বাসস
  ২৭ জুন ২০২৫, ১৪:০৮

বিচার ও বিক্ষোভের আশঙ্কায় সংকটের মুখোমুখি থাইল্যান্ড

ঢাকা, ২৭ জুন, ২০২৫ (বাসস) : থাইল্যান্ডের সাবেক প্রধানমন্ত্রী থাকসিন সিনাওয়াত্রার বিচার আগামী সপ্তাহে শুরু হতে যাচ্ছে। এটি এমন এক সময়ে শুরু হতে যাচ্ছে, যখন দেশটি রাজনৈতিক অস্থিরতার দ্বারপ্রান্তে। 

তার মেয়ে প্রধানমন্ত্রী পায়েতংতার্ন সিনাওয়াত্রাকে পদচ্যুত করার উদ্যোগ চলছে ও কর্মীরা গণবিক্ষোভের হুমকি দিচ্ছেন।

ব্যাংকক থেকে এএফপি জানায়, রক্ষণশীল শক্তিগুলো সিনাওয়াত্রা পরিবারের বিরুদ্ধে তাদের দীর্ঘদিনের দ্বন্দ্ব আবারও উসকে দিয়েছে। যার ফলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি নতুন করে এক রাজনৈতিক টানাপড়েনে জড়িয়ে পড়েছে।

আগামী সপ্তাহগুলোতে একাধিক আদালত শুনানি অনুষ্ঠিত হবে। শুনানির পর ৭৫ বছর বয়সী কোটিপতি থাকসিনকে কারাগারে পাঠানো হতে পারে এবং প্রধানমন্ত্রী পায়েতংতার্নের স্বল্প সময়ের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের ইতিও ঘটতে পারে।

রাজদ্রোহ মামলার বিচার মঙ্গলবার থেকে শুরু হচ্ছে, যেখানে অভিযোগ করা হয়েছে যে, ২০১৫ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার একটি পত্রিকায় দেওয়া সাক্ষাৎকারে থাকসিন রাজপরিবারকে অবমাননা করেন। থাইল্যান্ডের কড়া ‘লেসে-মাজেস্তে’ আইনের আওতায় এই অপরাধে সর্বোচ্চ ১৫ বছর কারাদণ্ড হতে পারে।

বিচার প্রক্রিয়া চলবে তিন সপ্তাহ, তবে রায় ঘোষণায় এক মাস বা তার বেশি সময়ও লাগতে পারে।

থাইল্যান্ডের এই রাজদ্রোহ আইন রাজা মহা ভাজিরালংকর্ণ ও তার ঘনিষ্ঠ পরিবারকে অবমাননা বা সমালোচনা থেকে সুরক্ষা দেয়। 

তবে সমালোচকদের মতে, এই আইনটি মতপ্রকাশ ও গণতান্ত্রিক বিতর্ক দমনে ব্যবহৃত হচ্ছে।

এদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সম্ভাব্য বাণিজ্য শুল্ক হুমকির মুখে থাইল্যান্ডের পর্যটন নির্ভর অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের চেষ্টার সময়ই এই রাজনৈতিক নাটক সামনে এসেছে।

থাইল্যান্ড বর্তমানে কম্বোডিয়ার সঙ্গে একটি উত্তপ্ত সীমান্ত বিরোধের মুখেও রয়েছে।

ফোনকল কেলেঙ্কারি

প্রধানমন্ত্রী পায়েতংতার্নের নেতৃত্বাধীন সরকার বর্তমানে টালমাটাল অবস্থায়। গত সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রী ও প্রাক্তন কম্বোডীয় নেতা হুন সেনের মধ্যে ফাঁস হওয়া একটি ফোন কলের জেরে রক্ষণশীল ভুমজাইথাই পার্টি জোট ত্যাগ করলে সরকার সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারায়।

ফাঁস হওয়া অডিওতে পায়েতংতার্ন এক থাই সেনা কর্মকর্তাকে নিয়ে অবমাননাকর মন্তব্য করেন এবং হুন সেনকে ‘চাচা’ বলে সম্বোধন করেন।

এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে সমালোচকরা তাকে সেনাবাহিনীর প্রতি অসম্মান এবং বিদেশি নেতার প্রতি অতিরিক্ত শ্রদ্ধা প্রদর্শনের অভিযোগে পদত্যাগের দাবি জানান।

যদিও তিনি ক্ষমা চেয়ে জোট ধরে রাখতে সক্ষম হন, তবু রক্ষণশীল সিনেটরদের একটি দল সাংবিধানিক আদালতে আবেদন করে তার অপসারণ দাবি করেছে।

আদালতের  প্রেসিডেন্ট নাখারিন মেকত্রাইরাত সাংবাদিকদের জানান, আদালত মঙ্গলবার এই মামলা গ্রহণ করবে কি না তা নির্ধারণ করতে পারে। সিদ্ধান্ত নেবেন নয়জন বিচারক।

মামলা গৃহীত হলে তাকে পদ থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হতে পারে। চূড়ান্ত রায় দিতে আদালতের কয়েক মাস সময় লাগতে পারে।

২৫ বছরের রাজনৈতিক সংঘাত

পায়েতংতার্ন ও থাকসিনের মামলাগুলো থাইল্যান্ডের রাজতন্ত্রপন্থী, সামরিক ঘনিষ্ঠ রক্ষণশীল অভিজাত শ্রেণি ও থাকসিন ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে চলমান ২৫ বছরের দ্বন্দ্বের সর্বশেষ অধ্যায়।

থাকসিন ২০০০ সালের গোড়ার দিকে দুবার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন এবং তার নীতির মাধ্যমে অনেক গ্রামীণ ভোটারের জীবনে পরিবর্তন আনেন, ফলে তিনি এখনো তাদের কাছে জনপ্রিয়।

তবে রক্ষণশীল রাজনৈতিক ও সামরিক অভিজাতরা তাকে বরাবরই দুর্নীতিগ্রস্ত ও স্বজনপ্রীতিতে অভিযুক্ত করে আসছে এবং মনে করে তিনি দেশের প্রচলিত সামাজিক কাঠামোর জন্য হুমকি।

২০০৬ সালে তিনি সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হন। তার বোন ইংলাক সিনাওয়াত্রাও ২০১৪ সালে একই পরিণতির শিকার হন। তাদের রাজনৈতিক দলের আরও কয়েকজন নেতাকেও আদালতের মাধ্যমে অপসারণ করা হয়েছে।

১৫ বছর বিদেশে কাটানোর পর থাকসিন ২০২৩ সালের আগস্টে দেশে ফিরে আসেন। দুর্নীতির মামলায় তিনি ৮ বছরের কারাদণ্ড পান, তবে স্বাস্থ্যগত কারণে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় এবং পরে রাজা তাকে ক্ষমা করে দেন। এই ক্ষমার বিষয়টি বিশেষ সুবিধা ছিল কি-না, তা নিয়ে নতুন বিচার বিভাগীয় তদন্ত শুরু হয়েছে।

থাকসিনের ঘন ঘন জনসমক্ষে উপস্থিতি তার পুরনো শত্রুদের ক্ষুব্ধ করে তুলেছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের প্রাক্তন মহাসচিব প্যারাডর্ন পাত্তানাতাবুত বলেন, তার শত্রুরা কখনো হারিয়ে যায়নি, তারা এখনো আছে। তাদের সঙ্গে নতুন শত্রুও যোগ হয়েছে, এমনকি পুরোনো বন্ধুরাও তার শত্রুতে রূপান্তরিত হয়েছে।

১৯৩২ সালে থাইল্যান্ডে নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্রের অবসানের পর থেকে দেশটিতে বেশ কয়েকটি সামরিক অভ্যুত্থান হয়েছে।

বর্তমান সংকট ঘিরে আরেকটি সম্ভাব্য সেনা হস্তক্ষেপ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে।

পায়েতংতার্নের ফাঁস হওয়া ফোন কলের পর সেনাবাহিনীর প্রতি দৃঢ় সমর্থন জানিয়ে সামরিক-সমর্থিত ফেসবুক পেজগুলিতে উত্তেজনাকর পোস্টও দেখা যাচ্ছে।

তবে এক নিরাপত্তা সূত্র এএফপিকে জানায়, প্রচলিত অর্থে ট্যাংক নিয়ে রাস্তায় নেমে অভ্যুত্থান এখন অপ্রয়োজনীয় ও কঠিন। বরং আদালত বা নির্বাচন কমিশনের মতো প্রতিষ্ঠান ব্যবহার করে ‘নীরব অভ্যুত্থান’ ঘটানোই বর্তমান কৌশল।

রাংসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক বিশ্লেষক ওয়ানউইচিট বুনপ্রং বলেন, এই ধরনের গোপন কর্তৃত্ববাদ এখন আরও কার্যকর পদ্ধতি হয়ে উঠেছে।

এই উত্তেজনার মধ্যেই শনিবার বিশাল একটি বিক্ষোভ সমাবেশের ডাক দিয়েছে একটি রাজনৈতিক কর্মী গোষ্ঠী, যারা অতীতে সরকারের পতনেও বড় ভূমিকা রেখেছিল।