শিরোনাম
ওসমান গণি রাসেল
ঢাকা, ১ জুলাই, ২০২৫ (বাসস) : আন্দোলনের সূতিকাগার বলা হয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়কে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ যেকোন অনিয়ম কিংবা জাতীয় যেকোন ইস্যুতে সবসময়ই সরব ও প্রতিবাদী ভূমিকা পালন করে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এরই ধারাবাহিকতায় কোটা সংস্কার আন্দোলন এবং পরবর্তীকালে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে নিজেদের জীবন বাজি রেখে লড়াই করেছিলো এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। ২৪ এর গণঅভ্যুত্থানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়কে অভিহিত করা হয়েছিলো আন্দোলনের ‘পাওয়ার হাউস’ নামে। ২৪ এর গণঅভ্যুত্থানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্মুখ সারিতে অবস্থান নিয়েআন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ৪৭ ব্যাচের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষার্থী আরিফ সোহেল। নোয়াখালী জেলার সেনবাগ উপজেলার আবুল খায়ের ও আকলিমা বেগম দম্পতির সন্তান আরিফ সোহেল।
আরিফ সোহেল আন্দোলন চলাকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম প্রধান সমন্বয়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তার মেধাবী ও সাহসী নেতৃত্ব শিক্ষার্থীদের সুসংগঠিত করে আন্দোলনকে বেগবান করেছিলো। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলন দমন করতে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা তাকে আটক করে গুম করেছিলো। তবুও দমে যাননি তিনি। আন্দোলন পরবর্তী সময়ে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শাখার আহবায়ক ও কেন্দ্রীয় সদস্য সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমানে তিনি নবগঠিত রাজনৈতিক দল এনসিপির যুগ্ম সদস্য সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
সম্প্রতি তিনি বাসসের সাথে এক সাক্ষাতকারে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে তার সার্বিক অভিজ্ঞতার নানা দিক তুলে ধরেছেন।
বাসস : জুলাই গণঅভ্যুত্থানের এক বছর পূর্ণ হলো। সেই সংগ্রামী সময়গুলো কি এখনো অনুভব করতে পারেন?
আরিফ সোহেল : জুলাইয়ে যে অনুভূতির ভেতর দিয়ে আমরা গিয়েছি সেটা অনন্য এবং জীবনের অন্যতম অসাধারণ কিছু স্মৃতি। এখনো তার অনুপ্রেরণা আমরা অনুভব করি যখন দেখি দেশ এগিয়ে যাচ্ছে কিংবা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জুলাই বিপ্লবের পক্ষে কাজ করে যাচ্ছে। অথবা যখন আমরা জনগণের মধ্যে ঐক্য দেখি যা আমরা ৫ আগস্টের পর প্রথম দেখেছিলাম বন্যার সময়।
পরবর্তী সময়ে এই ঐক্য আমরা লক্ষ করেছি বৈদেশিক আগ্রাসনের সময়। আমরা দেখেছি এই ঐক্যের বলে বলিয়ান হয়েই সীমান্তে একজন কৃষক সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সাথে দাঁড়িয়ে গেছেন সীমান্ত রক্ষা করার জন্য। তখন আমাদের জুলাইয়ের অনুভূতিগুলো বার বার ফিরে আসে।
আবার যখন আমরা দেখি যে এ দেশের সরকার কিংবা সমাজের কোন উপাদান জুলাই বিপ্লবের চেতনা থেকে দূরে সরে গেছে তখন আমাদের খারাপ লাগে। তখন মনে হয়, যে অনুভূতির মধ্য দিয়ে আমরা জুলাই পার করেছি সেটা এতটা ক্ষণস্থায়ী কিনা। তবে আমরা এখনো আশা রাখি যে আমরা জুলাইয়ের সেই চেতনাকে টিকিয়ে রাখতে পারবো।
বাসস : জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সূত্রপাত কিভাবে হয়েছিলো?
আরিফ সোহেল : জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এর পূর্বেও আমাদের কোটা সংস্কার আন্দোলনের অভিজ্ঞতা ছিল। আমরা জানতাম যে আন্দোলনে বাধা আসবে। সেই জায়গা থেকে আমরা মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলাম সরাসরি প্রতিরোধ করার জন্য। ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনে আমরা সেটা করতে পারিনি।
২০২৪ সালের ৫ জুন হাইকোর্ট কোটা বাতিলের প্রজ্ঞাপনটি অবৈধ ঘোষণা করে। পুনরায় কোটা ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনলে সারাদেশের শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠে। ৬ জুন থেকে পুনরায় কোটার যৌক্তিক সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্রেক্ষিতে ১৫ জুলাই ছাত্রলীগ দেশের বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনকারীদের ওপরহামলা শুরু করে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে তারা ন্যাক্কারজনক ভাবে হামলা করেছিলো আমাদেরকে হত্যার উদ্দেশ্যেযখন আমরা উপাচার্যের বাসায় আশ্রয় নিয়েছিলাম।
তারপরই অভূতপূর্ব একটা প্রতিরোধের ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছিলো। জাহাঙ্গীরনগরের সকল হল থেকে সকল শিক্ষার্থীরাস্তায় নেমে আসে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে। সন্ত্রাসী ছাত্রলীগকে ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত করে ক্যাম্পাসকে মুক্ত করে।
এর ফলশ্রুতিতে, পরবর্তী সময়ে যে বৃহৎ জায়গা থেকে আমরা আন্দোলনটা শুরু করেছিলাম সত্যিকার অর্থে সেই জায়গাটায় আন্দোলনটা পৌঁছে গেল এবং জনগণ আন্দোলনে সংযুক্ত হয়ে গেলো। বৈষম্য বিরোধী একটা সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে তখন আন্দোলনটা সামনের দিকে এগিয়ে যায়।
বাসস : কোটা সংস্কার আন্দোলন যে স্বৈরাচার পতনের আন্দোলনে রূপ নেবে এটা কি আপনারা আগে থেকে জানতেন?
