শিরোনাম

মো. মঞ্জুর মোর্শেদ
মুন্সীগঞ্জ, ২৬ ডিসেম্বর,২০২৫ ( বাসস ): প্রাচীন বাংলার অন্যতম সমৃদ্ধ জনপদ বিক্রমপুর তথা মুন্সীগঞ্জ। শিক্ষা , সংস্কৃতি ও ধর্মীয় কর্মকান্ডের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল বর্তমান মুন্সীগঞ্জ জেলা।সেন যুগে বিক্রমপুর হয়ে উঠে হিন্দু ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র।
সেই ধারাবাহিকতায় মুন্সীগঞ্জে ১৭ - ১৮ শতকে বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠে মঠ, মন্দির । ইতিহাসবিদদের মতে টঙ্গিবাড়ীর সোনারংয়ে জোড়া মঠ বা মন্দির সেই ধারাবাহিকতায় নির্মিত হয় । দীর্ঘ দিনের অযত্ন আর অবহেলায় হারিয়ে যেতে বসেছে এই স্থাপত্য ঐতিহ্য।স্থাপনা দুটি পাশাপাশি থাকায় সাধারণভাবে এটি জোড়া মঠ বলে পরিচিত হলেও মূলত এটি জোড়া মন্দির।দুটি ভিন্ন দেবতা কালী এবং শিবের উদ্দেশ্যে মন্দির দুটি নির্মাণ করা হয়। বড়টি কালীমন্দির এবং ছোটটি শিবমন্দির ।একই মঞ্চের উপর ৩ ফুটের ব্যবধানে মঠ দুইটি নির্মিত হওয়ায় তা জোড়া মঠ হিসেবে জনশ্রুতি রয়েছে। ১৮০ বছরের ঐতিহ্যের জোড়ামঠ জৌলুস হারিয়ে এখন কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
উনিশ শতকের প্রথমভাগে হিন্দু জমিদার পরিবার পিতা মাতার স্মৃতি রক্ষার্থে বা পূর্ণ অর্জনের জন্য মঠ , মন্দির নির্মাণ করতেন। ইতিহাস মতে সোনারংয়ের হিন্দু ধর্মালম্বী ও ধর্মানুরাগী জমিদার রুপ চন্দ্র সেন পিতা মাতার স্মৃতি রক্ষার্থে দাহস্থলে মঠ দুটি নির্মাণ করেন।সে সময়ে জমিদার পরিবার স্বামী স্ত্রী যৌথভাবে ধর্মীয় দান ও মঠ- মন্দির নির্মাণ করেছেন।মঠের প্রবেশদ্বারের উপরিভাগে নির্মাণকালীন সময়ে স্থাপিত শিলালিপি থেকে জানা যায়, রুপ চন্দ্র ও ভবানিমোহন দম্পতি ১৮৪৩ সালে পুর্ব দিকের বড় মঠটি মায়ের স্মৃতি রক্ষার্থে নির্মাণ করেন।পরবর্তীতে ১৮৮৬ সালে পাশাপাশি পুর্ব দিকে ছোট মঠটি নির্মাণ করেন। সামনের দেওয়ালের উপরিভাগে স্থাপিত শিলালিপি তে নির্মাণ ইতিহাস লিখা ছিল। শিলালিপিটি এবং উপাসনালয়ের ভিতরের শিলা পাথর এখন আর নেই।
দুটি মঠ একই নকশার এবং বর্গাকৃতি এবং এর ভিতরে বর্গাকৃতি কক্ষ রয়েছে। বড় মঠটির উচ্চতা প্রায় ১৫ মিটার এবং এর দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ প্রায় ২২ ফুট। পুর্বদিকের ছোট মঠটি দৈর্ঘ্য ১৪ ফুট এবং প্রস্থে ২৭ ফুট। বড় এবং ছোট মঠের মধ্যে অভ্যন্তরীণ কক্ষ রয়েছে যা উপাসনাকক্ষ হিসেবে ব্যবহ্নত হতো। মঠ দুটি সেন আমলের স্থপত্যের বৈশিষ্ট্য বহন করে। বড় মঠটির অভ্যন্তরীণ কক্ষ বর্গাকৃতি এবং এর দৈর্ঘ্য প্রস্থ ১১ ফুট এবং ছোট মঠটির অভ্যন্তরীণ কক্ষও বর্গাকৃতির এবং এর দৈর্ঘ্য প্রস্থ ৯ ফুট ।দুটি মঠের দেয়ালের পুরুত্ব প্রায় ৩ ফুট।মঠের ভিতরে পূজাকক্ষে উপরের অংশে ফুল লতা পাতার নকশা রয়েছে।দেব দেবীর মুর্তি রাখার জন্য দেয়ালে খাজ কাটা রয়েছে।
