাদেশ’, ‘আসছে ফাল্গুনে আমরা হবো দ্বিগুণ শতগুণ’ ইত্যাদি শ্লোগান। এসব স্লোগানে জনতার জয়ধ্বনি প্রতিফলিত হয়েছে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাড়াও প্রায় অর্ধশত ছবি আঁকা হয়েছে নাটোর রেল স্টেশনের প্লাটফর্মের দেওয়াল জুড়ে। রেল স্টেশনের প্লাটফর্মের গ্রাফিতি তৈরি করেছে পাবলিক ইউনিভার্সিটি স্টুডেন্ট’স অ্যাসোসিয়েসন অব নাটোর (পুসান) এর শিক্ষার্থীরা। এসব গ্রাফিতির মধ্যে উল্লেখযোগ্য, ‘বুকের ভেতর দারুণ ঝড়, বুক পেতেছি গুলি কর’, ‘পানি লাগবে পানি’, ‘মৃত্যু নয়, মুক্তি চাই’, ‘হাসিনার কান্না আর না আর না’, ‘অফ দ্যা পিপল, বাই দ্যা পিপল, ফর দ্যা পিপল’। দেশের একাধিক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে এই দেওয়ালের গ্রাফিতি দৃষ্টিনন্দন।
মাধ্যমিকে পড়া ছোট বোনকে নিয়ে গ্রাফিতি অঙ্কনে অংশগ্রহণকারী চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জান্নাতুল ফেরদৌস টুম্পা বলেন, এসব দেওয়াল লিখন তো রংতুলিতে লেখা নয়, হৃদয় দিয়ে লেখা। স্বাধীনতার আনন্দ অনুভূতির মূর্ত প্রকাশ।
নাটোরের বিশিষ্ট সংগঠক এবং চারুশিল্পী আবুল আসিফ মার্শাল বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নাটোরের দেওয়াল জুড়ে শত শত গ্রাফিতি তৈরি করা হয়েছে। এসব গ্রাফিতির শিল্প মূল্যের চেয়ে নতুন প্রজন্মের অনুভূতির প্রকাশ অনন্য। এসব অনুভূতি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে যাবে, হবে কালোত্তীর্ণ।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র উপদেষ্টা ও ফোকলোর বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. আমিরুল ইসলাম বলেন, যেসব শিক্ষার্থী কখনো ছবি আঁকেনি, যেসব শিক্ষার্থী কখনো রাজপথে স্লোগান দেয়নি, তারাই দেওয়ালে দেওয়ালে গ্রাফিতি অঙ্কন করেছে। তাদের বঞ্চনার প্রকাশ ও বিদ্রোহের ভাষা অনন্য। এই কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে যে নতুন শিল্পীসত্তা তৈরি হয়েছে তা নিয়ে গবেষণা হতে পারে।