শিরোনাম
বাসস, ২০ জুন, ২০২৫ (বাসস) : থাইল্যান্ডের পশ্চিমাঞ্চলের ঘন, স্যাঁতসেঁতে বনভূমিতে হঠাৎই একদল চঞ্চল সাম্বার হরিণ দৌড়ে বেরিয়ে যায় খাঁচা থেকে। বিশটি হরিণ, মুহূর্তেই হারিয়ে যায় পাতার আড়ালে, ঝোপের ভেতরে, যেন মুক্তির আনন্দে বিভোর। তারা টেরও পায় না, এই বনেই ঘাপটি মেরে আছে প্রায় ২শ’ বিপন্ন বাঘ, যাদের হিংস্র চোয়ালের সামনে, পলকেই হারিয়ে যাওয়া সেই দৌড় একদিন থেমে যাবে।
এই দৃশ্য কেবল একটি হরিণ অবমুক্তকরণ কর্মসূচির অংশ নয়। এটি এক পূর্ণাঙ্গ প্রকল্প, যেখানে থাইল্যান্ড সরকার এবং বিশ্ব প্রকৃতি সংরক্ষণ তহবিল (ডব্লিউডব্লিউএফ) হাত মিলিয়ে বাঘের জন্য খাদ্য-চক্র পুনর্গঠনে কাজ করছে। এই উদ্যোগই বদলে দিয়েছে থাইল্যান্ডের পশ্চিমাঞ্চলের বাঘের ভবিষ্যৎ।
মিয়ানমার সীমান্তবর্তী থাইল্যান্ডের পশ্চিমাঞ্চলের বিস্তৃত বনভূমি, যা ‘ওয়েস্টার্ন ফরেস্ট কমপ্লেক্স’ নামে পরিচিত। এতে বন্য বাঘের সংখ্যা গত ১৫ বছরে প্রায় পাঁচগুণ বেড়েছে। ২০০৭ সালে সেখানে বাঘ ছিল মাত্র ৪০টি। আর ২০২৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৭৯ থেকে ২২৩টির মধ্যে। দেশটির জাতীয় উদ্যান বিভাগ (ডিএনপি) এ তথ্য জানিয়েছে।
ডব্লিউডব্লিউএফের ‘টাইগার্স অ্যালাইভ’ প্রকল্পের প্রধান স্টুয়ার্ট চ্যাপম্যান একে ‘অসাধারণ’ সাফল্য বলে উল্লেখ করেছেন। কারণ একই সময়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্য কোনো দেশে বাঘের সংখ্যা এভাবে বাড়েনি।
এই পরিবর্তনের পেছনে রয়েছে সাম্বার হরিণ। থাইল্যান্ডে স্বাভাবিকভাবে জন্ম নেওয়া এই হরিণ এখন বিপন্ন শ্রেণিতে। প্রকল্পের আওতায় দেশটির জাতীয় উদ্যান বিভাগ ও ডব্লিউডব্লিউএফ এদের প্রজনন বৃদ্ধি করে অবমুক্ত করছে বাঘের প্রাকৃতিক শিকার হিসেবে।
এবার প্রকল্পটি পঞ্চম বছরে পা রেখেছে। ডিএনপি’র কর্মকর্তা ছাইয়া দানফো বলেছেন, ‘বাঘের খাদ্য হিসেবে বড় আকৃতির তৃণভোজী প্রাণীর অভাব দূর করতে এটি একটি অত্যন্ত কার্যকর উদ্যোগ।’
ডব্লিউডব্লিউএফ থাইল্যান্ডের গবেষণা ব্যবস্থাপক ওয়ারাপান ফুমানী বলেছেন, একসময় এই এলাকায় হরিণ ছিল খুবই বিরল। সেই কারণে বাঘের সংখ্যাও কমে গিয়েছিল। তবে প্রকল্প শুরু হওয়ার পর থেকে এখানে নিয়মিতই বাঘ দেখা যাচ্ছে এবং তারা সফলভাবে বংশবৃদ্ধিও করছে।’
-অঞ্চলজুড়ে হুমকির মুখে বাঘ, ব্যতিক্রম থাইল্যান্ডে-
কম্বোডিয়া, লাওস ও ভিয়েতনামে এরই মধ্যে ইন্দোচাইনিজ বাঘ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। মিয়ানমারে বর্তমানে মাত্র ২৩টি বাঘ টিকে আছে বলে ধারণা করা হয়, যার প্রধান কারণ শিকার ও বন্যপ্রাণী পাচার।
