বাসস
  ১৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ১০:১৮

হাড় ক্ষয় ও ব্যথা নিয়ন্ত্রণে ওষুধ নয়, জীবনযাপনই মূল : ডা. এম এ শাকুর

বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএমইউ)-এর ফিজিক্যাল মেডিসিন ও রিহ্যাবিলিটেশন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. এম এ শাকুর। ছবি: বাসস

বরুন কুমার দাশ ও আব্দুর রউফ

ঢাকা, ১৮ ডিসেম্বর, ২০২৫ (বাসস) : বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শরীরে হাড়ের ক্ষয় ও ব্যথাজনিত নানা সমস্যা দেখা দেয়। এসব সমস্যা মোকাবিলায় শুধু ব্যথানাশক ওষুধের ওপর নির্ভর করলে চলবে না। এর জন্য প্রয়োজন সঠিক ব্যায়াম এবং দৈনন্দিন জীবনযাপনের ধরনে পরিবর্তন।

বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএমইউ)-এর ফিজিক্যাল মেডিসিন ও রিহ্যাবিলিটেশন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. এম এ শাকুর বাসসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন।

তিনি বলেন, ‘সাধারণত ২৫ বছর বয়স পর্যন্ত মানুষের শারীরিক বৃদ্ধি অব্যাহত থাকে। এরপর ধীরে ধীরে শরীরে ক্ষয়জনিত পরিবর্তন শুরু হয়। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অস্টিওআর্থ্রাইটিস, অস্টিওপোরেসিস, রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসসহ বিভিন্ন জয়েন্টের রোগ দেখা দিতে পারে। আবার অল্প বয়সীদের মধ্যেও অনেক সময় অ্যানকাইলজিং স্পন্ডাইলাইটিস দেখা যায়। সময়মতো সঠিক চিকিৎসা না নিলে এসব রোগ দীর্ঘমেয়াদে জটিল আকার ধারণ করতে পারে।’

ডা. শাকুর বলেন, ‘আমাদের দেশে সাধারণভাবে যে সমস্যাটিকে ‘হাড়ের ক্ষয়’ বলা হয়, চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় সেটিই অস্টিওপোরেসিস। পুরুষদের তুলনায় নারীদের মধ্যে এই রোগ বেশি দেখা যায়। বিশেষ করে মেনোপজ (মাসিক) বন্ধ হওয়ায় পর নারীদের হাড় ক্ষয়ের মাত্রা বেড়ে যায়। এ সময় কোমর, ঘাড় ও পিঠব্যথা খুব সাধারণ সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। বেশিরভাগ মানুষ এসব ব্যথায় শুধু ব্যথানাশক ওষুধ খান। কিন্তু এতে স্থায়ী সমাধান হয় না। এসব ব্যথার চিকিৎসায় ওষুধের পাশাপাশি রিহ্যাবিলিটেশন (পুনর্বাসন) অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’

তিনি বলেন, ‘রিহ্যাবিলিটেশনের মূল বিষয় হলো রোগী কীভাবে বসবেন, হাঁটবেন, কাজ করবেন এবং দৈনন্দিন জীবনযাপন করবেন; এসব বিষয়ে সঠিক দিকনির্দেশনা দেওয়া। যেমন, দীর্ঘসময় কম্পিউটারে কাজ করা ব্যক্তিদের বসার ভঙ্গি ও কম্পিউটার ব্যবহারের নিয়ম জানা জরুরি। একইভাবে বাথরুম ব্যবহারের পদ্ধতি বা হাই কমোড প্রয়োজন কি-না; এসব বিষয়ও রোগীকে সহজভাবে বুঝিয়ে দিতে হয়। এতে ব্যথা কমে এবং ভবিষ্যতের জটিলতা এড়ানো যায়।’

বয়স বাড়ার সঙ্গে হাড়ের পরিবর্তনের বিষয়টি একটি সহজ উদাহরণের মাধ্যমে বুঝিয়ে দেন ডা. এম এ শাকুর। 