গর্ভগৃহে ধ্যান ও পূজার পরিবেশ সৃষ্টির জন্য কক্ষটিকে অন্ধকারাছন্ন রাখতে কোন জানালা রাখা হয়নি। কেবল অলংকরণমূলক দরজা জানালার নকশা রয়েছে।দুটি মঠেই শুধু মাত্র দক্ষিণ দিকের বারান্দার ভিতরে খিলানযুক্ত প্রায় ৭ ফুট উচ্চতার এবং ৩ ফুট প্রস্থে দরজা রয়েছে। অন্য তিনপাশে ৩ টি করে দরজা অলংকরণ করা আছে। পশ্চিমদিকের মঠে শুধু মাত্র সামনের অংশে ৬ ফুট প্রশস্তের বারান্দা রয়েছে। অন্য তিন দিকে কোন বারান্দা নেই ।পূর্ব দিকের মঠে চারিদিকে ৪ ফুট প্রশস্তের বারান্দা রয়েছে।সামনের অংশে একটি দরজা রয়েছে অন্য তিন দিকে শুধুমাত্র ৩ টি করে দরজা অলংকরণ করা আছে।
জোড়া মঠের উপাসনালয় গম্বুজ দ্বারা আচ্ছাদিত।উপসনালয়ের উপরিভাগে রয়েছে বর্গাকার ধাপ।এই ধাপের চারিপাশে রয়েছে অর্ধবৃত্তাকার খিলান নকশা।খিলান নকশার উপরে রয়েছে ফনাতলা সাপের নকশা। ছোট মঠের চারি কোণে চারটি রত্ন আছে।এই রত্নগুলোতেও অর্ধবৃত্তাকার খিলান নকশা সামনে ঘড়ি নকশা রয়েছে।মঠের তৃতীয় ধাপে আয়তাকার প্যানেল এবং বন্ধ দরজার অলংকরণ রয়েছে।তৃতীয় ধাপটির উপর অবতলাকৃতির ক্রমহ্নাসমান সুউচ্চ শিখরটি নির্মিত ।অষ্টভুজাকৃতির শিখরের উপরের রয়েছে কলসচুড়া।তার উপর রয়েছে একটি ত্রিশূল।বাহিরের অংশে অর্ধবৃত্তাকার খিলান নকশা অলংকরণ করা আছে।বড় মঠের (কালি মন্দিরের) গাত্রের চারিপাশে পাখির জন্য রয়েছে ছোট ছোট ফোকর।এসব ফোকরে বসবাস বিভিন্ন রকমের পাখির।
জোড়া মঠের সামনের অংশে বিশাল আকৃতির পুকুরে শান বাধাই ঘাট। এই মঠ সোনারং ও আশ পাশের গ্রামের মানুষের ধর্মীয় সমাবেশ , পূজা ও উৎসবের কেন্দ্র বিন্দু হিসেবে গড়ে উঠেছে।মঠগুলোর ভগ্নপ্রায় অবয়ব , চুন সুরকি নির্মিত দেয়াল বিশাল পাথরের ভিত্তি ও গুম্বুজাকৃতি ছাদগুলো আজও অতীতের গৌরবের কথা বলে।দীর্ঘদিনের অবহেলায় আজ অনেক অংশ ভেঙ্গে গেছে , সময়ের ক্ষয়ে আর দুর্বৃত্ত চুরির ফলে অনেক মূল্যবান পাথর ও স্থাপত্য উপকরণ হারিয়ে গেছে।সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায় মঠের অনেক অংশ ভেঙ্গে পরেছে, দেয়ালের আস্তর খসে পরেছে দরজা উমুক্ত । তবুও এটি উপ মহাদেশে ১৮ শ শতাব্দীর স্থাপত্যশিল্পের নিদর্শন হয়ে আছে।জোড়া মঠটি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসেবে ঘোষণা করেছে।প্রতিদিন বিভিন্ন এলাকা থেকে দর্শনার্থী আসে।কুসুমপুর উচ্চ বিদ্রালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. মাহবুবুর রহমান বাসসকে বলেন, প্রত্ননগরী মুন্সীগঞ্জে এখানকার প্রত্ন নিদর্শনগুলো যথাযথভাবে সংস্কার এবং সংরক্ষণ করা প্রয়োজন।না হলে হারিয়ে যাবে আমাদের কয়েকশত বছরের ইতিহাস।তিনি বলেন প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ থেকে এখানে একটি সংক্ষিপ্ত ইতিহাস লেখা থাকলে পর্যটকরা সহজেই মঠের নির্মান ইতিহাস জানতে পারবে। এই স্থাপনাটি স্থানীয় পর্যটক , গবেষক স্থাপত্যশিল্পীদের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে।