বাসস
  ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১২:১২

ইতিহাস, ঐতিহ্য, রুচি ও আভিজাত্যের সাক্ষী রোজ গার্ডেন

‘রোজ গার্ডেন’। ছবি: বাসস

\ মাহামুদুর রহমান নাযীদ \

ঢাকা, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ (বাসস): পুরান ঢাকার যানজট, ধুলোবালি, সরু গলি, টং দোকান ও মানুষের কোলাহল পেরিয়ে প্রচীন এক ভবনের মূল ফটকে এসে দাঁড়াতেই চোখ আটকে গেল। ভবনের সাইনবোর্ডে লেখা ‘রোজ গার্ডেন’। 

প্রথমে মনে হবে এটি ফুলের বাগানের কিংবা নার্সারির নাম। কিন্তু না, এটি ঢাকার এক ঐতিহ্যবাহী বাগানবাড়ির নাম।

রোজ গার্ডেন নামের পাশে বাগান থাকলেও এটি মূলত পুরান ঢাকার কে এম দাস লেইন, টিকাটুলিতে অবস্থিত একটি শিল্পিত ও ঐশ্বর্য্যময় বাগানবাড়ি। 

রোজ গার্ডেনের গল্প শুরু উনিশ শতকের শেষ দিক থেকে। ১৯৩০ সালে বাগানবাড়িটিতে সদূর চীন, ভারত, জাপান ও ইউরোপের নানান দেশ থেকে গোলাপের চারা এনে রোপণ করেন ঋষিকেশ দাস। মূলত গোলাপ গাছ সমৃদ্ধ বাড়ি হওয়ার কারণেই এর নাম হয় ‘রোজ গার্ডেন’।

ঋষিকেশ দাস ছিলেন ব্রিটিশ আমলের নতুন ধনাঢ্য ব্যবসায়ী। তবে তিনি সাধারণ পরিবারে বড় হওয়ার কারণে ঢাকার সম্ভ্রান্ত শ্রেণিতে তার তেমন কদর ছিল না। 

ইতিহাস থেকে জানা যায়, একবার জমিদার নরেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরীর বাগানবাড়িতে জলসায় গিয়ে অপমানিত হয়ে ফিরে আসেন ঋষিকেশ দাস। অপমানের প্রতিশোধ নিতে তিনি বাগানবাড়ি নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন। গড়ে তোলেন তার প্রতিশোধের ‘রোজ গার্ডেন’। প্রায় ২২ বিঘা জমির ওপর বাগানবাড়িটি নির্মাণ করেন ঋষিকেশ দাস। দোতলা বাড়ির চারপাশ বিভিন্ন দেশ থেকে আনা দুর্লভ প্রজাতির গোলাপের বাগানে সাজিয়ে তোলেন তিনি। সেই থেকে এর নাম হয় ‘রোজ গার্ডেন’।

ঋষিকেশ দাস ১৯৩৬ সালের দিকে ব্যবসায়ী খান বাহাদুর কাজী আবদুর রশীদের কাছে বাগান বাড়িটি বিক্রি করেন। তখন বাড়িটির নাম রাখা হয় ‘রশীদ মঞ্জিল’। কিন্তু ‘রোজ গার্ডেন’ নামটি মানুষের মুখে মুখে থেকেই যায় । পরবর্তীকালে বাড়িটির মালিকানা পান তার বড় ভাই কাজী হুমায়ুন বশীর। এ কারণে  ভবনটি ‘হুমায়ুন সাহেবের বাড়ি’ নামে পরিচিতি পায়। ১৯৭০ সালে বেঙ্গল স্টুডিও ও মোশন পিকচার্স লিমিটেড রোজ গার্ডেনের ইজারা নেয়। ১৯৮৯ সালে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এটিকে সংরক্ষিত ভবন হিসেবে ঘোষণা করে। কিন্তু আদালতে মামলা করে ১৯৯৩ সালে মালিকানা পায় কাজী আবদুর রকীব। এরপর ভবনটির মালিকানা যায় তার স্ত্রী লায়লা রকীবের কাছে। সর্বশেষ ২০১৮ সালে বাংলাদেশ সরকার ভবনটি ৩৩১ কোটি ৭০ লাখ টাকায় কিনে নেয়।

বাড়িটিতে শ্বেত পাথরের মূর্তি, কৃত্রিম ফোয়ারা, শান বাঁধানো পুকুর, বিশাল বাগান, গোলাপ গাছের সারি রয়েছে। রোজ গার্ডেনের দৃষ্টিনন্দিত সাদা দালানটি গ্রিক শৈলীর আদলে নির্মাণ করা হয়েছে। সাদা দেয়ালের পাশে সবুজের আভা, তার সাথে হরেক রঙের গোলাপের শোভা এক মনোমুগ্ধকর পরিবেশ তৈরি করেছে। মার্বেল পাথরের মেঝে, ছাদে ইউরোপীয় শৈলির কারুকাজ আর খিলান আকৃতির দরজা, দৃষ্টিনন্দন ঝাড়বাতি, প্রশস্ত সিঁড়ি, জানালায় খোদাই করা কাজ আর সুবিশাল নাচঘর ভবনটিকে করেছে সবিশেষ। এর প্রতিটি কক্ষে সাজানো আসবপত্রগুলো জানান দিচ্ছে পুরোনো দিনের আভিজাত্যের। ভবনের ডান পাশেই গোলাপের বাগান রয়েছে। বর্তমানে ফুল না থাকলেও মