বাসস
  ০১ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৪:০৩

আবাসস্থল হারাচ্ছে গ্রামবাংলার ক্ষুদ্র শিল্পী বাবুই পাখি 

ছবি: বাসস

বিপুল ইসলাম

লালমনিরহাট, ১ ডিসেম্বর, ২০২৫ (বাসস) : কবি রজনীকান্ত সেন তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘স্বাধীনতার সুখ’-এ লিখেছেন—

“বাবুই পাখিকে ডাকি বলিছে চড়াই,

কুঁড়ে ঘরে থেকে কর শিল্পের বড়াই।”

এই লাইনগুলোতে বাবুই পাখির নিখুঁত সৃষ্টিশীলতাকে তুলে ধরা হয়েছে। কবিতার লাইন অনুযায়ী, বাবুই পাখি তার ছোট্ট বাসা এমন নিখুঁতভাবে বানায় যে নিজের কাজ নিয়ে গর্ব অনুভব করে। কবি এই কল্পনীয় দৃশ্যের মাধ্যমে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং শ্রমের প্রশংসা করেছেন, যা বাস্তবে দেখতে এবং কবিতা পড়ে পাঠকের মন ছুঁয়ে যায়।

সাহিত্য, ছড়া ও গানে বাবুই পাখিকে এমনভাবে তুলে ধরা হয়েছে যে এটি আমাদের সংস্কৃতির একটি পরিচিত অংশ হয়ে উঠেছে। তবে এখন দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো লালমনিরহাটেও বাবুই পাখি ও তালগাছ—দুটোই উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে।

কারিগরি দক্ষতার কারণে ‘তাঁতি পাখি’ নামে পরিচিত বাবুই পাখি খড়কুটো বুনে ঝুলন্ত, একাধিক কক্ষবিশিষ্ট এবং শক্ত বাসা তৈরি করে। বাসার প্রবেশপথ সরু সুড়ঙ্গের মতো বাঁকা থাকে, যা শিকারির হাত থেকে সুরক্ষা দেয়। দেশে তিন ধরনের বাবুই পাখি পাওয়া যায়—দেশি, দাগি এবং কালো বুক। 

দেশি বাবুই তুলনামূলকভাবে বেশি দেখা গেলেও, দাগি ও কালো বুক বিপন্ন বা বিলুপ্তপ্রায়। বাবুই পাখির আয়ুষ্কাল সাধারণত চার বছর। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়ায় এ পাখি বিস্তৃত।

বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান ইয়াসিন আলী মোল্লা (৭০) বলেন, একসময় গ্রামবাংলার তালগাছের পাতায় বাবুই পাখির বাসা সাধারণ দৃশ্য ছিল। এখন সারিবদ্ধ তাল, নারিকেল ও সুপারি গাছ পাওয়া যায় না। আধুনিকতার প্রভাবে এসব গাছ কমে যাওয়ায় বাবুই পাখির প্রাকৃতিক আবাসও সংকুচিত হচ্ছে।

দেউতির হাট দিমুখি উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক নুরু উদ্দিন মাস্টার (৪৮) জানান, বাবুই পাখি শান্ত পরিবেশে উচ্চ ও নিরিবিলি গাছে বাসা বানাতে পছন্দ করে। প্রধানত তাল, নারিকেল, সুপারি ও খেজুর গাছই তাদের প্রিয় আবাসস্থল। গাছের সংকটে মাঝে মাঝে হিজল গাছেও বাসা বানাতে দেখা যায়।

জেলা সামাজিক বনায়ন কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. আনিছুর রহমান বলেন, পরিবেশ বিপর্যয়, বন উজাড়, তালগাছ নিধন ও শিকারি ফাঁদের কারণে বাবুই পাখির আবাস কমে গিয়েছিল। সরকারি উদ্যোগে তাল ও নারিকেলসহ বিভিন্ন গাছ রোপণের ফলে ধীরে ধীরে আগের স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরছে, এবং এখন পাখির উপস্থিতি আগের তুলনায় বেড়েছে।

পুরনো গাছ সংরক্ষণ ও শিকার নিয়ন্ত্রণে সচেতনতা বৃদ্ধি করলে বাবুই পাখিকে প্রকৃতিতে পুনরায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব।

অপর দিকে, জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ড. মো. সাইখুল আরিফিন জানান, সরকারের নির্দেশনায় গ্রামাঞ্চলের সড়কের দুই পাশে তালগাছের বীজ ও গাছ রোপণ করা হচ্ছে। আশা করছি, এই উদ্যোগ ধীরে ধীরে প্রকৃতিকে তার স্বাভাবিক ভারসাম্যে ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করবে।

প্রকাশিত গবেষণা ও পাখিবিষয়ক বইগুলোতে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশে বাবুই পাখির সংখ্যা দ্রুত কমে যাচ্ছে। পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেছেন, এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া না হলে এই প্রজাতি আরও সংকটে পড়বে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, বাবুই পাখির প্রাকৃতিক আবাসস্থল রক্ষা ও পুনর্বাসনে স্থানীয় সম্প্রদায়, সরকারি প্রতিষ্ঠান এবং বেসরকারি সংস্থার সমন্বিত উদ্যোগ জরুরি। তাল, নারিকেল ও সুপারি গাছ সংরক্ষণ, পাশাপাশি টেকসই বনায়ন বাড়ানোর মাধ্যমে পাখির বসবাসযোগ্য পরিবেশ পুনর্গঠনের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।