আরিফ সোহেল : নাহ এটা আমরা সচেতনভাবে জানতাম না। কিন্তু অবচেতনভাবে জানতাম। কারণ একটা সমাজের রাজনৈতিক পরিবর্তনের জন্য ভবিষ্যত সম্পর্কে অনুমান করতে পারাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
২০২৪ এর গণঅভ্যুত্থান বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। নিরাপদ সড়ক আন্দোলন থেকে শুরু করে বর্তমান প্রজন্মের সকল আন্দোলনই ছিলো দেশের স্বৈরাচারী সিস্টেমের বিরুদ্ধে।
নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে দেশের স্কুল কলেজের সকল শিক্ষার্থী রাস্তায় নেমে এসেছিল। ঢাকা শহরের সবখানে আমরা শিক্ষার্থীরা অবস্থান নিয়েছিলাম। কিন্তু পরবর্তী সময়েকি হলো? বড় কোন সংস্কার ছাড়াই আমাদেরকে ফিরে আসতে হলো। আমরা কিন্তু দেশটা সংস্কার করতে পারলাম না।
রাষ্ট্র সংস্কারের একটা সুপ্ত চাওয়া সবার মধ্যে বিরাজমান ছিলো। যার প্রেক্ষিতে ২৪ এর কোটা সংস্কার আন্দোলন সময়ের পরিক্রমায় স্বৈরাচার পতন আন্দোলনে রূপ নিয়েছিলো।
বাসস : শুরুতে ক্যাম্পাসে আন্দোলন অহিংস থাকলেও কিভাবে সহিংসতায় রূপ নিলো?
আরিফ সোহেল : সহিংসতা শুরু করেছিলো ছাত্রলীগ। ১৪ ই জুন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের রাজাকার বলে সম্বোধন করে। তখন বিভিন্ন ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীরা বিক্ষুব্ধ হয়ে ‘আমি কে, তুমি কে, রাজাকার রাজাকার’ বলে স্লোগান দেয়। সেদিন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের এক আন্দোলনকারীকে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা আটকে রেখে নির্যাতন করে।
১৫ তারিখে আমরা যখন খবর পাচ্ছিলাম যে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ শান্তিপূর্ণ আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করছে। আমরা তার প্রতিবাদে একটা মিছিল ডাকি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্ট্রাল লাইব্রেরী থেকে তখন আমাদের মিছিলগুলো শুরু হতো। তাই সেদিনও ওখানে আমরা সমবেত হই।
ঐ সময় আমাদের কাছে খবর আসে, ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে বলা হয় কিছু নির্দিষ্ট স্লোগান না দিলে তারা আমাদের ওপর হামলা করবে না। তারা আমাদের কিছু শর্ত দেয় এবং মিছিল করার স্থান নির্দিষ্ট করে দেয়। সে শর্তগুলো মানা হলে মিছিল করতে দেয়া হবে বলে জানায় তারা।
তখনই আমরা বুঝতে পেরেছিলাম, ছাত্রলীগ হামলা করবে। তারা প্রস্তুতি নিচ্ছে। তাদের শর্ত তখন কোনভাবেই মেনে নেওয়ার প্রশ্নই আসে না। আপোস করার প্রশ্নই আসে না। আমরা তখন আন্দোলন চালিয়ে যাই এবং আমরা মিছিল অব্যাহত রাখি। সেই মিছিল বঙ্গবন্ধু হলের সামনে পৌঁছালে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা আমাদের ওপর হামলা শুরু করে। এভাবেই আন্দোলন সহিংসতায় রূপ নিয়েছিলো।
বাসস : কোটা সংস্কার আন্দোলনে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ কেমন ছিলো?
আরিফ সোহেল : ২৪ এর আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের সর্বাত্মক অংশগ্রহণ ছিলো। এই আন্দোলনটা অন্যান্য আন্দোলনের চেয়ে ইউনিক ছিলো। এই আন্দোলনে আমরা শুধু কোটা সংস্কার নয়, সামগ্রিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছিলাম।
২৪ এর আন্দোলনে আমাদের একটা সংগঠিত শক্তি ছিলো। আমাদের প্রত্যেকটা হলে কিছু জনবল ছিলো। ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলন এতটা সংগঠিত অবস্থায় ছিল না। ২০১৮ সালে যখন ছাত্রলীগের সাথে সংঘর্ষ হয় তখন কিন্তু এতটা সংগঠিত অবস্থায় কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা ছিল না। তখন ব্যক্তি পর্যায়ে কিছু নেতৃত্ব তৈরী হয়েছিলো। যারা তাদের ব্যক্তিগত সাহসিকতা দিয়ে আন্দোলন চালিয়ে নিয়েছিলো।
কিন্তু ২০২৪ এর ১৫ জুলাই যখন ছাত্রলীগ আক্রমণ শুরু করে অলরেডি তখন সারা দেশের ক্যাম্পাসগুলোতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একটা সাংগঠনিক শক্তি তৈরী হয়েছিলো। সেই শক্তি ও শিক্ষার্থীদের চাওয়ার সংযুক্তিতে সাধারণ শিক্ষার্থীরা সহজে আন্দোলনে যুক্ত হতে পেরেছিলো।
বাসস : আন্দোলনে নারী শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ ও ভূমিকা কেমন ছিলো?
আরিফ সোহেল : নারী শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ ছিলো অসাধারণ ও অভাবনীয়। ১৪ জুন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলে আমাদের একজন আন্দোলনকারীকে যখন ছাত্রলীগ মারধর করে তখন আমরা তাকে উদ্ধার করতে সেখানে যাই। যাওয়ার পরে আমরা জানতে পারি যে আন্দোলনকারীদের বিভিন্নভাবে নাজেহাল করা হচ্ছে। হলের সিসিটিভি ফুটেজ গায়েব করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
এগুলা জানার পর আমরা একটা মিছিল বের করে প্রত্যেকটা হল ঘুরে ঘুরে শিক্ষার্থীদেরকে নিয়ে আসি। সেদিন অভূতপূর্বভাবে সবগুলো হল থেকে শিক্ষার্থীরা বের হয়ে এসে আমাদের মিছিলে যোগ দেয়। সেদিন পুরোপুরিভাবে নেতৃত্ব দিয়েছে মেয়েদের হলগুলো। মেয়েদের হলগুলো থেকে নারী শিক্ষার্থীরা দলে দলে মিছিলে যুক্ত হয়েছিলো।
১৫ জুলাই রাতেও যখন ছাত্রলীগ হামলা করে তখন কিছু আওয়ামী পন্থী শিক্ষক প্রস্তাব দেয় যে নারী শিক্ষার্থীদের নিরাপদে হলে পৌঁছে দিবে। কিন্তু নারী শিক্ষার্থীরা সেটা মেনে নেয়নি। কারণ তারা চলে গেলে ছেলেদের ওপর প্রাণঘাতী হামলা চালানো হবে। তাই তারা সেখানে অবস্থান করে নিজেরাও হামলার সম্মুখীন হয়েছিলো, তবুও ছেলে শিক্ষার্থীদের ছেড়ে যায়নি।
বাসস : জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ধারাবাহিকতা কীভাবে চলমান ছিলো?
আরিফ সোহেল : আন্দোলনের ধারাবাহিকতা ও সময়কে কয়েকটি ধাপে ভাগকরা যায়। প্রথম ধাপ শুরু হয়েছিল ৬ জুন। তখন শুধু আমরা নিজেদের সংগঠিত করি ও বিভিন্ন প্রতীকী কর্মসূচি পালন করি।
২০২৪ সালের ৫ জুন হাইকোর্ট কর্তৃক কোটা ব্যবস্থার পুনর্বহাল ঘোষণার পর সারাদেশে শিক্ষার্থীদের মাঝে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া শুরু হয়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেক্ষাপটে এ সময়টি ছিল এক নতুন আন্দোলনের সূচনালগ্ন।
হাইকোর্টের রায়ের ঠিক পরদিন, ৬ জুন আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে একটি জরুরি মিটিং আহ্বান করি। এই স্থানটি ছিল যথার্থ, কারণ এখানে চাকুরিপ্রত্যাশী শিক্ষার্থীরা সবসময় পড়াশোনায় ব্যস্ত থাকেন। সেদিন আমরা প্রত্যাশার চেয়েও বেশি সাড়া পাই। সেখান থেকেই জাহাঙ্গীরনগরে কোটা সংস্কার আন্দোলনের নতুন পর্বের সূচনা ঘটে।
এরপর আমরাই সর্বপ্রথম ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করি কোটা ব্যবস্থার যৌক্তিক সংস্কারের দাবিতে। কিন্তু তখন ঈদুল আযহার ছুটি শুরু হওয়ায় আন্দোলনে কিছুটা বিরতি আসে।
২য় ধাপ শুরু হয় ঈদের ছুটির পর। ছুটি শেষে ফিরে এসে আমরা আবারও আন্দোলন শুরু করি।
আমরা তখন ঐতিহ্যগত হরতাল-অবরোধ ছাড়াও নতুন ধরনের কর্মসূচির প্রবর্তন করি, যেমন ‘বাংলা ব্লকেড’ নামে প্রতীকী কর্মসূচি।
এরপর শুরু হয় আন্দোলনের ৩য় ধাপ। এরই মধ্যে সরকার একটি কোটা সংস্কার প্রস্তাব আনে। কিন্তু সেটা আমাদের চাওয়ার সাথে সামঞ্জস্য ছিলোনা। তাই আমরা সরকারের সাথে আপোস না করে আন্দোলন চালিয়ে যাই। এ সময় সরকার নানাভাবে আন্দোলন বন্ধের চেষ্টা করে। কিন্তু তারা সফল হয়নি।
আন্দোলনের ৪র্থ ও সর্বশেষ ধাপ শুরু হয় ১৪ জুলাই থেকে। যখন আন্দোলনটা কোটা সংস্কার কিংবা বৈষম্য বিরোধী সংস্কারের বাইরে গিয়ে আরো বৃহৎভাবে জনমানুষের কাছে ফুটে ওঠে।
১৪ জুলাই এক সংবাদ সম্মেলনে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকার’ বলে অভিহিত করেন। এর ফলে সারা দেশের ছাত্রসমাজ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। ‘তুমি কে, আমি কে, রাজাকার, রাজাকার!’ স্লোগান চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।
জাহাঙ্গীরনগরেও প্রতিবাদ শুরু হয়। সেদিন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলে ছাত্রলীগ আন্দোলনকারী এক শিক্ষার্থীর ওপর হামলা চালায়। আমরা সেখানে গিয়ে প্রতিবাদ জানাইএবং সিসিটিভি ফুটেজ না দেখানোয় হল প্রভোস্টের পদত্যাগ দাবি করি। রাতেই তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।
ছাত্রলীগ ১৫ জুলাই আরো ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। সামাজিক মাধ্যমে তারা নানা হুমকি দিতে থাকে। আমরা বিকেলে পুনরায় বিক্ষোভ মিছিল বের করলে, মিছিলটি শেখ মুজিবুর রহমান হলের সামনে পৌঁছালে ছাত্রলীগ লাঠি ও দেশীয় অস্ত্র দিয়ে আমাদের ওপর অতর্কিতে হামলা চালায়। সেখানে বেশ কিছু নারী শিক্ষার্থীসহ অনেকেই আহত হন।
হামলার প্রতিবাদে আমরা উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান নিই এবং নিরাপত্তা ও বিচার দাবি করি। কিন্তু প্রশাসন নীরব থাকে। আমরা জেনেছিলাম ছাত্রলীগ বাইরের অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের এনে পুনরায় হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। নিজেদের নিরাপত্তার জন্য আমরা উপাচার্য ভবনের অভ্যন্তরে আশ্রয় নিই।
সেই রাতেই ছাত্রলীগ উপাচার্য ভবনে আশ্রয় নেয়া ক্লান্তশ্রান্ত আন্দোলনকারীদের ওপর নারকীয় হামলা চালায়। অসংখ্য শিক্ষার্থী গুরুতর আহত হন। হামলার খবর দ্রুত সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজারো সাধারণ শিক্ষার্থী রাতেই রাস্তায় নামে। মিছিল করে তারা উপাচার্য ভবনের সামনে যায় এবং আন্দোলনকারীদের উদ্ধার করে আনে।
সে রাতেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রথমবারের মতো ‘ছাত্রলীগ মুক্ত’ ঘোষণা করা হয়।
এরপর আন্দোলন আরও বেগবান হয়। ১৬ জুলাই আশেপাশের স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষও আন্দোলনে যোগ দেয়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ও হল ভ্যাকেন্টের ঘোষণা দেয়। শিক্ষার্থীরা তা প্রত্যাখ্যান করে হলে অবস্থানেরসিদ্ধান্ত নেয়।
এরপর ১৭ জুলাই শত শত পুলিশ ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে শিক্ষার্থীদের ওপর নৃশংস হামলা চালায়। আহত হন অনেকে। ১৮ জুলাই আমরা পুলিশ বাহিনীকে ক্যাম্পাস ছাড়তে বাধ্য করি।
এক পর্যায়ে সরকার সারাদেশে কারফিউ জারি করে। কিন্তু জাহাঙ্গীরনগরের শিক্ষার্থীরাই প্রথম কারফিউ ভেঙে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে অবস্থান নেয়, যা সারাদেশে প্রচারিত হয় এবং আন্দোলনে সাহস যোগায়।
এরপর প্রশাসন দমন-পীড়ন শুরু করে।চলতে থাকেধরপাকড়। তবুও আমরা পিছু হটিনি।
সর্বশেষ ২৮ জুলাই আমার বাসা থেকে আমাকে ডিবি পুলিশ উঠিয়ে নিয়ে যায়। তারা আমাকে অজ্ঞাত স্থানে রেখে নানা রকম হুমকি দিতে থাকে আন্দোলন বন্ধ করার জন্যে। কিন্তু আমি তাদের হুমকিতে ভীত হইনি। পরে তারা আমাকে সেতু ভবনে হামলা ও নাশকতার মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে জেলে পাঠায়। সেখান থেকে পরে আমার জামিন হয়।
বাসস : আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ভূমিকা কি ছিলো?
