শিরোনাম

কালাম আজাদ
বগুড়া, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৫ (বাসস) : ইতিহাস বলে, মুঘল সম্রাট আকবরের বিরুদ্ধে বাংলায় একবার বিদ্রোহ হয়েছিল। ঠিক ওই সময়টায় বিদ্রোহী এক নবাবের সহায়তায় গড়ে উঠেছিল খেরুয়া মসজিদ। সুলতানি ও মুঘল আমলের নকশার মিশেলে মুসলিম স্থাপত্যের এক অনন্য নিদর্শন বগুড়ার এ মসজিদটি।
মসজিদটির অবস্থান বগুড়া শহর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দক্ষিণে শেরপুর উপজেলার খন্দকারটোলা গ্রামে। রাস্তাসহ ৫৯ শতক জায়গা নিয়ে অবস্থিত খেরুয়া মসজিদের সামনের অংশে রয়েছে আয়তাকার মাঠ আর মসজিদের চতুর্দিকে রয়েছে তাল, নারিকেল, আম ও কদম গাছের সারি। মসজিদের উত্তর পাশে ওজুর স্থান।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর সূত্র বলছে, সঠিক তারিখ সংবলিত এ অঞ্চলের মুসলিম আমলের সবচেয়ে প্রাচীন কীর্তি এটি। আরব দেশ থেকে আব্দুস সামাদ ফকির নামের এক ব্যক্তি শেরপুরের এ এলাকায় এসেছিলেন। এলাকাটি ঘনবসতি হওয়ায় তিনি এখানে একটি মসজিদ নির্মাণের পরিকল্পনা করেন।
খেরুয়া মসজিদের গায়ে স্থাপিত শিলালিপি থেকে জানা যায়, এর নির্মাণ কাজ শুরু হয় ১৫৮২ সালের ২১ জানুয়ারি (৯৮৯ হিজরির ২৬ জিলহজ্জ)। তখন এ অঞ্চলের শাসক জওহর আলী কাকশালের ছেলে মীর্জা মুরাদ খানের সহায়তায় মসজিদটি নির্মাণ হয়। এ মসজিদের নির্মাণকাজ শেষ করতে আরও কয়েক বছর সময় লেগেছিল বলে ধারণা করা যায়।
আবুল কালাম যাকারিয়ার লেখা ‘বাঙলাদেশের প্রত্নসম্পদ’ বই থেকে জানা যায়, ১৫৮০ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট আকবরের বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহ হয় তাতে বিহার ও বাংলা সাময়িকভাবে সম্রাটের হস্তচ্যুত হয়। সে সময়ে কাকশাল উপাধিধারী তুর্কি জায়গীরদারগণের অধীনে ছিল ঘোড়াঘাট অঞ্চল। তারাও বিদ্রোহী হয়ে মাসুম খান কাবুলীর সঙ্গে যোগদান করেন।
১৫৮৩ খ্রিস্টাব্দে খান-ই-আযম বাংলার সুবেদার নিযুক্ত হয়ে নানারকম প্রলোভনে ভুলিয়ে কাকশাল নেতাদের বশীভূত করেন। এতে বিদ্রোহী মাসুম খান কাবুলি কাকশালদের ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার উদ্দেশ্যে তাদের আবাসস্থল ঘোড়াঘাট আক্রমণ ও অবরোধ করেন। পরে খান-ই-আযম প্রায় চার হাজার অশ্বারোহী সৈন্য পাঠিয়ে কাকশালদের বিপদমুক্ত করেন।
এতে দেখা যায়, ১৫৮২ খ্রিস্টাব্দে মসজিদের কাজ আরম্ভ হওয়ার সময় মসজিদ নির্মাতা নওয়াব মীর্যা মুরাদ খান বিদ্রোহীদের দলভুক্ত ছিলেন। পরবর্তী বছরে অন্যান্য কাকশাল নেতার সঙ্গে তিনিও খুব সম্ভব সম্রাটের আনুগত্য স্বীকার করেন। মীর্যা মুরাদ খানের প্রকৃত পরিচয় পাওয়া যায়নি। তিনি খুব সম্ভব শেরপুর মুরচার জায়গীরদার বা ফৌজদার ছিলেন। এ সময় শেরপুর মুরচা ঘোড়াঘাটের অধীনে একটি প্রশাসনিক কেন্দ্র ছিল।
মসজিদটির স্থাপত্যশৈলী সম্পর্কে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের তথ্য বলছে, প্রাচীন এই মসজিদটি চার কোণের প্রকাণ্ড আকারের মিনার আর চওড়া দেওয়ালে ভর করে দাঁড়িয়ে আছে। উত্তর-দক্ষিণ লম্বা বিশিষ্ট মসজিদটির বাইরের দিকের দৈর্ঘ্য ৫৭ ফুট এবং প্রস্থ ২৪ ফুট। ভেতরের দিকের দৈর্ঘ্য ৪৫ ফুট ও প্রস্থ ১২ ফুট। আর মসজিদের চারদিকের দেওয়ালের পুরুত্ব ৬ ফুট।
এই মসজিদ নির্মাণে ইট, চুন ও সুরকি ছাড়াও বৃহদাকার কৃষ্ণ পাথর ব্যবহার করা হয়েছে। তিন গম্বুজ বিশিষ্ট এই মসজিদের চার কোনায় চারটি মিনার ও পূর্ব দেওয়ালে তিনটিসহ উত্তর-দক্ষিণে আরও দুটি দরজা রয়েছে। আর পশ্চিম দেয়ালে আছে তিনটি কারুকার্য করা মিহরাব। এ ছাড়া ধনুকের মতো বাঁকা কার্নিশের তলায় সারিবদ্ধ খিলান আকৃতির প্যানেলের আছে চমৎকার অলংকরণ।
ইটের বিন্যাস ও খাড়া প্যানেলের মাধ্যমে নান্দনিক বৈচিত্র্য তৈরি করা হয়েছে। মিনার, গম্বুজ ও ইটের বৈচিত্র্যময় গাঁথুনি এবং ফুল-লতা-পাতার নকশা পুরো মসজিদটিকে দিয়েছে বিশেষ স্বতন্ত্রতা। মসজিদের সামনের দেওয়ালে স্থাপিত ফারসি শিলালিপি।
মসজিদ প্রাঙ্গণে আবদুস সামাদ ফকিরের কবর দেওয়া হয়। তবে তার মৃত্যুর সময় কেউ বলতে পারেনি। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের খেরুয়া মসজিদের কেয়ারটেকার আবদুস সামাদ প্রামানিক এই কথা জানান। তিনি এই মসজিদে ১৯৮৮ সাল থেকে দায়িত্ব পালন করছেন।
আবদুস সামাদ প্রামানিক বলেন, আব্দুস সামাদ ফকির অনেক কামেল ব্যক্তি ছিলেন। তার সঙ্গে কবুতর কথা বলত। মসজিদ বানানোর আগে দুটি কবুতর তাকে বলে, আপনি মসজিদ বানাচ্ছেন আমাদেরও ইবাদত করার জায়গা দেন। কবুতরদের মসজিদের দক্ষিণ-উত্তর ও পশ্চিম এই তিন পাশে থাকার জায়গা করে দেন। এরপর সেখানে নামাজ আদায় হত। এই কথা মসজিদের শিলালিপিতে লেখা আছে।
স্থানীয়রা জানান, এই মসজিদকে ঘিরে মিথ (জনশ্রুতি) রয়েছে যে এক রাতে জিন এই মসজিদ নির্মাণ করেছে। শিলালিপির কবুতরদের বাস করার নির্দেশনা এই জনশ্রুতিকে আরও বেশি যেন টেকসই করেছে। ফলে মসজিদ নিয়ে স্থানীয়দের কাছে যেমন শ্রদ্ধার তেমনি ভয়ের। ১৯৫৬ সালে মসজিদটি সরকারিভাবে পুরাকীর্তি হিসেবে মেরামত করা হয়। পরবর্তীতে মসজিদ বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আওতায় নিয়ে আসা হয়।
মসজিদ কর্তৃপক্ষ জানায়, প্রতিদিন গড়ে ২৫ থেকে ৩০ জন দর্শনার্থী বেড়াতে আসেন। তবে শুক্রবার ও শনিবার বেশি হয়। এই দুই দিনে ১৫০ থেকে ২০০ জন মানুষ আসেন খেরুয়া মসজিদ দেখতে।
২০১৮ সাল থেকে মসজিদের মুয়াজ্জিন হিসেবে দায়িত্বে আছেন একই এলাকার জুবায়ের আহমেদ। নিজ এলাকায় এবং ঐতিহাসিক মসজিদে আজান দেওয়ার দায়িত্ব পেয়ে যেমন খুশি তেমনি গর্বিতও তিনি। জানালেন, মসজিদের ভেতরে তিনটি কাতার হয়। প্রতি কাতারে ৩০ জন করে মোট ৯০ জন মানুষ নামাজ পড়তে পারেন। শুক্রবার বাইরেও নামাজের আয়োজন করা হয়।
জুবায়ের আহমেদ বলেন, এখানে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজই হয়। তবে বর্ষাকালে একটু সমস্যা হয়ে যায়। বিশেষ করে ফজরের সময় অনেক দিন আছে কেউ আসে না। কারণ রাস্তার অবস্থা ভালো না। রাস্তাটা ভালোভাবে তৈরি করে দিলে সবার জন্য উপকার হতো।
মসজিদের সংস্কার প্রসঙ্গে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের রাজশাহী ও রংপুর অঞ্চলের পরিচালক এ কে এম সাইফুর রহমানের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, খেরুয়া মসজিদটি অত্যন্ত প্রাচীন একটি মসজিদ। এটি সুলতানি ও মুঘল আমলের। এই মসজিদ নিয়ে আমাদের এই বছর পরিকল্পনা সংস্কার ও সংরক্ষণের। মসজিদে আসার যে রাস্তা সেটি সংস্কার করতে হবে। এছাড়া দর্শনার্থীদের জন্য বর্ণনার ব্যবস্থা করছি। রাস্তার বিষয়টি স্থানীয় প্রশাসনকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছি। আশার করছি আগামী অর্থবছরের মধ্যে এসব ঠিক হয়ে যাবে।