তিনি বলেন, ‘দীর্ঘদিন একটি হাতুড়ি দিয়ে কাজ করলে যেমন এর মাথা চ্যাপ্টা হয়ে যায় এবং আয়তন বাড়ে, মানুষের হাড়ের ক্ষেত্রেও ঠিক তেমনই ঘটে। ২০ থেকে ৬০ বছর বয়স পর্যন্ত নিয়মিত হাঁটাচলা ও দৌড়ঝাঁপে পায়ের গোড়ালি, হাঁটু ও কোমরের হাড়ের ওপর প্রতিনিয়ত চাপ পড়ে। একপর্যায়ে এতে হাড়ের সারফেস এরিয়া বা আয়তন বেড়ে যায়। একে চিকিৎসাবিজ্ঞানে ‘ডিজেনারেটিভ চেঞ্জ’ বলা হয়। এটি বয়সের সঙ্গে বাড়তে থাকা একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এ অবস্থায় নিয়মিত চিকিৎসার পাশাপাশি জীবনযাপনের ধরন পরিবর্তন করা জরুরি।’

চিকিৎসা পদ্ধতি ও আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার সম্পর্কে জানতে চাইলে বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক বলেন, ‘ফিজিক্যাল মেডিসিনে ওষুধের পাশাপাশি বিভিন্ন মডালিটিস (যান্ত্রিক পদ্ধতি) ব্যবহার করা হয়। এর মধ্যে শর্টওয়েভ, মাইক্রোওয়েভ, আল্ট্রাসাউন্ড, ইনফ্রারেড, ইলেকট্রোথেরাপি ও আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মি অন্যতম।

তবে শুধু মেশিন নয়, রোগীদের দৈনন্দিন কাজকর্মে সঠিক নিয়ম মেনে চলা (অ্যাক্টিভিটিস অব ডেইলি লিভিং, এডিএল) সম্পর্কেও নির্দেশনা দেওয়া হয়।’

ব্যায়ামের গুরুত্ব তুলে ধরে ডা. শাকুর বলেন, ‘শরীর গঠনের জন্য যেমন ব্যায়াম দরকার, তেমনি রোগ থেকে মুক্তি পেতেও ব্যায়ামের কোনো বিকল্প নেই। সব চিকিৎসার কেন্দ্রবিন্দু হলো ব্যায়াম। সঠিক ব্যায়ামে জয়েন্ট শক্তিশালী হয়, ব্যথা কমে এবং চলাফেরা সহজ হয়। তবে কোন রোগে কোন ধরনের ব্যায়াম প্রয়োজন, তা সঠিকভাবে জানা জরুরি।’

তিনি বলেন, ‘গ্রামের নারীরা অনেক সময় নিচু হয়ে চুলায় ফুঁ দিয়ে রান্না করেন কিংবা ঝুঁকে ঝাড়ু দেন। দীর্ঘদিনের এই অভ্যাসে মেরুদণ্ডের ওপর অতিরিক্ত চাপ পড়ে এবং হাড় বেড়ে গিয়ে তীব্র ব্যথার সৃষ্টি হয়।’

এ সমস্যার সমাধানে পরিবেশগত পরিবর্তনের (এনভায়রনমেন্টাল মডিফিকেশন) পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ‘রান্নার চুলা উঁচুতে স্থাপন করতে হবে। তা সম্ভব না হলে মোড়া বা চেয়ারে বসে রান্না করতে হবে, যাতে মেরুদণ্ডের ওপর চাপ না পড়ে।’

বিএমইউ'র ফিজিক্যাল মেডিসিন ও রিহ্যাবিলিটেশন বিভাগের এই অধ্যাপক আরও বলেন, কেউ প্যারালাইসিসে আক্রান্ত হলে বা দুর্ঘটনা ও অন্যান্য কারণে শারীরিকভাবে অক্ষম হয়ে পড়লে অবশ্যই ফিজিক্যাল মেডিসিন ও রিহ্যাবিলিটেশন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন। এই চিকিৎসা পদ্ধতিতে শুধু ওষুধ নয়, বরং ব্যায়াম, থেরাপি, দৈনন্দিন কাজের নির্দেশনা এবং পরিবেশগত পরিবর্তনের সমন্বয়ে রোগীকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হয়। কারণ শুধু ওষুধে সাময়িকভাবে ব্যথা কমলেও দীর্ঘমেয়াদে সুস্থ থাকতে হলে জীবনযাপনে পরিবর্তন আনা এবং সঠিক নিয়ম মেনে চলা অপরিহার্য।