আরিফ সোহেল : জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আসলে খুবই ইউনিক একটা আন্দোলন হয়েছে। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের সাথে হয়তো আমাদের ক্যাম্পাসের পরিস্থিতি ওভাবে মেলানো যাবে না। এখানকার শিক্ষকরা ফ্রন্টলাইনে খুবই সাহসী ভূমিকা রেখেছেন। শুরু থেকেই তারা আমাদের সাথে ছিলেন এবং ১৫ জুলাইয়ের পরে অনেক শিক্ষক সরাসরি সামনের সারিতে অবস্থান নিয়ে আমাদের সাথে আন্দোলন করেছেন।
সাভারে ৫ আগস্ট গণভবনমুখী ছাত্র-জনতার মিছিলে পুলিশ গুলি চালায়। সেদিন শ্রাবণ গাজী ও আলিফ আহমেদ সিয়াম সহ অনেকে শহীদ হয়েছিলো। সেদিনও শিক্ষকরা আমাদের মিছিলের সামনে অবস্থান নিয়েছিলেন।
আন্দোলনের সময় যখন আমি গ্রেফতার হয়েছিলাম তখন শিক্ষকরা আমার মুক্তির জন্য আন্দোলন করেছেন। জেলের মধ্যে যখন আমি এসব শুনেছিলাম তখন অন্যরকম একটা সাহস আমার ভেতরে চলে এসেছিলো। সব দিক থেকেই শিক্ষকদের ভূমিকা অসাধারণ ছিল।
তবে জাহাঙ্গীরনগরের আওয়ামী পন্থী শিক্ষকদের ভূমিকাটা একটু সিস্টেমেটিক ছিলো। তারা প্রথম থেকেই আন্দোলনে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করেছিলো। অনেক ক্যাম্পাসে আমরা দেখেছি যে আওয়ামী পন্থী শিক্ষকরা সরাসরি ও নগ্নভাবে শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে নেমে গিয়েছেন। আমাদের ক্যাম্পাসেও অনেক শিক্ষক তেমনই ছিলেন।
ফ্যাসিবাদী যে শাসন কাঠামো ছিল সেটার সবচাইতে ক্ষতিকরও বেহায়া যে অংশটা সেটা হচ্ছে এই আওয়ামী পন্থী শিক্ষক সমাজ।
বাসস : আন্দোলন চলাকালীন সময়ে পুলিশ প্রশাসনের ভূমিকা কেমন ছিলো?
আরিফ সোহেল : পুলিশ প্রশাসন থেকে শুরু করে সকল নিরাপত্তা বাহিনীর ভূমিকা ছিলো খুবই ন্যাক্কারজনক। ছাত্রলীগের কাছ থেকে আমরা যেটা আশা করেছিলাম সেটাই হয়েছিলো। কারণ এর আগেও সকল জনবান্ধব ও শিক্ষার্থীবান্ধব আন্দোলনে তারা হামলা করেছিলো। শিক্ষার্থীদের ওপর অত্যাচার চালিয়েছিল।
নিরাপত্তা প্রদানের নামে ক্যাম্পাসে পুলিশ আনা হয়েছিলো। কিন্তু আমরা কল্পনাও করিনি যে পুলিশ এবং নিরাপত্তা বাহিনী এত নগ্নভাবে আমাদের ওপর হামলা করবে। তারা হানাদার বাহিনীর মতো আমাদের ওপর আক্রমণ করছিলো।
তাদের বিরুদ্ধেও আমাদের লড়াই করতে হয়েছে। তারা একটা রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বাহিনী। অথচ তারা সেই জায়গা থেকে সরে গিয়ে একটা সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের বাহিনী হিসেবে কাজ করেছিলো।
বাসস : আন্দোলনের সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত সাংবাদিকদের ভূমিকা কেমন ছিলো?
আরিফ সোহেল : জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনে ক্যাম্পাসের সাংবাদিকরা ছিলেন এক অবিচ্ছেদ্য শক্তি। তারা কেবল পেশাদার সাংবাদিক হিসেবে নয়, বরং আন্দোলনে একটিভিস্ট হিসেবেও ভূমিকা পালন করেছেন। আন্দোলনের প্রতিটি ধাপে আমরা তাদের ওপর নির্ভর করেছি। আমাদের বিরোধী শক্তির অবস্থান ও গতিবিধি সম্পর্কে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য তথ্য আমরা তাদের মাধ্যমেই পেতাম।
তারা এককথায় আন্দোলনে গোয়েন্দার ভূমিকা পালন করেছিলো। তাদের তথ্য ও পরামর্শের ভিত্তিতেই আমরা আন্দোলনের পরিকল্পনা সাজাতাম।
যখন সরকার সারাদেশে ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করে দেয়, তখনও তারা থেমে থাকেনি। এসএমএসের মাধ্যমে তারা আন্দোলনের জন্য প্রয়োজনীয় প্রতিটি তথ্য পৌঁছে দিতেন। নিজের জীবন ঝুঁকির মুখে রেখেই তারা আন্দোলনের পাশে থেকেছেন, সর্বোচ্চ সহযোগিতা করেছেন। তাদের এই নিষ্ঠা ও সাহসিকতা আন্দোলনের শক্তি বাড়িয়ে দিয়েছিলো বহু গুণ।
বাসস : ঢাকা আরিচা মহাসড়ক অবরোধ কর্মসূচি কিভাবে সফল করতেন?
আরিফ সোহেল : ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ আমাদের আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচি ছিল। এই মহাসড়কটি রাজধানী ঢাকা ও উত্তরবঙ্গের মধ্যে অন্যতম প্রধান যোগাযোগ মাধ্যম হওয়ায় অবরোধের মাধ্যমে আমরা কেন্দ্রীয় পর্যায়ে সরাসরি চাপ তৈরি করতে পারতাম। ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও আমরা তা করতাম, কারণ এর প্রভাব ছিল দৃশ্যমান ও কার্যকর।
আমরা সবসময় জরুরি চলাচলের জন্য একটি ‘ইমার্জেন্সি লেন’ চালু রাখতাম, যাতে অ্যাম্বুলেন্স ও অন্যান্য জরুরি যানবাহন নির্বিঘ্নে চলাচল করতে পারে।
অবশ্য, এতে কিছুটা ভোগান্তিতে পড়তেন সাধারণ পথচারী ও যাত্রীরা। তবে তখন দেশের অধিকাংশ মানুষই স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে চরমভাবে ক্ষুব্ধ ও অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। ফলে তারা আন্দোলনের স্বার্থে এসব সাময়িক দুর্ভোগ হাসিমুখেই মেনে নিতেন।
বাসস : স্থানীয় আওয়ামীলীগ ও তার অঙ্গ সংগঠনসমূহের নেতাকর্মীদের সাথে আপনাদের সংঘর্ষ হতো কি?
আরিফ সোহেল : আমাদের আন্দোলনের কেন্দ্র ছিল বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, ফলে মূল সংঘাতগুলোও ছাত্রলীগের সঙ্গেই বেশি হয়েছিল। তবে যেহেতু আন্দোলনটি দ্রুতই দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে, তখন তা আর কেবল ক্যাম্পাসে সীমাবদ্ধ থাকেনি। বিশেষ করে সাভার এলাকায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠনের সন্ত্রাসীরা প্রায়ই আমাদের ওপর হামলা চালাতো। তখন আমরা ক্যাম্পাস থেকে বের হয়ে সেই হামলার জবাব দিতাম।
এমনকি ছাত্রলীগ পালিয়ে যাওয়ার পরও নিয়মিত স্থানীয় আওয়ামীলীগের সন্ত্রাসী ছাত্রলীগের সাথে ক্যাম্পাসে প্রবেশের চেষ্টা করতো। কিন্তু আমরা সংঘবদ্ধ থাকায় সেটা সম্ভব হয়নি।
সাভারের এমপি সাইফুল ইসলামের নিয়ন্ত্রিত এক সন্ত্রাসী বাহিনী আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালিয়ে ফেরার পথে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেইরি গেট এলাকায় তাদের সঙ্গে আমাদের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। সেদিন দুই পক্ষের মধ্যে প্রচণ্ড ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া এবং সংঘর্ষ ঘটে। অনেকেই আহত হন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমরা তাদের প্রতিরোধ করতে সক্ষম হই।
বাসস : কেন্দ্রের সাথে কিভাবে যোগাযোগ বজায় রাখতেন? কিভাবে কেন্দ্রীয় কর্মসূচির সাথে ক্যাম্পাসের কর্মসূচির সমন্বয় করতেন?
