শিরোনাম

ঢাকা, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৫ ( বাসস ) : বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপির) ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দর থেকে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হয়েছেন।
বাংলাদেশ সময় রাত ১২টায় তিনি স্ত্রী জোবাইদা রহমান ও কন্যা জাইমা রহমানকে সঙ্গে নিয়ে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি নিয়মিত ফ্লাইটে যাত্রা করেন।
এর আগে বুধবার বাংলাদেশ সময় বাংলাদেশ সময় রাত ৮টা ৫ মিনিটে সপরিবারে লন্ডনের নিজ বাসা ত্যাগ করেন তারেক রহমান। রাত ১০টা ১৮ মিনিটে তারেক রহমান দেশের উদ্দেশ্য রওনা করতে লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরে পৌঁছান এবং প্রয়োজনীয় আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করেন।
সব ঠিক থাকলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকে বহনকারী উড়োজাহাজটি আগামীকাল ২৫ ডিসেম্বর বেলা ১১টা ৪৫ মিনিটে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছাবে। অবতরণের পরপরই সর্বোচ্চ গুরত্ব দিয়ে নিরাপত্তা ও প্রটোকল ব্যবস্থাপনা কার্যকর করা হবে।
ঢাকায় অবতরণের আগে উড়োজাহাজটি সিলেটের ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এক ঘণ্টা যাত্রা বিরতি করবে। ঢাকা বিমানবন্দরে তাঁকে স্বাগত জানাবেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্যরা। উচ্ছ্বসিত নেতা-কর্মীরা বিমানবন্দরের বাইরে অপেক্ষায় থাকবেন।
বিএনপির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে- তারেক রহমানের প্রথম ও প্রধান অগ্রাধিকার হলো সরাসরি এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন, তাঁর গুরুতর অসুস্থ মমতাময়ী মা, বাংলাদেশের অভিভাবক দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে দেখতে যাওয়া। তবে বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী, সমর্থক ও সাধারণ মানুষের উপস্থিতির বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে, জনগণের প্রত্যাশার প্রতি সম্মান জানিয়ে, যাত্রাপথের মাঝামাঝি রাজধানীর ‘জুলাই ৩৬ এক্সপ্রেসওয়ে’ (৩০০ ফিট) এলাকায় দলের পক্ষ থেকে তৈরি করা সংক্ষিপ্ত গণঅভ্যর্থনা মঞ্চে তিনি অতি সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য দেশবাসীর উদ্দেশ্যে কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জ্ঞাপন করবেন। সেখান থেকে হাসপাতালে গিয়ে কিছু সময় মায়ের পাশে থাকবেন। এরপর গুলশান এ্যাভিনিউয়ের ১৯৬ নম্বর বাসায় উঠবেন।
দীর্ঘ দেড় যুগ পর তারেক রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ঘিরে দেশজুডড়ে রাজনৈতিক অঙ্গন, নেতাকর্মী, সমর্থক এবং সর্বসাধারণের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ, কৌতূহল ও আবেগের সঞ্চার হয়েছে। এই প্রত্যাবর্তন শুধু একজন নেতার দেশে ফেরা নয়, বরং সর্বজনীন প্রত্যাশা ও আকাঙ্খার মেলবন্ধন, যার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান এবং বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ জনসমাগমের সম্ভাবনা।
ইতিহাস বলে, রাজনীতিতে সময় সবকিছুর উত্তর দিয়ে দেয়। তারেক রহমানের বেলায় এই কথাটির যেন সত্য হয়ে ধরা দিয়েছে। একদিন পাহাড়সম অভিযোগ মাথায় নিয়ে চিকিৎসার জন্য পাড়ি দিয়েছিলেন যুক্তরাজ্যে, ছিলেন নির্বাসনে। আজ দেড় যুগ পরে তিনি দেশের মাটিতে ফিরে আসছেন আগের চেয়ে কয়েকগুন বেশি জনপ্রিয়তা নিয়ে। গণ-মানুষের নেতা আর জাতির ঐক্যের প্রতীক হয়ে।
তারেক রহমানের দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের পথ পরিক্রমা এতোটাও মশৃণ ছিলো না। ২০০১ থেকে ০৬ সালের শাসন আমলে তার বিরুদ্ধে তৈরি করা হয়েছিল বিতর্কের পাহাড়। মাথার উপরে ঝুলতে থাকে প্রায় অসংখ্য মামলা। তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ, ১/১১-এর সেনা সমর্থিত সরকার এবং সুশীল সমাজের একটি প্রভাবশালী অংশ তার বিরুদ্ধে একের পর এক অভিযোগের আঙ্গুল তুলতে থাকে।
অভিযোগ ছিলো, তারেক রহমানের রাজনৈতিক কার্যালয় বনানীর হাওয়া ভবন ছিল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের বাইরে ক্ষমতার বিকল্প কেন্দ্র বা প্যারালাল গভর্নমেন্ট। তবে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে সবচেয়ে গুরুতর এবং স্পর্শকাতর অভিযোগটি আনা হয় ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলাকে কেন্দ্র করে। ওয়ান-ইলেভেন সরকারের সময় এবং পরে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর সম্পূরক চার্জশিটের মাধ্যমে মুফতি হান্নানের জবানবন্দির ভিত্তিত তাকে এই হামলার মাস্টারমাইন্ড হিসেবে অভিযুক্ত করা হয়।
আলোচিত ১/১১ সরকারের সময় ২০০৭ সালের ৭ মার্চ তাকে গ্রেপ্তার হন তারেক রহমান। রিমান্ডে থাকাকালীন তার ওপর চালানো হয় অমানবিক শারীরিক নির্যাতন। এতে গুরতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। ২০০৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর জামিনে মুক্ত হোন। ১৮ মাস কারাভোগের পরে লন্ডনে যান চিকিৎসার জন্য। এর পর কেটেছে ১৭ বছরেরও বেশি সময়। ছুঁয়ে দেখা হয়নি দেশের মাটি। দীর্ঘ এক নির্বাসিত জীবন।
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রক্ষমতায় বসে। তারা গণতন্ত্রের পথকে অবরুদ্ধ করার জন্য ২০১১ সালের ৩০ জুন পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে সুষ্ঠু নির্বাচনের পথ রুদ্ধ করে দেয়। বেগম খালেদা জিয়াকে তার বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়। একটি জবরদস্তিমূলক শাসনব্যাবস্থা কায়েম করেন স্বৈরাচার শেখ হাসিনা।
২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে দুর্ণীতির মিথ্যা মামলায় বেগম খালেদা জিয়াকে সাজা হয় এবং তাকে কারাবরণ করতে হয়। বেগম খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে প্রায় ৮ হাজার কিলোমিটার দূর থেকে দলের হাল ধরেন তারেক রহমান। সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান থেকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পান। এর পর থেকেই দেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনের নেমে পড়েন। গুম খুন আর নির্যাতনের বিরুদ্ধে নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ করতে ব্যাস্ত তারেক রহমান।
যুক্তরাজ্যে নির্বাসনের সময় ব্যক্তিগত জীবনেও তারেক রহমানের ওপর নেমে আসে কঠিন দুঃসময়। ছোট ভাই আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যু তাঁকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তোলে। একইসঙ্গে বিএনপি চেয়ারপারর্সন ও তাঁর মা বেগম খালেদা জিয়া রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় বহুবার কারাবাস, অসুস্থতা ও চিকিৎসা সংকটের মুখোমুখি হন। এমন বাস্তবাতায় দূরবর্তী অবস্থান থেকেও তারেক রহমান সংগঠন ধরে রাখার কাজে স্থির মনোনিবেশ করেন। কারণ, তারেক রহমান জানতেন, ফ্যাসিস্ট শাসকগোষ্ঠী তাঁকে রাজনৈতিকভাবে নির্মূল করতে চায়। ফলে নিজেকে সামনে এনে ব্যক্তিকেন্দ্রিক আন্দোলনের পরিবর্তে জনগণ কেন্দ্রিক একটি প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলেন। তিনি সুস্পষ্ট করে দেন- ‘বাংলাদেশ যাবে কোন পথে, ফয়সালা হবে রাজপথে। যা দলীয় নেতাদের মতে তাঁর ধৈর্য ও স্থিতধী নেতৃত্বের প্রমাণ।
দীর্ঘ সময় সুদূর যুক্তরাজ্যে নির্বাসিত থাকলেও দলীয় সিদ্ধান্ত, কৌশলগত পরিকল্পনা ও রাজনৈতিক নির্দেশনায় এখন তিনি বিএনপির কেন্দ্রীয় চালিকাশক্তি। দলটির শীর্ষস্থানীয় থেকে কেন্দ্রীয়, জেলা, উপজেলার সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন তারেক রহমান। তার রাজনৈতিক চরিত্রের মধ্যে দলের কর্মী-সমর্থকেরা খুঁজে পাচ্ছেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে। নেতাকর্মীরা বলছেন, একজন নেতার নেতৃত্বের মুল শক্তি থাকে তাঁর ন্যায়বোধ আর মানসিতায়। তাঁর আদর্শের মহিমায়। তারেক রহমান তেমনই একজন নেতা; যিনি দূর থেকেও ছিলেন সবচেয়ে কাছে।
২৫ ডিসেম্বর তারেক রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন নিছক কোনো ব্যক্তিগত বা দলীয় ঘটনা নয়; এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক আবেগঘন, গভীর অর্থবহ অধ্যায়। তার এই প্রত্যার্ব্যনে বিএনপির নেতাকর্মী ও সমর্থকদের মধ্যে নতুন প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে। তাদের বিশ্বাস- তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন দীর্ঘ রাজনৈতিক টানাপোড়েনের পর দলকে নতুন করে সংগঠিত করবে। পাশাপাশি জাতীয় রাজনীতিতে তৈরি হবে নতুন বাস্তবতা। তাঁর নেতৃত্বে দেশে ফিরবে গণতন্ত্র, নাগরিক অধিকার। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার নতুন অধ্যায় সূচনা ঘটবে।