শিরোনাম

মো. মঞ্জুর মোর্শেদ
মুন্সীগঞ্জ, ৭ ডিসেম্বর, ২০২৫ (বাসস ) : মোগল স্থাপত্যের অনন্য নিদর্শন ইদ্রাকপুর দুর্গ কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মুন্সীগঞ্জ শহরের প্রাণকেন্দ্রে এর অবস্থান। সপ্তদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে মোগল বাদশা আওরঙ্গ জেবের শাসনামলে (১৬৫৮-১৭০৭) বাংলার সুবেদার মীর জুমলার সময়ে ১৬৬০ সালে এ দুর্গটি নির্মাণ করা হয়। ঢাকার লালবাগ কেল্লার আদলে দুর্গটি নির্মিত হয়। উত্তর দক্ষিণে প্রসারিত দুর্গটির দৈর্ঘ্য ৮৬.৮৭ মিটার এবং প্রস্থ ৫৯.৬০ মিটার।
মুন্সীগঞ্জ শহরের দক্ষিণ প্রান্তে ধলেশ্বরী নদীর তীরে অবস্থিত ইদ্রাকপুর দুর্গ। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের ইতিহাস এবং মোগল আমলের স্থাপত্য কলাকৌশল। দীর্ঘ ৪০০ বছরে ধ্বংস হয়ে গেছে এর অনেক অংশ।
এরপরও রক্ষিত দুর্গের প্রধান অংশ বৃত্তাকার উচ্চ বুরুজটি মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে অতীত ইতিহাসের জানান দিচ্ছে।
জানা গেছে, মোগলরা বঙ্গদখল নিয়ে তাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জোড়দার করার পরিকল্পনা করে। তখন তারা দেখতে পায় বাংলার বারো ভূঁইয়া ও প্রতিকূল নদী বেষ্টিত জনপদ ছাড়াও তাদের শক্তিশালী প্রতিপক্ষ হলো মগরা (আরাকানি)। পর্তুগিজ ও ওলন্দাজ যারা কিনা বঙ্গোপসাগর দিয়ে মেঘনা, ব্রহ্মপুত্র নদী হয়ে বঙ্গে লুটতরাজ করে।
নৌপথে আসা শত্রু বা জলদস্যুদের প্রতিরোধ করা সম্ভব ছিল না। মোগলরা বুঝতে পারে, বঙ্গে সাম্রাজ্য সুদৃঢ় করার গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হলো নদী বেষ্টিত এ দেশের জনপদকে সুরক্ষা করা। এরই ধারাবাহিকতায় মেঘনা, ইছামতি, শীতলক্ষ্যা নদী তীরে তিনটি দুর্গ নির্মাণ করে। এর একটি ইদ্রাকপুর জলদুর্গ। অন্য দুটি হলো নারায়নগঞ্জ জেলার সোনাকান্দায় এবং হাজিগঞ্জে।
ইদ্রাকপুর দুর্গটি শুধুমাত্র জলদস্যুদের প্রতিহত করার জন্যই নির্মিত হয়নি। মগ, ফিরিঙ্গিদের দমন ছাড়াও ইছামতি, মেঘনা, ধলেশ্বরী নদী দিয়ে যেসব নৌযান মূল্যবান ঢাকাই মসলিনসহ ধাতব ও কৃষি পণ্য বঙ্গোপসাগল ধরে পশ্চিমা দেশসমূহে রপ্তানির জন্য যেত তাদের রক্ষণাবেক্ষণও দুর্গটি নির্মাণের উদ্দেশ্য ছিল। এ সময় বঙ্গের সঙ্গে পারস্য আরব ও ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্জলের দৃঢ় বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল। একইসাথে রাজধানী ঢাকা নগরী ও লালবাগ কেল্লাকে রক্ষা করার জন্য এ দুর্গ নির্মাণ অপরিহার্য ছিল। পর্তুগিজ ও মগ দস্যুরা শীতলক্ষা নদী দিয়ে ঢাকা আসার পথে বিক্রমপুর ও সোনারগাঁও এলাকায় লুটতরাজ চালাতো।
সম্রাট আওরঙ্গজেবের সময়কালে ( ১৬৫৮-১৭০৭ ) ১৬৬০ সালে শাহ সুজার পতন হলে ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দে মীর জুমলা বাংলায় সুবেদার হয়ে আসেন। এ সময় তিনি অনুভব করেন পূর্ব বঙ্গের বিদ্রোহীদের দমন এবং বাংলার ত্রাসনামে পরিচিত মগ ও ফিরিঙ্গি জলদস্যুদের প্রতিহতের জন্য ঢাকাই উপযুক্ত স্থান। মাত্র তিন বছর ( ১৬৬০-১৬৬৩) শাসনকালে ইদ্রাকপুর দুর্গটি নির্মাণ করেন।
সামরিক পরিকল্পনায় দুর্গের পাশেই নৌ বাহিনীর ২০০ নৌ যানের একটি বহর থাকতো। এ গুলোর নাম ছিল কোষা, জলবা, পারিন্দা, বজরা, তাহেরা, সলব, অলিল, খাটগিরি ও মালগিরি। আর এ কেল্লাটিতে নৌ বাহিনীর প্রধান ছিলেন আবুল হোসেন। ঢাকা মুখী মগ ও পর্তুগিজ জলদস্যুদের প্রথমে প্রতিরোধ করতো ইদ্রাকপুর দুর্গের নৌ বাহিনী।
চারদিক ঘেরা চতুর্ভুজ আকৃতির ইদ্রাকপুর দুর্গটি ৩টি অংশে বিভক্ত। প্রধান দুর্গ এলাকা, দুই স্তরের প্রাচীর বেষ্টনী এবং জলাধার ও কেন্দ্রীয় বা পর্যবেক্ষণ টাওয়ার বা বুরুজ। ইদ্রাকপুর দুর্গের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য দুর্গের মাঝখানে বড় গোলাকার বুরুজ অংশ বা কেন্দ্রীয় বুরুজ। বৃত্তাকার এই বুরুজের উচ্চতা প্রায় ৯.১৪ মিটার এবং ব্যাস ৩২.৯১ মিটার। উপরের দিকে খোলা প্ল্যাটফর্ম রয়েছে। প্রাচীরের শীর্ষভাগ পদ্ম পাপড়ির মতো। প্রতিটি পাপড়ির মধ্যে একটি প্রধান ছিদ্র রয়েছে। কাছের ও দূরের শত্রু মোকাবেলার জন্য এর ভেতরে আরও ৪টি ছিদ্র রয়েছে। দুর্গের ভেতরে একটি জলাধারও রয়েছে।
পর্যবেক্ষণ টাওয়ার থেকে দুই স্তরে সিড়ি দুর্গের মাঝে জলাধারে নেমে গেছে। এ জলাধার রাখার উদ্দেশ্যে ছিল ভেতরের সৈন্যদের পানি সরবরাহ করা, আগুন থেকে রক্ষা পাওয়া এবং শুস্ক মৌসুমে পানি সংরক্ষণ করা। দক্ষিণ পাশে কেন্দ্রীয় বুরুজের উপর থেকে একটি গুপ্ত সিড়ি পথ নীচে নেমে গেছে। ভূগর্ভস্থ অস্ত্রাগার থেকে এ পথে অস্ত্র আনা হতো। উপর থেকে নীচে নামার সিড়ির সঙ্গে একটি গুপ্ত সিড়ি দেখা যায় যা পরবর্তীতে ঢেকে দেওয়া হয়। ধারণা করা হয়, এ গুপ্ত পথের সঙ্গে দূরবর্তী পর্যবেক্ষণ টাওয়ারের সংযোগ ছিল।
দুর্গের প্রবেশদ্বার উত্তর দিকে অবস্থিত। এর উচ্চতা ১৩ ফুট এবং প্রস্ত সাড়ে ৭ ফুট। প্রবেশদ্বারের উপরের অংশেও ছিদ্র রয়েছে। প্রবেশদ্বারটি মোগল স্থাপত্য শৈলীতে নির্মিত।
দুর্গের চারিদিকের দেয়ালের চার কোনায় সাড়ে ৩ ফুট প্রশস্তের ৪টি বুরুজ রয়েছে। বুরুজের পুরু দেয়ালে কামান বসানোর জন্য ছিদ্র রয়েছে। সামরিক কৌশলগত বিবেচনায় শত্রুর গতি ও আক্রমন থামাতে প্রাথমিক প্রতিরক্ষা স্তর হিসেবে ৩ ফুট উঁচু সীমানা প্রাচীর রয়েছে। এই প্রাচীরের পূর্ব পাশে একটি ছোট বুরুজ রয়েছে।
দুর্গের দেওয়াল নির্মাণে ব্যবহ্নত হয়েছে চুন, সুরকি, ইট, চুনের মিশ্রণ। চতুর্দিকের দেয়ালের উপরে তীর ধনুক ছোড়ার জন্য ছিদ্র রয়েছে। ২০১৫ সালে দুর্গটির সংস্কার করার সময় কেন্দ্রীয় উঁচু বুরুজের মেঝের মাটির নীচে শত শত বিশেষ ধরনের কলস পাওয়া যায়। ধারণা করা হয়, আদ্রতা প্রতিরোধক হিসেবে নির্মাণের সময় এসব কলস ব্যবহার করা হয়েছে। এই দুর্গে মীর জুমলার সবচেয়ে সৃজনশীল দিকটি হলো জলকে প্রতিরক্ষার অংশ হিসেবে ব্যবহার করা। ইদ্রাকপুর দুর্গের চারপাশে কৃত্রিম পরিখা ছিল, যেখানে নদীর পানি এনে জমা করা হতো। পানি থাকলে শত্রু দেয়ালের কাছে পৌঁছাতে পারতো না।
একসময় ইদ্রাকপুর দুর্গটি মহকুমা প্রশাসক এবং জেলা প্রশাসকদের বাসভবন ছিল। ব্রিটিশ শাসনামলে দুর্গের ভেতরে হাজতখানা নির্মাণ করা হয়। বর্তমানে সেখানে সংস্কার করে জাদুঘর নির্মাণ করা হয়েছে। ১৯০৯ সালে দুর্গটিকে পুরাকীর্তি হিসেবে ঘোষণা করা হয়। প্রতিদিন বিপুল সংখ্যক পর্যটক ইদ্রাকপুর দুর্গ পরিদর্শনে আসেন।