আরিফ সোহেল : কেন্দ্রের সাথে সমন্বয় করার জন্য আমাদের একটি ম্যাসেঞ্জার গ্রুপ করা হয়েছিলো। পরবর্তী সময়ে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ খোলা হয়। সেখানে নিয়মিত সকল আন্দোলনের খবরাখবর ও পরবর্তী আন্দোলনের নির্দেশনা প্রদান করা হতো।
একপর্যায়ে দেশে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়া এবং কেন্দ্রীয় সমন্বয়কদের গ্রেফতার করা হয়। তখন আমি অনেক কষ্টে কেন্দ্রেরদু’জন সমন্বয়কের সাথে যোগাযোগ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনের কর্মসূচি ঠিক করতাম। সিলেটের আসাদুল্লাহ আল গালিব ভাই এবং ঢাকায় উমামা ফাতেমার সাথে যোগাযোগ করতে সক্ষম হয়েছিলাম। পরবর্তী সময়েধীরে ধীরে আবদুল কাদের ও হান্নান মাসুদের সাথে যোগাযোগ হতো। এরপর আমরা ৯ দফা নিয়ে আলোচনা করি। সর্বশেষ আমাদের অবস্থা ও চিন্তা এবং অন্য সবার চিন্তা ভাবনা এমনভাবে এক হয়ে গিয়েছিলো যে আমাদের যোগাযোগ না হলেও আন্দোলন পরিচালনা করা যেতো।
বাসস : আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ায় আপনি ব্যক্তিগত ও পারিবারিকভাবে কি ধরনের হুমকির সম্মুখীন হয়েছেন?
আরিফ সোহেল : আমার পরিবার ও আমার ওপর হুমকি ছিলো নিয়মিত ঘটনা। আমাকে হত্যা করার হুমকিও দেয়া হতো। আমার বাসার আশেপাশে সবসময় গোয়েন্দা নজরদারী অব্যাহত ছিল। তবে এসব সাধারণ বিষয় ছিলো। সরকার বিরোধী আন্দোলনে থাকলে এরকম হুমকি আসবে এটাই স্বাভাবিক।
বাসস : আপনাকে ডিবি পুলিশ কিভাবে গুম করেছিলো? গুম অবস্থায় আপনার সাথে কিরকম আচরণ করেছিলো?
আরিফ সোহেল : কেন্দ্রের একজন সমন্বয়ক ২৬ জুলাই আমার সাথে যোগাযোগ করে। তিনি আমাকে জানান যে আমাদের সব সিনিয়র নেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এখন আমিই সবচেয়ে সিনিয়র। তাই আমাকে ঢাকায় গিয়ে নেতৃত্ব গ্রহণ করতে হবে।
আমি বললাম ঠিক আছে, পরিস্থিতি যদি এই হয় তাহলে আমি আসবো। পরে আমি প্রস্তুত হই। ইতোপূর্বে প্রায় দুই সপ্তাহ হলো আমি বাড়িতে যাইনি। আমার কিছু দরকারি জিনিসপত্র বাড়িতে রয়ে গেছে। তখন একদম ছন্নছাড়া অবস্থায় আমি বাইরে থাকতাম। আমি ভাবলাম বাড়িতে গিয়ে একটু সবার সাথে দেখা করে আসি এবং আমার জিনিসপত্রগুলো নিয়ে আসি। কারণ ঢাকায় যেতে হবে, যাওয়ার পরে জীবিত ফিরে আসতে পারবো না এটা আমি মোটামুটি তখন নিশ্চিত।
বাড়িতে যাওয়ার পর ২৮ তারিখ রাতে আমার বাসায় ডিবি পুলিশ এসে বাসা ঘেরাও করে আমাকে উঠিয়ে নেয়। তারা প্রথমে আমাকে ডিবি অফিসে নিয়ে যায়। পরে চোখ বেঁধে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে গিয়েছিলো। সেখানে তারা আমাকে বিভিন্নভাবে হুমকি দিতে থাকে ক্যাম্পাসের আন্দোলন বন্ধ করতে।
পরে আমাকে হাজতে রাখা হয়েছিলো। আমার সাথে আরো কিছু বন্দীকে রাখা হয়। তাদের ওপর চরম নির্যাতন চালানো হতো। সেখানে অনেক বন্দীকে মেরে হাত পা ভেঙে দেয়া হয়েছিলো। এটা ছিলো হাসিনা আমলের প্রায় ১৬ বছরের শাসনের নিয়মিত দৃশ্য। আমি বুঝতে পারছিলাম যে চলমান আন্দোলন যদি সফলতার দিকে যায় আমাদেরকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হবে। আন্দোলন ব্যর্থ হলে আমাদেরকে ক্রসফায়ারে দেবে।
পরে আমাদেরকে গ্রেফতার দেখানো হয়। আমরা বুঝতে পারলাম আমাদেরকে ছেড়ে দেয়া হবে। তবে ৩ জুলাই কোর্টে জামিন শুনানীর সময় আমি জানতে পারি আমার বিরুদ্ধে সেতু ভবনে নাশকতা ও বিস্ফোরক আইনে মামলা দিয়েছে। যা ছিলো একেবারেই হাস্যকর বিষয়।
আমি আওয়ামী স্বৈরাচারী সরকারের রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আন্দোলনে ছিলাম, সে হিসেবে রাষ্ট্রদ্রোহী মামলা দিতে পারতো। কিন্তু জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থান করে ঢাকায় সেতু ভবনে হামলার মত হাস্যকর মামলায় আমাকে জড়ানো হয়েছিলো।
বাসস : আন্দোলনের শুরুর দিকে আপনি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন রাজনৈতিক কিংবা অন্য কোন দলের সাথে কি সম্পৃক্ত ছিলেন?
আরিফ সোহেল : আমি তখন গণতান্ত্রিক ছাত্র শক্তির কেন্দ্রীয় যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলাম। গণতান্ত্রিক ছাত্র শক্তি ছিল একটা লেজুড়বৃত্তিহীন ছাত্র সংগঠন। এটা ২০২৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকেই আমরা কাজ চালিয়ে আসছিলাম এবং ক্যাম্পাসেও আমরা মোটামুটি কমিটি দেয়ার একটা প্রস্তুতি নিয়েছিলাম।
এর আগে আমি রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের সাথেও যুক্ত ছিলাম। মূলত গণতান্ত্রিক ছাত্র শক্তির মাধ্যমেই ছাত্র রাজনীতিতে বা ক্যাম্পাসগুলোতে কিভাবে আমরা শিক্ষার্থীদের অধিকার আবার পুনরুদ্ধার করতে পারি সেটা নিয়ে কাজ করেছি।
আন্দোলনে অন্যান্য আরো ছাত্র সংগঠন অংশগ্রহণ করেছিলো। বিশেষ করে ১৫ জুন থেকে ক্যাম্পাসের সবাই সম্পৃক্ত ছিল। আওয়ামী ফ্যাসিবাদ বিরোধী সকল শক্তিই এই আন্দোলনে সক্রিয় ছিলো। পরবর্তীকালে সেই প্ল্যাটফর্মগুলো এখন নিজেদের স্ব স্ব ব্যানারে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।
বাসস : স্বৈরাচার পতন পরবর্তী সময়ে গণঅভ্যুত্থানের আশা আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন হয়েছে বলে কি মনে করেন?
আরিফ সোহেল : আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন যেরকম আমরা স্বপ্ন দেখেছিলাম সেরকমটা হয়নি। আমরা ভেবেছিলাম বাংলাদেশে নতুন একটা রাষ্ট্র কাঠামো তৈরি হবে। তিনশ’ বছরের পুরোনো যে কাঠামো সেটা বদলে জনগণের রাষ্ট্রে পরিণত হবে যা জনগণের কল্যাণে কাজ করবে।
আমরা দেখেছি সংস্কার কমিশন করা হয়েছে কিন্তু সেগুলোর সকল প্রক্রিয়ার সাথে আমরা একমত হতে পারিনি। বিপ্লবী ও তরুণ প্রজন্ম যারা জুলাই-আগস্টে রাষ্ট্রের জন্য দাঁড়িয়েছিলেন, রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য প্রস্তুত ছিলেন তাদের কাজে লাগানোর সুযোগটাও নষ্ট হয়েছে। এদেরকে কাজে লাগানো যায়নি।
কিন্তু প্রতিফলন যেটা হয়েছে সেটা হলো মানসিক পরিবর্তন হয়েছে। এখন মানুষ অন্যায়কে মেনে নেবেনা। অন্যায় মেনে না নেওয়ার একটা সাংস্কৃতিক পরিবর্তন মানুষের মাঝে এসেছে। কাঠামোগত পরিবর্তনটা দেখতে আরো কিছুটা সময় লাগবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিভিন্ন সংস্কার কমিশন করেছে। সেগুলোর সুপারিশ বাস্তবায়ন হলে হয়তো একটা পরিবর্তিত রাষ্ট্রকাঠামো দেখতে পাবো। তখন হয়তো আমাদের কাছে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ফসলটা দৃশ্যমান হবে। সবচেয়ে বড় পাওয়া হলো জনগণের প্রতিবাদী চেতনা যা সমুন্নত আছে এবং থাকবে।
বাসস : স্বৈরাচার পতন পরবর্তী নতুন বাংলাদেশে আপনার প্রত্যাশা কি?
আরিফ সোহেল : গণঅভ্যুত্থান মানে হলো একটা জনগোষ্ঠীর সকলকেই তাদের ইচ্ছাকে একসাথে এক কন্ঠে জানান দেয়া। এটা ইতিহাসে খুব কমই ঘটে। এদেশের মানুষ জুলাই-আগস্টে একসাথে জানিয়ে দিয়েছিলো তারা এদেশে ফ্যাসিবাদী শাসন ব্যবস্থা চায় না। নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থা চায়। আমিও জনমানুষের সেই চাওয়ার প্রতিফলন দেখতে চাই নতুন বাংলাদেশে।
আমাদের চাওয়া বিশ্ব অর্থনীতিতে বাংলাদেশ মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। বাংলাদেশ বিশ্বে নতুন রাজনৈতিক কাঠামো নিয়ে হাজির হবে, এটাই জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রধান মর্ম।
আমরা আশা করি বাংলাদেশ একটি সফল ও আত্মমর্যাদা সম্পন্ন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে।