শিরোনাম
ওবাইদুর রহমান
ঢাকা, ১৪ অক্টোবর, ২০২৫ (বাসস) : বাংলাদেশ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) বর্তমানে দক্ষ ও প্রযুক্তি নির্ভর আধুনিক তদন্ত সংস্থা হিসেবে গড়ে উঠেছে। অর্থ পাচার, সাইবার অপরাধসহ নানা অপরাধ মোকাবিলায় সিআইডি যে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছে, তার নেতৃত্বে রয়েছেন অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক মো. ছিবগাত উল্লাহ।
তিনি বলেন, আমাদের মূল লক্ষ্য দ্রুত ও প্রমাণ নির্ভর ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। ভিকটিমের ক্ষয়ক্ষতি কমানো এবং অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা।
সম্প্রতি নিজ কার্যালয়ে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস)-কে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি এসব বিষয়ে বিস্তারিত উল্লেখ করেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বাসসের প্রতিবেদক ওবাইদুর রহমান।
বাসস : সাধারণ মানুষ কীভাবে সিআইডির সহায়তা নিতে পারে? কোনো নির্দিষ্ট প্ল্যাটফর্ম আছে কি?
মো. ছিবগাত উল্লাহ : সিআইডির সকল কর্মকাণ্ড সাধারণ জনগণের নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিতে পরিচালিত হলেও, আমাদের কার্যপ্রক্রিয়া কিছুটা পরোক্ষ বা অপ্রত্যক্ষ; যা সাধারণত কোর্ট, থানা এবং অন্যান্য সংস্থার মাধ্যমে পরিচালিত হয়। তবে, জনগণের দোরগোড়ায় সরাসরি সেবা পৌঁছে দিতে নিকট ভবিষ্যতে সাইবার থানা ও ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার স্থাপনসহ বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে।
বর্তমানে নাগরিকদের জন্য সিআইডির সহায়তা গ্রহণের কিছু সহজ মাধ্যমও বিদ্যমান। সাইবার অপরাধের ক্ষেত্রে ঘরে বসেই অনলাইনে জিডি করে সরাসরি সিআইডির সাইবার অপরাধ বিভাগ নির্বাচন করা যায়। এর পর অভিযোগ গ্রহণের বিষয়টি প্রাপ্তি স্বীকারসহ ট্র্যাকিং নম্বরের মাধ্যমে নিশ্চিত করা হয়।
সিআইডি সাইবার পুলিশ সেন্টারের ভেরিফায়েড ডিজিটাল চ্যানেল, অফিসিয়াল ওয়েবসাইট এবং ভেরিফায়েড সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে যোগাযোগের তথ্য রয়েছে, যেগুলো নাগরিকদের জন্য উন্মুক্ত। সরাসরি আইনি সহায়তা পেতে যোগাযোগের জন্য বিভিন্ন মোবাইল নম্বর দেওয়া আছে।
এছাড়া, যদি কোনো নাগরিক মনে করে যে তার উত্থাপিত বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে সিআইডির নজরে আনা প্রয়োজন, তাহলে তিনি সিআইডি প্রধান বরাবর ডাকযোগে পত্র প্রেরণ করতে পারেন, যা যথাযথ গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা হয়।
বাসস : সিআইডিতে যোগদানের পর আপনার নেতৃত্বে উল্লেখযোগ্য কী কী পরিবর্তন এসেছে?
মো. ছিবগাত উল্লাহ : আমি সিআইডি প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করি গত ১২ মে। যোগদানের পরই অগ্রাধিকার ছিল বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের হত্যাযজ্ঞের ন্যায়বিচারে কাজ করা। রাজধানী ও বিভিন্ন জেলায় অভিযান চালিয়ে এসব মামলার ১০ রাজনৈতিক প্রভাবশালী আসামিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এছাড়াও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মামলার বিজ্ঞানসম্মত প্রমাণ প্রদানে সিআইডি নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
এছাড়া, বিগত সরকারের সময় দেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধারে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়। পলাতক শেখ হাসিনাসহ ৭৩ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা দায়ের ও দ্রুততম সময়ে চার্জশিট দেওয়া। ফলে আদালত ইতোমধ্যে অভিযুক্তদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।
২০১৬ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে সাইবার জালিয়াতির মাধ্যমে চুরি হওয়া ৮১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ফেরত আনতে আইনি লড়াইয়ে আমরা এক ঐতিহাসিক সফলতা অর্জন করেছি। সিআইডির আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালত ফিলিপাইনের রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং করপোরেশনকে (আরসিবিসি) কর্পোরেট সত্তা হিসেবে মানিলন্ডারিং অপরাধে দায়ী করে এবং চুরি হওয়া পুরো অর্থ বাংলাদেশ সরকারের কোষাগারে ফেরত পাঠানোর নির্দেশ দেন। এই অর্জন শুধু সিআইডির নয় এটি বাংলাদেশের সার্বভৌম মর্যাদা ও আর্থিক নিরাপত্তার প্রতীক।
সাবেক কিছু এমপি-মন্ত্রী ও প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এগুলোর মধ্যে সাবেক আইনমন্ত্রীর বান্ধবী তৌফিকা করিম ও সংশ্লিষ্টদের ৮৭ কোটি টাকার ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ। দুবাইয়ে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা পাচার, সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী ও তার স্ত্রীসহ অন্যদের বিরুদ্ধে মানিলন্ডারিং আইনে মামলা। সাবেক মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর প্রায় ৪০০ কোটি টাকা মূল্যের ৪ হাজার ৮৮০ শতাংশ জমি ক্রোক করা হয়েছে।
এছাড়া, বিএসবি গ্লোবাল নেটওয়ার্কসের প্রধান খায়রুল বাশার বাহারের ৪২ কোটি টাকার সম্পদ ক্রোক ও তাকে গ্রেফতার করা। সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার নাম ব্যবহার করে ১৫ কোটি টাকার প্রতারণা মামলার আসামিকে গ্রেফতার। মার্কিন নাগরিকের সঙ্গে প্রতারণা ও হুন্ডির মাধ্যমে অর্জিত ৬০৮ কোটি টাকার মানিলন্ডারিং আইনে মামলা করা হয়েছে।
রংধনু গ্রুপের চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে ৮৭৮ কোটি টাকা পাচারের অভিযোগে মানিলন্ডারিং আইনে মামলা ও বিলাসবহুল হোটেলসহ ৩৩ কোটি টাকা ক্রোক। মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রপ্তানির সঙ্গে জড়িত সিন্ডিকেটের প্রধান রুহুল আমিনের (স্বপন) ৫০০ কোটি টাকার সম্পত্তি ক্রোক। অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের আড়ালে ৩৪ কোটি টাকা বিদেশে পাচারের অভিযোগে বেক্সিমকো গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান অটাম লুপ অ্যাপারেলস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে গ্রেফতার করা হয়েছে।
মাদক ব্যবসায়ী শাহীন আলমের প্রায় ৭ কোটি টাকার সম্পদ ক্রোক। ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ধামাকা শপিং-এর স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে প্রায় ৬২ কোটি টাকার সম্পত্তি ক্রোক করা হয়েছে। সাংবাদিক মুন্নি সাহা ও তার স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের ৩৫টি ব্যাংক হিসাবের মোট ১৮ কোটি টাকা ফ্রিজ করা হয়েছে।
মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান দুর্ঘটনায় অগ্নিদগ্ধ ৫ জনের পরিচয় শনাক্ত করে সিআইডির ফরেনসিক ডিএনএ ল্যাব দেশের মানুষের কাছে ফরেনসিক সক্ষমতার বাস্তব প্রমাণ তুলে ধরা হয়েছে।
সবমিলিয়ে সিআইডি এখন দক্ষ, প্রযুক্তি নির্ভর ও জনকল্যাণমুখী একটি তদন্ত সংস্থা হিসেবে দেশের আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে।
বাসস : বর্তমানে সিআইডি বাংলাদেশের কোন ধরনের অপরাধ তদন্তে সবচেয়ে বেশি মনযোগ দিচ্ছে?
মো. ছিবগাত উল্লাহ : সিআইডি বাংলাদেশ পুলিশের অন্যতম প্রাচীন ও বিশেষায়িত একটি ইউনিট। আমাদের তদন্ত-সংক্রান্ত ইতিহাস শত বছরেরও বেশি। সহজ করে বললে সিআইডি বিশেষ অর্থাৎ শিডিউলভুক্ত মামলা তদন্ত করে থাকে। পিআরবিতে সিআইডির কাজ নিয়ে পুরো একটি চ্যাপ্টার রয়েছে যাতে কতগুলো অধিক গুরুত্বপূর্ণ মামলা তদন্তের ভার আমাদের ওপর ন্যস্ত আছে।
পরবর্তীতে পিআরবি প্রবিধিতে উল্লিখিত তফশিলের কলেবর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন দ্বারা আরো বিস্তৃত হয়। এরকম তফশিলভুক্ত অপরাধগুলোর মধ্যে ডাকাতি, মহাসড়ক, রেলওয়ে অথবা মেইল ট্রেনে লুণ্ঠন, লাভের আশায় খুন, ব্যাংক জালিয়াতি, পেশাগত অপরাধীদের নারী ও শিশু নিয়ে ব্যবসার মতো অপরাধগুলো অন্তর্ভুক্ত। এধরনের অপরাধের মামলা সিআইডি অধিগ্রহণ করে তদন্ত করতে পারে।
এছাড়াও, বিশেষ আইন দ্বারা প্রাপ্ত ক্ষমতাবলে যেমন— মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ বলে তদন্তের ক্ষমতাপ্রাপ্ত মামলা আমরা তদন্ত করে থাকি। বর্তমানে ২৯টি সম্পৃক্ত অপরাধের উৎস ধরে মানিলন্ডারিংয়ের মামলা করা হয়। এর মধ্যে সিআইডি ২৬ টি অপরাধ নিয়ে কাজ করে, যাতে ১৮ ধরনের সম্পৃক্ত অপরাধ নিয়ে মাত্র সিআইডিই কাজ করতে পারে। এছাড়া আদালতের নির্দেশে সিআইডি আরো গুরুত্বপূর্ণ মামলার তদন্ত করে থাকে।
সব মামলা তদন্তেই মনযোগ আমাদের সমান। তবে যদি বলেন, আমার বিশেষ আগ্রহের জায়গা রয়েছে কি না তাহলে বলব, ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম, মানবপাচার ও ইন্টারনেট ক্রাইম নিয়ে আমাকে একটু বেশিই ভাবতে হয়। এ অপরাধের দ্বারা ক্রিমিনালরা ভিকটিম তো বটেই আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতির চরম ক্ষতি করে যাচ্ছে। এটা নিয়ে কাজ করে দেশের অর্থনীতি বাঁচাতে আমরা একটি ভালো ভূমিকা রাখতে পারি। মানিলন্ডারিংয়ের মতো অপরাধে জড়িত রাঘব-বোয়ালদের আইনের আওতায় আনা গেলেই ভবিষ্যতে অসৎ অর্থ উপার্জনের হার কমে আসবে।
বাসস : জটিল ও হাই-প্রোফাইল মামলা তদন্তে সিআইডি কী ধরনের আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করছে?
মো. ছিবগাত উল্লাহ : তদন্ত মূলত একটি শিল্প, যেখানে মানুষকেই বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে মূল কাজটি করতে হয়। সেখানে আধুনিক বিশ্বে প্রযুক্তি একটি বড় ভূমিকা রাখছে। সিআইডিও তাই জটিল ও হাই-প্রোফাইল কেসের তদন্তে বিভিন্ন আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে থাকে।
এগুলো হলো— ফরেনসিক হিসেবে ডিএনএ ল্যাব, কেমিক্যাল ল্যাবের মতো গুরুত্বপূর্ণ অনেক ল্যাব রয়েছে আমাদের। এছাড়া ডিভাইস ইমেজিং, ডেটা রিকভারি ও তদন্তে ক্রিপ্টো ডেটা ট্রেসিং-এর মাধ্যমে কাজ করা হয়।
প্রোফাইলিং এবং লিংক অ্যানালাইসিসের মাধ্যমে অপরাধীদের প্যাটার্ন ও সংযোগগুলো বিশ্লেষণ করে শনাক্তকরণে কাজ করা হয়।
ক্লাউডভিত্তিক তথ্য ও ডেটা সংগ্রহ করে তদন্ত সম্পন্ন করা হয়। এছাড়া এনক্রিপ্টেড অ্যাপ, ইনফরমাল ট্রান্সফার ও মিররড লেনদেনের খোঁজে প্রযুক্তিগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
ট্রেসিং, আইপি ট্র্যাকিং, ইউজার অ্যানালিটিক্স ও অ্যালগরিদম ভিত্তিক বিশ্লেষণ করেও কাজ করা হয়। পাশাপাশি মোবাইল নেটওয়ার্কভিত্তিক যোগাযোগের মাধ্যমে সংগঠিত অপরাধে এই প্রযুক্তি কাজে লাগানো হয়।
বাসস : সাইবার ক্রাইমে বড় চ্যালেঞ্জ কী? চ্যালেঞ্জ ঠেকাতে আপনাদের প্রস্তুতি ও কার্যক্রম জানতে চাই।
মো. ছিবগাত উল্লাহ : সাইবার ক্রাইম বর্তমানে একটি জটিল ও বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জ, যা কেবল প্রযুক্তি নির্ভর অপরাধ নয় বরং অর্থনীতি, পরিবার, সামাজিক স্থিতিশীলতা এবং জাতীয় নিরাপত্তার সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। এ ধরনের দ্রুত ও ক্রমপরিবর্তনশীল হুমকির বিপরীতে কার্যকর জুতসই, আধুনিক ও সমন্বিত ডিজিটাল পুলিশিং ব্যবস্থা অপরিহার্য। সিআইডি এই খাতে তিনটি প্রধান স্তম্ভে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। যেমন, সার্বক্ষণিক অনলাইন পেট্রোলিং চালানো হয় এবং ভেরিফায়েড ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলোর সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে ভুয়া পেজ ও প্রতারণামূলক কনটেন্ট দ্রুত শনাক্ত করে অপসারণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। একইসঙ্গে, স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালিয়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সাইবার ঝুঁকি সম্পর্কে প্রস্তুত করা হচ্ছে।
ডেটা ইন্টেলিজেন্স ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে সাইবার অপরাধের প্যাটার্ন চিহ্নিত করা হয়। যেমন, একই চক্রের বহু মোবাইল নম্বর, পুনরাবৃত্তি লিংক, কিংবা নির্দিষ্ট টাইমলাইনভিত্তিক কর্মকাণ্ড। নতুন হুমকি শনাক্ত করে সেগুলো ট্র্যাক করা হয়। ট্রায়াজ পদ্ধতির মাধ্যমে গোল্ডেন আওয়ারের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা হয়। সাইবার অপরাধ সংগঠনের পর ব্যাংক বা মোবাইল মানি অপারেটরের মাধ্যমে লেনদেন ফ্রিজ করতে অনুরোধ, সোশ্যাল মিডিয়া কোম্পানিগুলোকে ইমিডিয়েট প্রিজারভেশন নোটিশ পাঠানো এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট সংস্থার সঙ্গে তাৎক্ষণিক সমন্বয় করা হয়।
ডিজিটাল ফরেনসিক, ডিভাইস ইমেজিং, ক্লাউড বেইসড এভিডেন্স সংগ্রহ, ক্রিপ্টো ট্রেসিং, লিংক চার্টিং এবং সাইবার প্রোফাইলিংসহ নানা উন্নত প্রযুক্তিনির্ভর সক্ষমতা রয়েছে। প্রয়োজনে মাঠ পর্যায়ে অপারেশন পরিচালনার জন্য টিম নামে এবং আন্তর্জাতিক সহযোগী সংস্থা— যেমন, ইন্টারপোল ও এনসিএমইসি ইত্যাদির সহায়তা নেওয়া হয়। আদালতে উপস্থাপনের জন্য চেইন অব কাস্টডি কঠোরভাবে অনুসরণ করা হয়।
সিআইডি নিয়মিতভাবে ব্যাংক, টেলিকম, আইএসপি রেগুলেটর এবং আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছে। প্রযুক্তি হস্তান্তর, দক্ষতা বৃদ্ধিমূলক প্রশিক্ষণ এবং যৌথ কর্মপ্রচেষ্টার মাধ্যমে সময়োপযোগী প্রতিক্রিয়া সক্ষমতা তৈরি করা হচ্ছে।
সাইবার হুমকির গতিশীলতা বিবেচনায় দ্রুতগতির ও সমন্বিত কর্মপন্থা গ্রহণ করেছে সিআইডি। আমাদের মূল লক্ষ্য নাগরিকদের ডিজিটাল নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা।
বাসস : সিআইডি কীভাবে নিশ্চিত করে যে তদন্ত প্রক্রিয়ায় নিরপেক্ষতা ও স্বচ্ছতা বজায় থাকে?
মো. ছিবগাত উল্লাহ : মামলা তদন্তে স্বচ্ছতা নিশ্চিতে আইনই আমাদেরকে গাইড করে। প্রতিটি মামলার তদন্ত কর্মকর্তারা এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকেন। তবে কোনো বিষয়ে যদি অভিযোগ আসে, তাহলে আমরা সেটি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখি এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়ে থাকি।
বাসস : ফরেনসিক ল্যাবের কাজগুলো কীভাবে পরিচালিত হয়?
মো. ছিবগাত উল্লাহ : সিআইডির ফরেনসিক বিভাগ আদালত এবং বিভিন্ন তদন্তকারী সংস্থা থেকে প্রাপ্ত মামলার আলামত পরীক্ষার মাধ্যমে বিজ্ঞানভিত্তিক তদন্ত কার্যক্রমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও খুলনা বিভাগে ফরেনসিক ল্যাব কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। ফরেনসিক বিভাগের অধীনে ১২টি বিশেষায়িত শাখা কাজ করে থাকে, যার মধ্যে রয়েছে: বিভিন্ন ক্রাইমসিন থেকে সংগৃহীত বস্তুগত সাক্ষ্যের ওপর বিশেষজ্ঞ মতামত প্রদান, ডিএনএ বিশ্লেষণ এবং রিপোর্ট প্রস্তুতকরণ, জাল দলিলের ওপর বিশেষজ্ঞ মতামত প্রদান, ভিসেরা এবং মাদকসংক্রান্ত আলামতের পরীক্ষণ ও মতামত প্রদান, ডিজিটাল অপরাধ সংশ্লিষ্ট আলামত পরীক্ষা ও মতামত প্রদান, মাইক্রো অ্যানালাইসিস সংক্রান্ত বিশ্লেষণ, ফটোগ্রাফি ও অডিও-ভিডিওগ্রাফির ওপর ফরেনসিক মতামত প্রদান, ক্রাইমসিন ম্যানেজমেন্ট টিমের মাধ্যমে আলামত সংগ্রহ, আসামি বা অপরাধীদের আঙুলের ছাপ সংগ্রহ এবং সংরক্ষণ, বাংলাদেশ পুলিশ ও অন্যান্য সংস্থার সদস্যদের ফরেনসিক বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান ইত্যাদি।
এসব কার্যক্রম সিআইডির ফরেনসিক দক্ষতা এবং আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর অপরাধ তদন্তের সক্ষমতাকে নিরবচ্ছিন্নভাবে শক্তিশালী করে যাচ্ছে।
বাসস : ভবিষ্যতের জন্য সিআইডির কী পরিকল্পনা রয়েছে প্রযুক্তি, মানবসম্পদ বা প্রশিক্ষণের দিক থেকে?
মো. ছিবগাত উল্লাহ : সিআইডি ভবিষ্যতের জন্য প্রযুক্তি, মানবসম্পদ এবং প্রশিক্ষণভিত্তিক তিনটি স্তম্ভে প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে, যার মূল লক্ষ্য দ্রুত ও প্রমাণ নির্ভর ব্যবস্থা নিশ্চিত করা, ভিকটিমের ক্ষয়ক্ষতি কমানো এবং অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা।
হার্ডওয়্যার, সফটওয়্যার, মনিটরিং টুলস ও ফরেনসিক সরঞ্জাম কেনার জন্য পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ফেসবুক, টিকটক, গুগল, ইমোসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে তথ্য সহজে পেতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে। এআই-ভিত্তিক ট্রায়াজ ও লিংক অ্যানালিটিক্স, ডিপফেক শনাক্তকরণ, সন্দেহজনক লেনদেনের পূর্বাভাস এবং হটস্পট বিশ্লেষণ সক্ষমতা অর্জনের পরিকল্পনা রয়েছে। সাইবার অপরাধসংক্রান্ত ডাটাবেজ তৈরি এবং আধুনিক ফরেনসিক ল্যাবের সক্ষমতা বাড়াতে মোবাইল, ক্লাউড নেটওয়ার্ক, ম্যালওয়্যার রিভার্সিং ও ক্রিপ্টো ট্রেসিং পরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। চেইন অব কাস্টডি ডিজিটালাইজড লগ ও হ্যাশ ইনভেন্টরি ব্যবহারের মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয় করা হবে।
ডার্ক ওয়েব মনিটরিং, প্রিজারভেশন নোটিশ ও ফ্রিজিং অনুরোধের দ্রুত ওয়ার্ক ফ্লো এবং ব্যাংক, টেলিকম, এমএফএস, বিটিআরসি ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার সঙ্গে অচও গেটওয়ে ও সময়সীমাবদ্ধ ডেটা শেয়ারিং মেকানিজম চালুর মাধ্যমে প্রথম কয়েক ঘণ্টায় কার্যকর সিদ্ধান্ত নেওয়ার সক্ষমতা তৈরি করা হবে। নাগরিকবান্ধব রিপোর্টিং ব্যবস্থা আরো উন্নত করা হবে; যেমন— নিরাপদ আপলোড, কেস স্ট্যাটাস ট্র্যাকিং, নারী ও শিশুর জন্য পৃথক রিপোর্টিং চ্যানেল, বাংলা ও ইংরেজিসহ বহুভাষিক সহায়তা।
ডিজিটাল ফরেনসিক বিশ্লেষক, ক্লাউড এভিডেন্স স্পেশালিস্ট, ম্যালওয়্যার অ্যানালিস্ট, থ্রেট ইন্টেলিজেন্স অ্যানালিস্ট, ক্রিপ্টো ট্রেসার, ওপেন সোর্স ইনভেস্টিগেটর প্রভৃতি বিশেষায়িত ভূমিকা তৈরি করা হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় ও পেশাদার সংস্থার সঙ্গে ইন্টার্নশিপ ও ফেলোশিপ চালুর মাধ্যমে একটি ট্যালেন্ট পাইপলাইন গড়ে তোলা হবে। রিটেনশন ও কল্যাণ পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে সার্টিফিকেশন সাপোর্ট, রিসার্চ ও পাবলিকেশন ইনসেনটিভ, মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা এবং উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ মামলায় রোটেশনাল ডিউটির ব্যবস্থা। মাঠ থেকে সদর দপ্তরে রোটেশন ও জেলা পর্যায়ে সাইবার ডেস্ক শক্তিশালী করে কেস ট্রায়াজ ও এসক্যালেশন দ্রুততর করা হবে।
স্তরভিত্তিক কারিকুলাম চালু করা হচ্ছে, যেখানে সবার জন্য ভিত্তিমূলক কোর্স এবং বিশেষজ্ঞদের জন্য উন্নত মডিউল প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকবে। অপারেশন টিমের জন্য হ্যান্ডস অন ল্যাব প্রশিক্ষণ অন্তর্ভুক্ত করা হবে। ব্যাংক, এমএফএস, টেলিকম ও বিটিআরসির সঙ্গে যৌথ মহড়া, টেবিলটপ এক্সারসাইজ ও লাইভ ড্রিলের মাধ্যমে গোল্ডেন আওয়ার প্রটোকল চর্চা নিশ্চিত করা হবে। আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সঙ্গে মাস্টারক্লাস আয়োজনের মাধ্যমে হাইব্রিড ইনভেস্টমেন্ট স্ক্যাম, অনলাইন বেটিং নেটওয়ার্ক, র্যানসমওয়্যারসহ নতুন সেকল হুমকি মোকাবিলায় সক্ষমতা অর্জন করা হবে। পাশাপাশি প্রসিকিউশন ও বিচার প্রক্রিয়ায় সহায়তা নিশ্চিত করতে ইলেক্ট্রনিক প্রমাণ উপস্থাপন, ফরেনসিক রিপোর্ট রাইটিং এবং সাক্ষ্য প্রস্তুতির ওপর বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকবে।
এছাড়া, আইনি কাঠামোয় সিআইডি মনে করে, প্রযুক্তিনির্ভর এবং গ্লোবাল নেটওয়ার্কযুক্ত অপরাধ মোকাবিলায় সময়োপযোগী আইন ব্যতীত কার্যকর পুলিশিং অসম্ভব। এ লক্ষ্যে ইতোমধ্যে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ এবং সদ্য প্রণীত সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৫-সহ অন্যান্য আইন সংস্কারের উদ্যোগ প্রশংসনীয় অগ্রগতি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।