বাসস
  ০৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৯:০৪

নারায়ণগঞ্জ সিটির উন্নয়নে ১ হাজার ৬৯৪ কোটি টাকার প্রকল্প গ্রহণ করেছে সরকার

ঢাকা, ৬ ডিসেম্বর, ২০২৫(বাসস) : দেশের অন্যতম প্রাচীন শিল্পনগরী নারায়ণগঞ্জে নিরাপদ পানি সরবরাহ, জলাবদ্ধতা নিরসন এবং জলবায়ু সহনশীল নগর সেবা গড়ে তুলতে ‘নারায়ণগঞ্জ গ্রিন অ্যান্ড রেজিলিয়েন্ট আরবান ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট (এনজিআরইউডিপি)’ হাতে নিয়েছে সরকার।

এ লক্ষ্যে স্থানীয় সরকার বিভাগ নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের (এনসিসি) মাধ্যমে ১ হাজার ৬৯৪ কোটি ৭৬ লাখ টাকার একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে, যার অধিকাংশ অর্থায়ন দিচ্ছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)।

জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) ইতোমধ্যে প্রকল্পটি অনুমোদন করেছে। প্রকল্পটি ২০২৬ সালের এপ্রিল থেকে ২০৩১ সালের মার্চের মধ্যে বাস্তবায়িত হবে।

পরিকল্পনা কমিশনের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বাসসকে জানান, এনজিআরইউডিপি প্রকল্পের প্রধান লক্ষ্য হলো ট্রান্সমিশন এবং ডিস্ট্রিবিউশন লাইনে পর্যাপ্ত চাপ নিশ্চিত করে সারাবছর ২৪ ঘণ্টা নিরাপদ পানি সরবরাহ করা। এই পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে নতুন ট্রান্সমিশন লাইন স্থাপন, বিতরণ নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ, গোদনাইল পানি শোধনাগার এবং প্রোডাকশন টিউবওয়েলের সক্ষমতা জোরদার করা।

প্রকল্পের অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে নন-রেভিনিউ ওয়াটার (এনআরডব্লিউ)- যা বর্তমানে প্রায় ৬৫ শতাংশ, -তা কমিয়ে মাত্র ১৫ শতাংশে নামিয়ে আনা। কর্তৃপক্ষ বলছে, এটি বাস্তবায়িত হলে পানি অপচয় কমবে, কার্যক্রমে দক্ষতা বাড়বে এবং শহরজুড়ে সমানভাবে পানি বিতরণ নিশ্চিত হবে।

এছাড়া ডিএমজেড-৩ এর আওতায় ডিএমএ ৫, ৬ ও ৭ অঞ্চলে নতুন পাইপলাইন নির্মাণ করা হবে। নদী পারাপার পাইপলাইন এবং ইনডিউসড ব্যাংক ফিল্ট্রেশন (আইবিএফ) ব্যবস্থা স্থাপন করে পানির উৎস সম্প্রসারিত করা হবে।

গত একনেক সভায় পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, নারায়ণগঞ্জ একটি বড় শহরে পরিণত হয়েছে, কিন্তু এর পানি সরবরাহ ব্যবস্থায় বড় ধরনের সংস্কার প্রয়োজন। 

তিনি বলেন, মেঘনা নদীর পানি ব্যবহার করা যেতে পারে-যদি গ্রহণস্থল খুব নিচে না থাকে। এছাড়া শীতলক্ষ্যা নদীর পরিশোধিত পানি সরবরাহ করা হবে। ঘরে ঘরে পানির পাইপলাইনও উন্নত করা হবে, যা বর্তমানে পর্যাপ্ত নয়।

প্রকল্পের নাম প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘গ্রিন’ বলতে পরিবেশগত স্থায়িত্ব এবং ‘রেজিলিয়েন্ট’ বলতে স্থায়িত্ব ও টেকসই কাঠামো বোঝায়। তবে আকর্ষণীয় নামের চেয়ে বাস্তবায়নের দিকেই বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।

পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা জানান, অনিয়ন্ত্রিত নগরায়ণ ও জলাধার দখলের কারণে নারায়ণগঞ্জে জলাবদ্ধতা এখন একটি স্থায়ী সমস্যা। সামান্য বৃষ্টিতেও অনেক এলাকায় পানি জমে যায়, যা জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করে এবং পানিবাহিত রোগের বিস্তার ঘটায়।

এই দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা সমাধানে নতুন ড্রেনেজ অবকাঠামো নির্মাণ, পুরোনো ড্রেন পুনর্বাসন এবং যথাযথ লাইনের মাধ্যমে খাল পুনরুদ্ধারের প্রস্তাব রয়েছে। কর্মকর্তারা মনে করেন, এসব পদক্ষেপ জলাবদ্ধতা উল্লেখযোগ্যভাবে কমাবে, পরিবেশের মান উন্নত করবে এবং পানিবাহিত রোগের প্রকোপ কমাবে।

এছাড়া উচ্চচাপের জেটার, ডাম্প ট্রাক ও পাওয়ার রডারসহ ড্রেন পরিষ্কারের আধুনিক যন্ত্রপাতি কেনা হবে, যা এনসিসির রক্ষণাবেক্ষণ সক্ষমতা আরও বাড়াবে।

নারায়ণগঞ্জে জনসাধারণের বিনোদন ও কমিউনিটি স্পেসের ঘাটতি বিবেচনায় রেখে প্রকল্পে পার্ক, খেলার মাঠ, উন্মুক্ত স্থান ও কমিউনিটি সেন্টার নির্মাণের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। এসব সুবিধা তরুণদের বিকাশ, সামাজিক সংহতি ও স্বাস্থ্যকর নগর জীবনকে উৎসাহিত করবে।

প্রকল্পের আওতায় পার্ক এ ও বি এবং বেশ কয়েকটি উন্মুক্ত স্থান ও খেলার মাঠ নির্মাণ বা সংস্কার করা হবে। নিরাপদ পানি সহজলভ্য করতে জনবহুল এলাকায় ওয়াটার এটিএমের জন্য বিশেষ শেড নির্মাণ করা হবে।

প্রকল্পটি টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নাগরিকসেবা প্রদানের জন্য নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়াতেও গুরুত্ব দিচ্ছে। এ জন্য আধুনিক আইটি সরঞ্জাম সরবরাহসহ নগর পরিকল্পনা, পয়:নিষ্কাশন নেটওয়ার্ক ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দীর্ঘমেয়াদি মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করা হবে।

দ্রুত শিল্পায়ন ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে জেলা জুড়ে নগর পরিকল্পনা এখন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কর্মকর্তারা বলেন, এই মাস্টারপ্ল্যানগুলো ভবিষ্যতে কয়েক দশক ধরে জলবায়ু-সহনশীল ও সু-পরিচালিত নগর ব্যবস্থাপনার ভিত্তি তৈরি করবে।

নারায়ণগঞ্জ, সিদ্ধিরগঞ্জ ও কদমরসুল-এই তিনটি পৌরসভা একীভূত করে ২০১১ সালে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন গঠিত হয়েছিল। ২০১৯ সাল পর্যন্ত শহরটির পানিসরবরাহ ছিল ঢাকা ওয়াসার অধীনে। পরবর্তীতে শীতলক্ষ্যা নদীর পানি এবং ভূগর্ভস্থ পানির ওপর ভিত্তি করে এনসিসি নিজস্ব ব্যবস্থা চালু করে। এনসিসি ইতোমধ্যে ২০২০ সালে এডিবি-সমর্থিত সমীক্ষার মাধ্যমে একটি দীর্ঘমেয়াদি পানি সরবরাহ পরিকল্পনাও প্রণয়ন করেছে।

এনজিআরইউডিপি প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে নারায়ণগঞ্জের মূল নগরসেবা আধুনিক হবে, নাগরিক সুবিধা উন্নত হবে এবং পরিকল্পিত নগরায়ণ ত্বরান্বিত হবে। কর্মকর্তারা আশা করছেন, প্রকল্প শেষ হলে নারায়ণগঞ্জ আরও বাসযোগ্য, জলবায়ু-সহনশীল এবং উন্নত জীবনমানসম্পন্ন শহরে রূপ নেবে।