শিরোনাম

ঢাকা, ২২ নভেম্বর, ২০২৫ (বাসস) : জার্মান রাষ্ট্রদূত ড. রুডিগার লোটজ বলেছেন, বাংলাদেশের চলমান গণতান্ত্রিক রূপান্তর শুধু দেশের অভ্যন্তরেই নয়, সীমান্ত পেরিয়ে আঞ্চলিকভাবেও গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দিচ্ছে।
বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে গণতন্ত্র যখন চাপের মুখে, সেই মুহূর্তে আগামী ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় নির্বাচনকে এক ‘শক্তিশালী সংকেত’ হিসেবে বর্ণনা করেন তিনি।
বাসস’কে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে রাষ্ট্রদূত বলেন, কৌশলগত গুরুত্ব, তরুণ জনগোষ্ঠী ও রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে নির্বাচনের মাধ্যমে দেশটির গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তন আঞ্চলিকভাবে ব্যাপক দৃষ্টি কাড়বে বলে বিশ্বাস করি।
তিনি বলেন, এই রূপান্তর বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেশটি আগামী বছর গণতন্ত্রে ফিরতে যাচ্ছে। প্রায় ১২ কোটি ৭০ লাখ ভোটারের অংশগ্রহণে বিশ্বের অন্যতম বড় এ গণতান্ত্রিক নির্বাচন হতে যাচ্ছে।
রাষ্ট্রদূত আরো বলেন, গণতন্ত্রের নতুন পথচলা দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে, বিশেষ করে তরুণদের কাছে সুস্পষ্টভাবে পৌঁছাবে। পাশাপাশি ভোটের প্রস্তুতিতে সব অংশীজনের অংশগ্রহণ তাকে আশাবাদী করেছে।
আগামী নির্বাচনের প্রকৃতি নিয়ে তিনি বলেন, রাজনৈতিক দল, নির্বাচন কমিশন ও অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যে উৎসাহব্যঞ্জক সাড়া দেখেছি।
ড. রুডিগার লোটজ বলেন, বাংলাদেশে দরকার অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। যাদের সঙ্গেই কথা হয়েছে, সবাই এই লক্ষ্য অর্জনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
তিনি প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ‘উৎসবমুখর নির্বাচন’ আহ্বানকেও স্বাগত জানান। রাষ্ট্রদূতের ভাষ্য, এই ধারণা বাংলাদেশের নতুন গণতান্ত্রিক উদ্দীপনার চিত্র ফুটিয়ে তোলে।
ড. রুডিগার আরো বলেন, নানা মত-পথের রাজনৈতিক দল জোরেশোরে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। তাই অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হবে বলে আমি আশাবাদী।
জার্মান রাষ্ট্রদূত অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রমেরও প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, অস্থির সময়েও সরকার স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে পেরেছে এবং কঠোর সময়সীমার মধ্যেই বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার এগিয়ে নিচ্ছে।
তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রম উল্লেখযোগ্য। চব্বিশের আগস্টের পর প্রত্যাশা ছিল অনেক বেশি। অথচ সংস্কার করতে তাদের হাতে ছিল মাত্র এক বছরের একটু বেশি সময়।
রূপান্তর পরবর্তী অস্থিরতার মধ্যেও বাংলাদেশের অর্থনীতি স্থিতিশীল: রাষ্ট্রদূত বলেন, ক্ষমতার পালাবদল পরবর্তী সময়ে বিশ্বের অনেক দেশ অর্থনৈতিক অস্থিরতার মুখে পড়েছে। কিন্তু, বাংলাদেশের প্রশাসনের সবচেয়ে বড় সাফল্যগুলোর একটি হলো— অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা।
তিনি আরো বলেন, ‘বাংলাদেশ প্রবৃদ্ধির উচ্চ হার ধরে রেখেছে এবং মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ রেখে মুদ্রাবাজারকে স্থিতিশীল করেছে। এটি নিঃসন্দেহে বড় সাফল্য।
