শিরোনাম

সুনামগঞ্জ, ৬ ডিসেম্বর, ২০২৫ (বাসস): ১৯৭১ সালের এই দিনে (৬ ডিসেম্বর) পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কবল থেকে মুক্ত হয় সুনামগঞ্জ। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে হটিয়ে সুনামগঞ্জকে শত্রুমুক্ত করেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা। এদিন শহর ছেড়ে পালিয়ে যায় হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা। বিজয় উল্লাসে মেতে ওঠা সাধারণ জনতা রাস্তায় নেমে আসেন। সেদিন বিজয়ের স্লোগানে স্লোগানে মুখর হয়েছিল সুনামগঞ্জ শহর। রণাঙ্গনের সেই স্মৃতি আজও প্রেরণা দেয় সম্মুখযুদ্ধে অংশে নেয়া মুক্তিযোদ্ধাদের। বিজয়লগ্নে শত্রুদের হাতে নিষ্ঠুর অত্যাচার আর মর্মান্তিকভাবে নিহত এবং আহত হওয়া শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের কথা স্মরণে এখনো গা শিউরে উঠে তাদের।
শহীদের স্মৃতিস্মরণে সুনামগঞ্জের সকল বধ্যভূমির রক্ষণাবেক্ষণ ও স্মৃতিফলক নির্মাণের দাবি জানিয়েছেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা।
সুনামগঞ্জের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস থেকে জানা যায়, ৫ ডিসেম্বর রাতে সুনামগঞ্জ বালাট সাব সেক্টরের কমান্ডার মেজর মোতালিব, ভারতীয় ক্যাপ্টেন যাদব ও রঘুনাথ ভাট বিশেষ দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে চরম আঘাত হানার পরিকল্পনা নেন। পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর ওপর আঘাত হানতে চারটি কোম্পানি প্রস্তুত করা হয়। ‘এ’ কোম্পানিকে যোগীরগাঁও, ‘বি’ কোম্পানি হালুয়ারঘাট, ‘সি’ কোম্পানি হাছননগর ও ‘ডি’ কোম্পানি ভাদেরটেক থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের অতর্কিত ও যৌথ আক্রমণে ভীতসন্ত্রস্ত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী শহর ছেড়ে পালাতে শুরু করে। সাঁড়াশি অভিযানের এক পর্যায়ে হাওরের নৌপথ ও সড়কপথে সিলেটের দিকে পালিয়ে যায় হানাদারবাহিনী।
এদিন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পালানোর সময় সুনামগঞ্জ পিটিআই টর্চারসেলে কয়েকজন বন্দীকে হত্যা করে। এছাড়াও কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে ধরে নিয়ে আহসানমারা সেতুর পাশে ব্রাশফায়ারে হত্যা করে। পিটিআই টর্চারসেল থেকে মুক্তিযোদ্ধারা অনেক মানুষের হাঁড়গোড়, নারীদের কাপড়চোপড়সহ বিবস্ত্র দেহ উদ্ধার করেন।
মুক্তিযুদ্ধে নিহত নর-নারীসহ বীর শহীদদের স্মৃতি স্মরণে পিটিআই বধ্যভূমিসহ জেলার সকল বধ্যভূমির সংরক্ষণের দাবি জানিয়েছেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা।
জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমান্ডের সাবেক কমান্ডার হাজী নূরুল মোমেন বলেন, ৯ মাস যুদ্ধ করার পর এদেশ স্বাধীন করেছি আমরা। বিজয়ের অনুভূতি প্রকাশ করার মতো নয়। যুদ্ধের সময় অনেক সাথী ভাইকে হারিয়েছি। তাদের কথা মনে হলে বুকের ভেতর আতকে ওঠে।
তিনি বলেন, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী অনেক মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে নিয়ে হত্যা করে মরদেহ বধ্যভূমিতে ফেলে যায়। পরবর্তীতে তাদের মরদেহ গণকবর দেয়া হয়। ইতোমধ্যে এসব কবর রক্ষণাবেক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।
বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু সুফিয়ান বলেন, একাত্তরের ৬ ডিসেম্বর আমরা যুদ্ধক্ষেত্রে ছিলাম। যখন আমাদের কাছে হানাদার বাহিনী পিছু হটার খবর আসলো, তখন আমরা আনন্দ উল্লাস করছিলাম। একদিকে আনন্দ, অন্যদিকে স্বজন হারানোর ব্যথা। আমার অনেক সঙ্গী যুদ্ধক্ষেত্রে শহীদ হয়েছেন। যা আজও মনে পড়লে গা শিউরে উঠে। আমাদের উচিত মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা।
সুনামগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্ব ছিল ইতিহাসের এক অনন্য দৃষ্টান্ত। শহর নয় গ্রাম ছিল প্রতিরোধের দুর্গ। কৃষক, জেলে, শ্রমিক, ছাত্র ও ব্যবসায়ীসহ সবাই মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোদ্ধা ছিলেন। কেউ আশ্রয় দিয়েছে, কেউ দিয়েছে খাদ্য, কেউ বা অস্ত্র সংগ্রহে সহায়তা করেছেন। তা ইতিহাসে অমর অধ্যায় হয়ে আছে। তবে স্বাধীনতার এত বছর পরও বেশ কিছু স্মৃতি, নির্যাতন কেন্দ্র ও ঐতিহাসিক চিহ্ন হারিয়ে যাচ্ছে অবহেলায়।
তাই স্থানীয়দের দাবি রাজাকারদের ভূমিকা, মুক্তিযোদ্ধাদের বিবরণ, বীরাঙ্গনা এবং শহীদদের তথ্য সংরক্ষণ জরুরি। নতুন প্রজন্মের সামনে সত্য ইতিহাস তুলে ধরাই এখন সময়ের দাবি বলে তারা মন্তব্য করেন।
সুনামগঞ্জ সদর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার আবদুল মজিদ বলেন, সুনামগঞ্জের নারায়নতলায় যুদ্ধের সেই দিনগুলোতে এক জায়গায় ৪৮ জন বীর শহীদকে সমাহিত করা হয়েছিল।
সদর উপজেলার অচিন্তপুর গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্বা নুরুল ইসলাম জানান, সুনামগঞ্জ মুক্তি সংগ্রাম স্মৃতি ট্রাস্টের উদ্যোগ ১৯৭৩ সালে নারায়নতলার ডলুরার গণকবরকে ঘিরে শহীদ স্মৃতিসৌধ গড়ে তোলা হয়।
তিনি বলেন, ওই সময় ডলুরার শহীদ স্মৃতিসৌধটি দেখাশোনার জন্য প্লাটুন কমান্ডার মধু মিয়াকে আহ্বায়ক করে একটি কমিটি গঠিত হয়। শুরুতে স্মৃতিসৌধের চারদিকে ৫ ফুট উঁচু সীমানা প্রাচীর এবং ৪৮ জন শহীদের একটি নামফলক নির্মাণ করে দেন ৫ নম্বর সেক্টরের সেলা সাব সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন এ এস হেলাল উদ্দিন।
বীর মুক্তিযোদ্বা আরো বলেন, পরবর্তী সময়ে তাঁর অর্থায়নেই এখানে দর্শনার্থীদের জন্য রেস্টহাউস নির্মাণ করা হয়। ২০০৮ সালে জেলা পরিষদ ‘ছায়াকুঞ্জ’ নির্মাণ করে। ২০১১ সালে নির্মাণ করা হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা ভাস্কর্য ও মুক্তিযোদ্ধা মঞ্চ। সদর উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে সমাধি এলাকার ব্যাপক সংস্কার করা হয়েছে। প্রতিটি সমাধিকে নতুনভাবে পাকা করা হয়েছে। লাগানো হয়েছে পূর্ণাঙ্গ নাম-ঠিকানাসহ নতুন নামফলক।
জেলা প্রশাসক ড. মুহাম্মদ ইলিয়াস মিয়া বাসসকে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত এলাকা সংরক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে জেলা প্রশাসন। ইতোমধ্যেই ডলুরা শহীদ মিনারসহ মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থানে অনেকগুলো ভালো কাজ করেছি আমরা। আগামীতেও এসব কাজ অব্যাহত থাকবে বলে জানান তিনি।