আন্তর্জাতিক প্রকৃতি সংরক্ষণ সংস্থা (আইইউসিএন)-এর তথ্যমতে, গত এক শতকে বিশ্বজুড়ে বাঘের সংখ্যা প্রায় ১ লাখ থেকে কমে মাত্র সাড়ে ৫ হাজারে নেমে এসেছে। এর পেছনে প্রধান কারণ বন্য পরিবেশ ধ্বংস এবং বাঘ ও তাদের প্রাকৃতিক শিকার প্রাণীদের অতিরিক্ত শিকার।
তবে ভারত ও নেপালেও উল্লেখযোগ্য হারে বাঘ বেড়েছে। বেঙ্গল টাইগারের সংখ্যা বর্তমানে ভারতে ৩ হাজার ৬০০ ও নেপালে ৩৫৫টি। এটিও সম্ভব হয়েছে সফল সংরক্ষণ উদ্যোগের কারণে।
‘অবিশ্বাস্যভাবে সফল’ প্রকল্প
থাইল্যান্ডের খলং লান জাতীয় উদ্যানে একটি উন্মুক্ত বনভূমিতে জাতীয় উদ্যান বিভাগের কর্মীরা সাম্বার হরিণের খাঁচা খুলে দেন। ১০টি পুরুষ ও ১০টি স্ত্রী হরিণ কিছুক্ষণ সেখানে চারণ করছিল। তাদের থেকে একটি সাহসী হরিণ প্রথমে দৌড়ে বেরিয়ে যায়। পরে বাকিরাও তাকে অনুসরণ করে দ্রুত জঙ্গলে মিলিয়ে যায়।
ওয়ারাপান বলেন, শিকার অবমুক্তির এই প্রকল্প এখন কেবল থাইল্যান্ড নয়, বরং কম্বোডিয়া ও মালয়েশিয়াতেও চলছে। আফ্রিকায় দীর্ঘদিন ধরে চলা এমন প্রকল্পগুলোর আদলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় স্থানীয়ভাবে নতুন করে সাজানো হয়েছে এই কর্মসূচি।
এই প্রকল্প সাম্বার হরিণের সংখ্যাও বাড়াতে সহায়তা করছে, যা শিকার ও মানুষের হস্তক্ষেপে আগের তুলনায় অনেক কমে গিয়েছিল।
তিনি আরো বলেন, হরিণ অবমুক্তির উদ্দেশ্য শুধু বাঘের খাদ্য নিশ্চিত করা নয়, বরং হরিণ প্রজাতির পুনরুদ্ধারও।
প্রত্যেক হরিণের গলায় জিপিএস কলার লাগানো হচ্ছে, যাতে অবমুক্তির পর তাদের চলাফেরা পর্যবেক্ষণ করা যায়।
ওয়ারাপান বলেন, ক্যাপটিভ বা খাঁচাবন্দি অবস্থায় বেড়ে উঠলেও এই হরিণগুলো পরিবেশের হুমকি মোকাবেলায় বেশ দক্ষতার পরিচয় দিচ্ছে। তারা শুধু বসে থাকে না, বরং শিকারি থেকে বাঁচতে নতুন নতুন কৌশল রপ্ত করে এবং নিরাপদ জায়গাও খুঁজে নেয়।
অন্যদিকে, ছাইয়া দানফো জানান, অবমুক্ত করা অধিকাংশ হরিণই শিকারির খাবারে পরিণত হয়। তবে বাকিরা সফলভাবে বংশবৃদ্ধিও করে।
তিনি আরো জানান, এই হরিণ ও তাদের বংশধররা পরিবেশের খাদ্যশৃঙ্খলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে এবং বাঘের মতো শিকারিদের জন্য প্রাকৃতিক খাদ্য উৎস হিসেবে কাজ করছে।
বিশ্বব্যাপী বিলুপ্তির মুখে থাকা বাঘ প্রজাতির টিকে থাকা নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। একসময় বনভূমিতে যাদের রাজত্ব ছিল, সেই বাঘের সংখ্যা এখন হাতেগোনা। বন ধ্বংস, শিকার ও খাদ্য সংকটে পড়ে প্রাকৃতিক ভারসাম্যের অন্যতম এই শিকারি প্রাণীটি চরম হুমকির মুখে। তাদের বাঁচাতেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এমন উদ্যোগ নিয়েছে, পেয়েছে সাফল্যও।