তিনি বিচারব্যবস্থা ও শ্রমখাতে অন্তর্বর্তী সরকারের বিভিন্ন সংস্কার উদ্যোগের প্রশংসা করেন এবং এগুলোকে দেশের ভবিষ্যতের জন্য ‘অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ’ বলে উল্লেখ করেন।
রাষ্ট্রদূত বলেন, আইনব্যবস্থা, আইনশৃঙ্খলা, নিরাপত্তা খাত পরিচালনা ও ব্যবসায়িক পরিবেশের উন্নয়নে এখনো বড় ধরনের সংস্কার বাকি রয়েছে। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের নেওয়া উদ্যোগগুলোও ব্যাপক প্রশংসা কুড়িয়েছে।
তিনি বলেন, জুলাই সনদের মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকার বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে ঐকমত্য গড়ার চেষ্টা করেছে। এটি সত্যিই প্রশংসনীয়।
দীর্ঘমেয়াদি প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে নতুন সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পরও সব রাজনৈতিক দলের ধারাবাহিক ভূমিকার ওপরও জোর দেন রাষ্ট্রদূত।
তিনি বলেন, জুলাই সনদ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অন্তর্বর্তী সরকারের শুরু করা সংস্কার এগিয়ে নিতে রাজনৈতিক দলগুলোর স্পষ্ট অঙ্গীকার এতে প্রতিফলিত হয়েছে। কোন সংস্কারকে অগ্রাধিকার দিতে হবে, সনদটি সে দিকনির্দেশনাও দেয়। পাশাপাশি নির্বাচনের পরও সংস্কারের ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করে।
রাষ্ট্রদূত বলেন, বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচনে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) বড় একটি নির্বাচন পর্যবেক্ষক দল পাঠানোর সম্ভাবনা রয়েছে।
তিনি বলেন, এ বিষয়ে এখনো আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে, আমি আশাবাদী— এটিই হবে এবং ইইউ মিশনে উল্লেখযোগ্য জার্মান প্রতিনিধিরাও থাকবেন।
তিনি জানান, এ ধরনের মিশনের জন্য বাংলাদেশ সরকারের আনুষ্ঠানিক আমন্ত্রণ প্রয়োজন।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের বহর নবায়নে এয়ারবাস ও বোয়িংয়ের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রস্তাবের বিষয়ে রাষ্ট্রদূত বলেন, আলোচনা চলমান রয়েছে।
তিনি আরো বলেন, ‘বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের এবং জ্বালানি-সাশ্রয়ী উড়োজাহাজ প্রয়োজন। এই চাহিদা মেটাতে এয়ারবাস বেশ ভালো অবস্থানে আছে।’
তিনি বলেন, ইউরোপীয় রাষ্ট্রদূতরা ‘এয়ারবাসের পাশে আছেন’। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের হাতেই থাকবে। পাশাপাশি ‘যেকোনো চুক্তি ন্যায্য হওয়া উচিত’ বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
রাষ্ট্রদূত বলেন, জার্মান কোম্পানিগুলো এশিয়ায় তাদের ব্যবসা সম্প্রসারণ করছে। তাই জার্মান বিনিয়োগকারীদের কাছে বাংলাদেশও আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি বাড়ছে এবং তরুণ ও দক্ষ জনশক্তি থাকায় বাংলাদেশ ব্যবসার জন্য আকর্ষণীয় জায়গা হয়ে উঠেছে। দক্ষিণ, মধ্য ও পূর্ব এশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যের সংযোগস্থলে বাংলাদেশের কৌশলগত অবস্থান হওয়ায় তা এই দেশকে বাড়তি সুবিধা দিচ্ছে।
রাষ্ট্রদূত বলেন, জার্মান ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদলকে বাংলাদেশে আনতে এবং সুযোগ খুঁজতে তিনি সক্রিয়ভাবে কাজ করবেন।
বাংলাদেশের সম্ভাবনার প্রশংসা করলেও রাষ্ট্রদূত বলেন, ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়ার মতো আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে।
