বাসস
  ০৩ জানুয়ারি ২০২৪, ২০:২৩

চট্টগ্রামের ৩ আসনে ভোটের সমীকরণ জটিল

চট্টগ্রাম, ৩ জানুয়ারি, ২০২৪ (বাসস) : আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চট্টগ্রামের ১৬টি আসনের মধ্যে তিনটিতে ভোটের সমীকরণ বেশ জটিল হয়ে ওঠেছে। গত কয়েকদিনে এ তিন আসনের সাধারণ ভোটারদের সাথে আলাপ করে এ চিত্র পাওয়া যায়।
ভোটাররা বলছেন, এসব আসনের কোনটিতে কে বিজয়ী হয়ে আসবেন তা বলা মুশকিল। আসনগুলো হচ্ছে : চট্টগ্রাম-২ ফটিকছড়ি, চট্টগ্রাম-৫ হাটহাজারী ও  চট্টগ্রাম-৮ বোয়ালখালী-চান্দগাঁও-পাঁচলাইশ (আংশিক)।
হাটহাজারী ও বোয়ালখালী আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী নেই। এ দুই আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী হাটহাজারীতে ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ এবং বোয়ালখালীতে সোলায়মান আলম শেঠ লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করছেন। 
চট্টগ্রাম-২ ফটিকছড়ি আসনে আওয়ামী লীগ থেকে সাবেক সংসদ সদস্য রফিকুল আনোয়ারের কন্যা, সংরক্ষিত আসনের বর্তমান এমপি খাদিজাতুল আনোয়ার সনিকে মনোনয়ন দেয়া হয়। কয়েকদিন আগে বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টির চেয়ারম্যান একতারা প্রতীকের প্রার্থী সৈয়দ সাইফুদ্দিন আহম্মদ মাইজভা-ারীকে সমর্থন দিয়ে সনিকে ভোটের মাঠ থেকে সরে যেতে বলে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ। কিন্তু প্রত্যাহারের শেষদিন অতিক্রম করায় কোন্ প্রক্রিয়ায় সনি সরে যাবেন সেটি কেন্দ্রের কাছে জানতে চেয়েছিলেন তিনি। গত ২০ ডিসেম্বর থেকে ২৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত আওয়ামী লীগের এ অবস্থান থাকলেও ৩১ ডিসেম্বর হাই কমান্ড সিদ্ধান্ত বদল করে খাদিজাতুল আনোয়ার সনির পক্ষে দলের সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেন। এদিন সিনিয়র দু-একজন নেতাকে ডেকে সনির পক্ষে কাজ করার নির্দেশনাও দেয়া হয়। এ আসনে গত তিন মেয়াদে নজিবুল বশর মাইজভা-ারী আওয়ামী লীগের সমর্থন নিয়ে বিজয়ী হয়েছেন। বাংলাদেশ ত্বরিকত ফেডারেশন (বিটিএফ)-এর প্রধান নজিবুল বশর এবারও নির্বাচন করছেন ফুলের মালা প্রতীক নিয়ে। 
ফটিকছড়ি উপজেলার সদ্য পদত্যাগী চেয়ারম্যান এসএম আবু তৈয়ব স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন তরমুজ প্রতীক নিয়ে। দীর্ঘদিন ছাত্র রাজনীতির সাথে যুক্ত থাকায় এবং জামায়াত-শিবিরের কবল থেকে ফটিকছড়িকে মুক্ত করতে গিয়ে ত্যাগ শিকার করায় এলাকায় তাঁর একটি শক্ত অবস্থান রয়েছে। আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন না পেলেও বিগত উপজেলা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন তিনি।  
ফলে, ফটিকছড়ির ভোটের হিসাব চট্টগ্রামের অন্য যেকোনো এলাকার চেয়ে জটিল। এখানে নৌকা প্রতীকের খাদিজাতুল আনোয়ার সনির সাথে এক সময়ে তাঁর পিতার ঘনিষ্ঠ কর্মী আবু তৈয়ব থাকায় আওয়ামী ঘরানার দুই প্রার্থী লড়ছেন ভোটে। অন্যদিকে, এ উপ-মহাদেশের অন্যতম ধর্মীয় ত্বরিকা মাইজভা-ার দরবার শরিফের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে ফটিকছড়িতে। এবার এ ত্বরিকার ভক্তরা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। আগের তিনটি নির্বাচনে সৈয়দ নজিবুল বশর এ ত্বরিকার একক প্রার্থী ছিলেন। আওয়ামী লীগও তাঁকে সমর্থন দিয়েছিল। ফলে, আগামী ৭ জানুয়ারি সাধারণ ভোটারের ভোট কার ঘরে বেশি পড়বে তা বলা বেশ কঠিন। 
চট্টগ্রাম-৫ হাটহাজারী আসনে উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এমএ সালামকে মনোনয়ন দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। তিনি মনোনয়ন ফরম জমা দেন। পরে প্রত্যাহারের সময়সীমার মধ্যে দলীয় সিদ্ধান্ত মতে তিনি প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেন। জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় নেতা ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ এ আসনে লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করছেন। তিনি গত তিন মেয়াদে এ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে আসছেন। আওয়ামী লীগ সরকারেরই পানি সম্পদ মন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেছেন পাঁচ বছর। এবারও তিনি আওয়ামী লীগের সমর্থন নিয়ে আওয়ামী ঘরানার ভোট পাওয়ার প্রত্যাশা করছেন। তবে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী মোহাম্মদ শাহজাহান। আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতা হিসেবে পরিচিতি আছে তাঁর। চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক এ নেতা কেটলি মার্কা নিয়ে ভোটারের কাছে যাচ্ছেন।
চট্টগ্রাম-৮ বোয়ালখালী-চান্দগাঁও-পাঁচলাইশ (আংশিক) আসনে উপ-নির্বাচনে বিজয়ী আওয়ামী লীগের এমপি নোমান আল মাহমুদকে মনোনয়ন দেয়া হয়েছিল। মনোনয়ন ফরম জমা দেয়ার পর দলীয় সিদ্ধান্ত মেনে তিনিও প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নেন। জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় নেতা সোলায়মান আলম শেঠ লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করছেন। অন্যান্য প্রার্থীদের মধ্যে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুছ ছালাম কেটলি মার্কা ও  মহানগর আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সদস্য বিজয় কুমার চৌধুরী ফুলকপি প্রতীক নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ভোটের লড়াইয়ে আছেন। 
ভোটের জটিল এ সমীকরণকে ঘিরে এ আসনে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা এখন দুই ভাগে বিভক্ত। স্বতন্ত্র প্রার্থী আবদুচ ছালামের পক্ষে বোয়ালখালী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নুরুল আমিন চৌধুরী, পৌরসভা আওয়ামী লীগের সভাপতি শফিউল আলম ও সাধারণ সম্পাদক এসএম জাকারিয়াসহ তাদের অনুসারীরা কেটলি প্রতীকের নির্বাচনী প্রচারণা করছেন। অন্যদিকে স্বতন্ত্র প্রার্থী বিজয় কুমার চৌধুরীর পক্ষে বোয়ালখালী পৌরসভার মেয়র ও দক্ষিণজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক জহুরুল ইসলাম জহুর, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান রেজাউল করিম রাজাসহ তাদের অনুসারীরা প্রচারণা চালাচ্ছেন।
কেটলির পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণার ব্যাখ্যা দিতে গেয়ে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নুরুল আমিন চৌধুরী গণসংযোগ ও উঠান বৈঠকে বলছেন, যেহেতু চট্টগ্রাম-৮ আসনে নৌকার প্রার্থী নেই, তাই, নির্বাচনকে উৎসবমুখর করতে জেলা ও কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে পছন্দের প্রার্থীর পক্ষে কাজ করতে বাধা নেই। দলীয় কোনো সিদ্ধান্ত যখনই পাবো তখনই আমরা সে অনুযায়ী কাজ করবো। এখনো পর্যন্ত উৎসবমুখর পরিবেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত রয়েছে। কোনো প্রার্থীকে বাধা প্রদান করা যাবে না। প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা যাবে না। আমি কেটলি প্রতীকের আবদুচ ছালামের পক্ষে প্রচার প্রচারণা করছি। অন্য কেউ যাকে পছন্দ তার পক্ষে কাজ করবে। 
ফুলকপি প্রতীকের পক্ষে মাঠে নামার কারণ ব্যাখ্যায় দক্ষিণ জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক জহুরুল ইসলাম জহুর বলেন, আমরা অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি করি। কে কাকে ভোট দেবে সেটা বলা যাচ্ছে না। আমি বিজয় কুমার চৌধুরীর পক্ষে কাজ করছি সেটা সবাই জানে। সে বোয়ালখালীর সন্তান বিধায় তাঁর পক্ষে রয়েছি।
স্বতন্ত্র প্রার্থী আবদুচ ছালাম বলেন, নৌকা প্রতীক নিয়ে প্রার্থী থাকুক আর না থাকুক জননেত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন সাধারণ ভোটাররা যেন ভোটকেন্দ্রে যায় সে পরিবেশ সৃষ্টি করতে। আর স্বতন্ত্র প্রার্থী হতেও কোনো বাধা নেই। সে হিসেবে প্রার্থী হয়েছি। মাঠে নৌকা না থাকায় সাধারণ জনগণ ও রাজনীতিবিদরা যাকে খুশি ভোট দিতে পারেন। যিনি উন্নয়ন করতে পারবেন বলে জনগণ মনে করেন তাঁর পক্ষেই থাকবেন, তাকেই ভোট দেবেন। আমি সিডিএ চেয়ারম্যান থাকাকালে নগরীর ৪১টি ওয়ার্ডকে সাজিয়েছি। বেশ কয়েকটি ফ্লাইওভার এবং জটিল রাস্তা সম্প্রসারণ ও নতুন রাস্তা করে যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়ন সাধন করেছি। নির্বাচনে বিজয়ী হলে এ এলাকার জনপ্রতিনিধির দাবি নিয়ে বোয়ালখালী এবং চান্দগাঁও-পাঁচলাইশ এলাকার উন্নয়ন করা কোনো বিষয় নয়। আমি নির্বাচিত হলে বোয়ালখালীকে একদিন পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে বিশ্বের দরবারে উপস্থাপন করা হবে। সুতরাং বোয়ালখালীবাসীসহ এ আসনের ভোটাররা আমার প্রতি আস্থা রাখবেন বলে মনে করি। 
অপর স্বতন্ত্র প্রার্থী বিজয় কুমার চৌধুরী বলেন, আমি বোয়ালখালীর সন্তান। সুতরাং বোয়ালখালীর জনসাধারণ বোয়ালখালীর ছেলেকেই নির্বাচিত করবে।
অন্যদিকে বোয়ালখালী এবং চান্দগাঁও-পাঁচলাইশ এলাকায় জাতীয় পার্টি প্রার্থী সোলাইমান আলম শেঠ লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে প্রচারণা চালাচ্ছেন। এ আসনে আওয়ামী লীগের মতো শক্ত সাংগঠনিক ভিত্তি নেই জাতীয় পার্টির। তিনি প্রচারণার পাশাপাশি আওয়ামী লীগের দলীয় সমর্থন পাওয়ার জন্যই বেশি চেষ্টা করছেন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়