শিরোনাম

বরুন কুমার দাশ ও আব্দুর রউফ
ঢাকা, ১৯ নভেম্বর, ২০২৫ (বাসস) : দেশে লিভারের আধুনিক চিকিৎসার প্রায় ৮০ শতাংশই এখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্বল্পমূল্যে বা বিনামূল্যে দেওয়া হচ্ছে। অথচ লিভার চিকিৎসার জন্য প্রতিষ্ঠিত একটি বিশেষায়িত সরকারি ইনস্টিটিউটের নাম ‘গ্যাস্ট্রোলিভার’ হলেও সেখানে কোনো লিভার বিশেষজ্ঞ রাখা হয়নি। ফলে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে প্রতিষ্ঠানটির সক্ষমতা। নীতিগত এই ঘাটতি এবং আস্থার তীব্র সংকটের কারনে রোগীদের বিপুল অর্থ ব্যয় করে বিদেশ যেতে হচ্ছে। ফলে লিভার ট্রান্সপ্লান্টেশনের মতো জরুরি সেবায় বাংলাদেশ এখন নেপাল ও পাকিস্তানের চেয়ে পিছিয়ে পড়েছে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের হেপাটোলজী বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ডা. এ বি এম শাকিল গনি বাসস’কে দেওয়া এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন।
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের রোগীদের বিদেশমুখীতার প্রধান কারণ হচ্ছে আস্থার অভাব। তবে এটাও সত্যি চিকিৎসকের অবহেলায় যথাযোগ্য শাস্তির অভাব এবং শাস্তি হলেও তা জনগণের দৃষ্টিগোচর না হওয়ার কারণে এই বিদেশমুখীতার প্রবণতা আরও বাড়ছে। অথচ আমি গত ১১ মাস ধরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে লিভার বিভাগে কর্মরত আছি। এই সময়ের মধ্যে আমরা লিভার রোগের চিকিৎসা ও পরীক্ষার ব্যবস্থা খুব কম খরচে, এমনকি অনেক ক্ষেত্রে বিনামূল্যেই আমাদের এখানেই (ঢামেক) রোগীদের জন্য নিশ্চিত করতে পেরেছি।’
ঢামেকের লিভার চিকিৎসা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ডা. শাকিল বলেন, ‘আমার বিভাগের চিকিৎসক, স্টাফ ও হাসপাতাল পরিচালকের সহযোগিতায় লিভার ক্যান্সারের রোগীদের চিকিৎসায় সর্বাধুনিক ও উচ্চ প্রযুক্তিসম্পন্ন ‘ট্রান্স আর্টারিয়াল কেমো-এম্বোলাইজেশন’ (টেইস) ও ‘মাইক্রোওয়েভ অ্যাবলেশন’ (এমডব্লিউএ) সেবা চালু হয়েছে। এছাড়া, লিভারের সিস্ট চিকিৎসায় ‘পেয়ার’, লিভার রোগ নির্ণয়ে ‘লিভার বায়োপসি’ বা ‘এফএনএসি’ (ফাইন নিডল অ্যাসপিরেশন সাইটোলজি) এমনকি লিভার থেকে পুঁজ বা পেটের পানি বের করার মতো সেবাও আমাদের হাসপাতালে চালু রয়েছে।’
তবে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে লিভার চিকিৎসায় বড় অগ্রগতি হলেও দেশের সামগ্রিক চিকিৎসা ব্যবস্থায় এখনো কিছু সীমাবদ্ধতা রয়ে গেছে বলেও মনে করেন ডা. শাকিল গনি।
তিনি বলেন, ‘ঢাকা মেডিকেলে এখন প্রায় সব ধরনের লিভার রোগের চিকিৎসা হয়। বেসরকারি হাসপাতালেও লিভার সিরোসিস ও লিভার ক্যান্সারের বিশ্বমানের চিকিৎসা রয়েছে। এখন তা সরকারি ব্যবস্থায়ও কম খরচে পাওয়া যাচ্ছে। তবু রোগীরা বিদেশে যাচ্ছেন। ভুল ধারণা, আস্থার অভাব ও সমন্বয়ের ঘাটতি এ প্রবণতার মূল কারণ।
তিনি বলেন, ‘ঢাকা মেডিকেলে এখন প্রায় সব ধরনের লিভার রোগের চিকিৎসা হয়। আমাদের দেশে লিভার ট্রান্সপ্লান্টেশন ছাড়া বাকি চিকিৎসা বিশ্বমানের। লিভার সিরোসিস কিংবা লিভার ক্যান্সারের মত সকল চিকিৎসা ব্যবস্থা বেসরকারিতে ইতোমধ্যেই রয়েছে, এখন সরকারিভাবে ঢাকা মেডিকেলেও স্বল্প খরচে পাওয়া যাচ্ছে। তবু রোগীরা বিদেশে যাচ্ছেন।’
তার মতে, ভুল ধারণা, আস্থার অভাব ও চিকিৎসা ব্যবস্থার সমন্বয়ের ঘাটতি এ প্রবণতার মূল কারণ। অথচ দেশেই এসব রোগী বিশ্বমানের চিকিৎসা পেতে পারেন।’
তিনি বলেন, দেশের স্বার্থে, বিশেষ করে দেশের টাকা যাতে দেশেই থাকে সেজন্য আমাদের এই আস্থা অর্জন করতে হবে। এজন্য চিকিৎসা ব্যবস্থায় গণযোগাযোগ বাড়ানো, আস্থার সংকট দূর করা এবং হাসপাতাল পরিবেশকে চিকিৎসাবান্ধব করা জরুরি।
গণমাধ্যমের ভূমিকা নিয়ে ডা. শাকিল গনি বলেন, ‘সরকারের পাশাপাশি সাংবাদিকদেরও বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসতে হবে। চিকিৎসা সাংবাদিকতায় জড়িতদের সঙ্গে চিকিৎসক পেশাজীবী সংগঠনগুলোর মেলবন্ধন এবং নিয়মিত মতবিনিময় আস্থা তৈরি করতে পারে। যেকোনো চিকিৎসাজনিত জটিলতায় শুধু চিকিৎসককে দায়ী করা ও তাদের মতামত না নেওয়া পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করে। চিকিৎসা সেবা শুধু চিকিৎসকের ওপর নির্ভর করে না। এটি টেকনিশিয়ান, নার্স, সহকারী এমনকি ট্রলিবল বা ক্লিনার পর্যন্ত সবাই মিলে একটি পূর্ণাঙ্গ টিমওয়ার্ক। কোথাও ব্যত্যয় ঘটলেই সরাসরি দায় চাপানো হয় চিকিৎসকের ওপর এমনকি অনেকক্ষেত্রে দোষ না থাকলেও তাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হচ্ছে। ফলে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার ওপর মানুষের আস্থা শূন্যের কোঠায় নেমেছে। তাই সম্পাদকীয় কার্যক্রমের একটি অংশ চিকিৎসকদের নিয়ে হওয়া উচিত, যাতে দুই পক্ষের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি হয়।’
বাংলাদেশে লিভার রোগ বাড়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বিশ্বব্যাপী ফ্যাটি লিভার লিভারে চর্বি জমার মতো রোগ বাড়ছে। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। শারীরিক পরিশ্রম বা ব্যায়ামের অভাব, খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন ও ডায়াবেটিসের উচ্চ হার এ বৃদ্ধির কারণ। তবে এখন পর্যন্ত দেশে সবচেয়ে বেশি লিভার ক্যান্সার ও লিভার সিরোসিসের কারণ হেপাটাইটিস বি। গত ২০ বছর ধরে শিশুদের সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির ফলে ২০ বছরের নিচে এই ভাইরাস প্রায় নেই বললেই চলে।’
লিভার চিকিৎসায় জনবল সংকট এবং প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার কথা তুলে ধরে ডা. শাকিল গনি বলেন, প্রায় সব মেডিকেল কলেজেই এখন লিভার বিশেষজ্ঞ বা হেপাটোলজিস্ট আছেন। যদিও ১৬ কোটি মানুষের জন্য মাত্র ১৩০ জন বিশেষজ্ঞ খুব কম, তবুও তারা রোগীদের সমস্যা সমাধানে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন।’
বাংলাদেশে লিভার ট্রান্সপ্লান্টেশনের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বেসরকারি খাতে সেবা রয়েছে, কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই সরকারি খাতে এই ব্যবস্থা অপ্রতুল। বিশেষত যাদের ট্রান্সপ্লান্ট প্রয়োজন, তাদের আমরা যথাযথ চিকিৎসা দিতে পারছি না। সারা পৃথিবীতে কিডনির পর লিভার ট্রান্সপ্লান্টেশনই অতি আবশ্যক একটি স্বাস্থ্যসেবা। অথচ নেপাল ও পাকিস্তান বাংলাদেশকে ছাড়িয়ে গেছে। সম্প্রতি আমাদের দেশে লিভার ট্রান্সপ্লান্ট শুরু হলেও একটি পূর্ণাঙ্গ স্বতন্ত্র লিভার ইনস্টিটিউট এখন সময়ের দাবি।
পরিশেষে শারীরিক সুস্থতায় মানুষকে সচেতন হবার পরামর্শ দিয়ে ডা. গনি বলেন, ‘লিভার সুস্থ রাখতে হলে আমাদেরকে পানিবাহিত রোগের উৎসগুলো বন্ধ করতে হবে। যেসব খাবারে সরাসরি পানি ব্যবহার করা হয়, যেমন- চটপটি, ফুচকা, পানি পুরি, এই সমস্ত খাবার রাস্তাঘাট থেকে না খাওয়া সবচেয়ে উত্তম। কারণ, এইসব খোলা খাবারের মাধ্যমে এবং অনিরাপদ পানির মাধ্যমে হেপাটাইটিস-এ এবং হেপাটাইটিস-ই-এর মতো মারাত্মক ভাইরাস খুব সহজে ছড়িয়ে পড়ে। এই ভাইরাসগুলো সরাসরি লিভারকে আক্রমণ করে, যা সাধারণ জন্ডিস থেকে শুরু করে ‘অ্যাকিউট লিভার ফেইলিওর’ বা লিভারের আকস্মিক বিকলতার মতো প্রাণঘাতী পরিস্থিতিও তৈরি করতে পারে। তাই বিশুদ্ধ পানি পান করা এবং ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করার কোনো বিকল্প নেই বলে জানান ঢামেকের এই চিকিৎসক।
তিনি আরো বলেন, কবিরাজি ও হারবাল চিকিৎসাও লিভারের কর্মক্ষমতা নষ্টের আরেকটি কারণ। সঠিক চিকিৎসার বদলে এ ধরনের অপচিকিৎসার প্রবণতা সম্প্রতি বেড়েছে। ইউটিউব ও ফেসবুকে ছড়ানো হারবাল পরামর্শে মানুষের অতিরিক্ত আগ্রহ এখন লিভারের ক্ষতির অন্যতম প্রধান কারণ।