তিনি বলেন, বিনিয়োগকারীরা নিয়মের স্বচ্ছতা, তা কীভাবে বাস্তবায়ন তার পরিষ্কার ধারণা রাখা এবং আইনি নিশ্চয়তা খোঁজেন।
তিনি আরো উল্লেখ করেন, শুল্ক ব্যবস্থা, উচ্চ কর, দুর্নীতি ও অবকাঠামো ক্ষেত্রে উন্নয়ন জরুরি।
রাষ্ট্রদূতের মতে, ব্যবসার জন্য আইনি ও নীতিগত স্থিতিশীলতা দরকার, আর তা নির্ভর করে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও আইনের শাসনের ওপর।
তিনি উল্লেখ করেন, আগামী দিনে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে পোশাকের বাইরেও নতুন খাত গড়ে তোলা জরুরি।
রাষ্ট্রদূত ওষুধ শিল্পকে জার্মান বিনিয়োগের অন্যতম সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, কিছু বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে ইউরোপীয় বাজারে অনুমোদিত ওষুধ উৎপাদন করছে, যা বেশ তাৎপর্যপূর্ণ সাফল্য।
তিনি লজিস্টিকস, বিমান খাত ও চিকিৎসা সরঞ্জামকে সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র হিসেবে উল্লেখ করে পরিবেশবান্ধব জ্বালানিতে সহযোগিতার সম্ভাবনাও ব্যাপক বলে মন্তব্য করেন।
তিনি বলেন, সৌর ও বায়ু শক্তি ব্যবহার এবং জ্বালানি সাশ্রয় বাড়ানো গুরুত্বপূর্ণ। পরিবেশ উন্নতির প্রয়োজনীয়তা নতুন সবুজ জ্বালানি প্রকল্প ও সার্কুলার অর্থনীতির সুযোগ তৈরি করছে।
রাষ্ট্রদূত বলেন, ২০২৬ সালে এলডিসি থেকে উত্তরণের পর ইউরোপীয় ইউনিয়নের জিএসপি প্লাস সুবিধা পেতে বাংলাদেশকে সংস্কার কাজ ধারাবাহিকভাবে চালিয়ে যেতে হবে।
তিনি বলেন, জিএসপি প্লাস একটি কঠিন প্রক্রিয়া। এতে মানবাধিকার, শ্রম অধিকার, পরিবেশ সুরক্ষা ও সুশাসনসহ বহু আন্তর্জাতিক সনদ বাস্তবায়ন করতে হয়।
তিনি উল্লেখ করেন, অগ্রগতি হয়েছে ঠিকই, তবে আরো সংস্কার দরকার। জার্মানি ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন এ নিয়ে বাংলাদেশকে সহযোগিতা করবে বলেও আশ্বাস দেন তিনি।
তিনি বলেন, বৈচিত্র্য ও মূল্য সংযোজন ছাড়া দীর্ঘমেয়াদি প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা সম্ভব নয়।
রাষ্ট্রদূত ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য বাংলাদেশের প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, কঠিন পরিস্থিতিতেও তাদের মৌলিক চাহিদা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ অসাধারণ কাজ করেছে।
পাশাপাশি, তিনি আন্তর্জাতিক সহায়তা অব্যাহত রাখা এবং মিয়ানমারের ওপর নতুন করে কূটনৈতিক চাপ সৃষ্টিরও আহ্বান জানান।
ভিসার জন্য শিক্ষার্থী ও পরিবারগুলোকে দীর্ঘ অপেক্ষা করতে হয়। রাষ্ট্রদূত বিষয়টিকে স্বীকার করে বলেন, জার্মান বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি নিশ্চিত হলে বছরের পর বছর অপেক্ষায় রাখা উচিত নয়।
তিনি উল্লেখ করেন, দক্ষতা বাড়ানো ও জনবল বৃদ্ধির পাশাপাশি ভিসা প্রক্রিয়া আধুনিকায়নের কাজ চলছে। ছয় মাস পর পরিস্থিতি উন্নত হবে বলে তিনি আশা করেন।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ-জার্মানি সম্পর্ক উল্লেখযোগ্যভাবে সম্প্রসারিত হওয়ার পথে রয়েছে।
তিনি বলেন, রাজনৈতিক সম্পর্ক আরো গভীর করা, অর্থনৈতিক সহযোগিতা বাড়ানো এবং চলাচল সহজ হলে বাংলাদেশ-জার্মানি সম্পর্কের ভবিষ্যৎ অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক।
তিনি বলেন, যদি আমরা রাজনৈতিক সম্পর্ক সুদৃঢ় করতে পারি, অর্থনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করতে পারি এবং চলাচল সহজ করতে পারি— তাহলে বাংলাদেশ-জার্মানি সম্পর্কের ভবিষ্যৎ অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক।