বাসস
  ২৩ জুন ২০২৩, ১২:৩৮

নীলফামারীর চেকাদারা নদীর স্লুইচ গেট বদলে দিয়েছে ১০ হাজার কৃষকের ভাগ্য

॥ ভুবন রায় নিখিল ॥
নীলফামারী, ২৩ জুন, ২০২৩ (বাসস) : জেলার ডোমার উপজেলায় চেকাদারা নদীর বাবুল দোলা স্লুইচ গেট ভাগ্য বদলের দুয়ার খুলে দিয়েছে ১০ হাজার কৃষকের। ওই স্লুইচ গেটটি ঘিরে নতুন করে ভাগ্য বদলে স্বপ্ন বুনতে শুরু করেছে এসব কৃষক।
কৃষকরা জানান, দেশ স্বাধীনের পর থেকে উপজেলার বোড়াগাড়ি ইউনিয়নের নয়ানী বাগডোকরা গ্রামে চেকাদারা নদীতে বাবুল দোলায় একটি স্লুইচ গেটের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন তারা। দীর্ঘ প্রতিক্ষার পর পূরণ হয়েছে তাদের সে স্বপ্ন। এখন সেটির সুফলে কম খরচে জমিতে ফলবে অধিক ফসল, কৃষিতে যুক্ত হবে পতিত জমি, রক্ষা হবে পরিবেশ ও প্রকৃতি। অধিক ফসলে ভাগ্য বদল হবে এলাকার ছোট-বড় কৃষকের।
ক্ষুদ্রাকার পানি সম্পদ প্রকল্পের অধীনে দুই কোটি ২৬ লাখ ১৬ হাজার ৬১৮ টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ (এলজিইিড)। ২০২০-২০২১ অর্থবছরে গৃহিত প্রকল্পটির নির্মানকাজ শেষ হয় চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে।
বাস্তবায়নকারী সংস্থা এলজিইডির তথ্য মতে, স্লুইস গেটটি নির্মাণের ফলে বোড়াগাড়ি ইউনিয়নটির নয়ানী বাগডোকরা ও বাগডোকরা গ্রামের ৩ হাজার বিঘা (৪০০ হেক্টর) জমি শুস্ক মৌসুমে সরাসরি সেচ সুবিধা পাবে। এসব জমিতে বাড়তি ফসল (ধানসহ অন্যান্য) উৎপাদন হবে ৩৫০ টন। যার বাজার মূল্য ১ কোটি টাকার উপরে। পাশপাশি রক্ষা হবে প্রকৃতি ও পরিবেশ। নদীর পানি ধরে রাখার ফলে বৃদ্ধি পাবে ভূগর্ভস্থ পানি স্তর। এতে করে ওই দুই গ্রামসহ আশপাশের গ্রামের জমির উর্বরা শক্তি বৃদ্ধি পাবে বহুগুণে। এক ফসলী জমি দুই ফসলীতে এবং দুই ফসলী জমি পরিণত হবে তিন ফসলীতে। এতে করে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ওই দুই গ্রামের ১০ হাজার কৃষক উপকৃত হবে।
ডোমার উপজেলা প্রকৌশল দপ্তর জানায়, ওই প্রকল্পটির ধারাবাহিকতায় চেকাদারা নদীর পানি ধারণ ক্ষমতা বাড়াতে ৩ হাজার ৩৭৫ মিটার খনন করা হয়। এরপর বোড়াগাড়ি ইউনিয়নের নয়ানী বাগডোকরা ও বাকডোকরা গ্রামের মিলনস্থলে নির্মাণ করা হয় হার্ডবেন্টারি রেগুলেটর। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের ফলে অতি বৃষ্টিতে যেমন বন্যার সৃষ্টি হবে না,  তেমনি রেগুলেটরের মাধ্যমে পানি সংরক্ষণ করা সম্ভব হবে। সেই পানি কৃষিতে ব্যবহারের ফলে কৃষকের সেচ খরচ কমবে অন্যদিকে সারফেজ ওয়াটারকে সর্বোত্তম ব্যবহারের মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ পানিরস্তর কাছাকাছি রেখে সমগ্র এলাকার জমির উর্বরতা বৃদ্ধি শক্তি বৃদ্ধি পাবে বহুগুণে। নদীতে সারাবছর পানি থাকায় বাড়বে দেশীয় মাছের উৎপাদন। বিচরণ বাড়বে নানা প্রজাতির উপকারী পাখির সংখ্যা। এতে করে রক্ষা হবে পরিবেশ ও প্রকৃতি।
ওই প্রকল্পটি ঘিরে গড়ে উঠেছে কৃষকেদের নিয়ে বাবুল দোলা পানি ব্যবস্থাপনা সমবায় সমিতি নামে একটি সংগঠন। ৩০১ জন সদস্য নিয়ে গঠিত সমিতিটি দায়িত্ব নিয়েছে পানি ব্যবস্থাপনার। সমিতি পানি ব্যবস্থাপনার পাশপাশি প্রকল্পের রির্জভারে শুরু করেছে মৎস্যচাষ, গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগি পালন। পাখিদের অভয়াশ্রম ঘোষণা করে ভূমিকা রাখছে পরিবেশ ও প্রকৃতি রক্ষায়।
কৃষক চন্দ্র কিশোর রায় সদস্য হয়েছেন ওই সমিতির। প্রকল্প এলাকায় রয়েছে তার ৫০ বিঘা আবাদী জমি। তিনি বলেন, ‘প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হওয়ায় আমরা আশার আলো দেখতে শুরু করেছি। ইতোমধ্যে সুফল পেতে শুরু করেছি আমরা। নদীর পানির সেচে গত শুস্ক মৌসুমে বোরো মৌসুমে বোরো আবাদ করা সম্ভব হয়েছে। এতে খরচ যেমন কমেছে ধানও ফেলেছে বেশি। প্রাকৃতিক পানি ব্যবহারে জমির উৎপাদন শক্তি বেড়েছে, ক্ষেতে রোগ-বালাই ও পোকামাকড়ের আক্রমণ না থাকায় কমেছে বালাই নাশকের ব্যবহার’।
ওই প্রকল্প এলাকায় কৃষক রমেশ চন্দ্র রায়ের ২৫ বিঘা, গোবিন্দ চন্দ্র রায়ের ২৫ বিঘা, যোগেন্দ্র রায়ের ৭৫ বিঘা, বিষ্ণুপদ চাট্যার্জীর ২৫ বিঘা, ভুপেন্দ্র নাথ রায়ের দুই বিঘা জমি রয়েছে। ওই প্রকল্পের সুফলে তারাসহ এলাকার সব কৃষক দেখতে শুরু করেছেন আশার আলো।
সমিতির সাধারণ সম্পাদক  পরিমল চন্দ্র রায় বলেন, ‘নদীর পানি ব্যবহারে চাষাবাদে কমেছে উৎপাদন খরচ। এখন পতিত জমিতে ফসল ফলানো সম্ভব হচ্ছে। উঁচু জমিতে খুব সহজে শাক-সবজীসহ নানা ধরণের ফসল ফলানো সম্ভব হচ্ছে। নিচু জমিতে নামমাত্র খরচে সেচের মাধ্যমে ধান আবাদ করা যাচ্ছে। বেড়েছে জমির উর্বরা শক্তি, বৃদ্ধি পেয়েছে উৎপাদন। এতে করে খুলেছে এলাকার কৃষকদের ভাগ্য বদলের দুয়ার’।
তিনি জানান, নদীর পানিতে বেড়েছে হাঁস পালন। সারা বছর পানি থাকায় বা[ড়তে শুরু করেছে দেশীয় প্রজাতির মাছের উৎপাদন।
সমিতির সভাপতি জগদীশ চন্দ্র রায় জানান, চেকাদারা নদীর ধার ঘেঁষে নয়ানী বাগডোকরা ও বাগডোকরা গ্রামের অন্তত ১০ হাজার পরিবারের বাস। এসব পরিবারের দুঃখ ছিল ওই নদীটি। ধারণ ক্ষমতা না থায় বর্ষায় ঢলের পানিতে বন্যা, আবার শুকনো মৌসুমে পানির অভাবে আবাদ সম্ভব হতো না। এখন নদী খনন করায় পানি ধারণ ক্ষমতা বেড়েছে, তেমনি স্লুইচ গেটটি হওয়ায় ওই পানি দিয়ে কৃষির সুবিধা বেড়েছে।
তিনি বলেন,‘দেশ স্বাধীনের পর থেকে আমাদের আকাঙ্খা ছিল একটি স্লুইচ গেটের। দীর্ঘদিন পরে হলেও আমাদের প্রত্যাশা পূরণ করেছে সরকার। এজন্য এলাকার সব কৃষক খুশি। স্লুইচ গেটের সুফলে কৃষকরা ভাগ্য পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে’।
ডোমার উপজেলা প্রকৌশলী মো. মোস্তাক আহমেদ বলেন,‘ ওই উপ-প্রকল্পটি বাস্তবায়নের ফলে বোড়াগাড়ি ইউনিয়নটির বাগডোকরা এবং নয়ানী বাগডোকরা গ্রামে কৃষি ও মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থান পরিবর্তন হবে। রক্ষা হবে পরিবেশ ও প্রকৃতি’।

 

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়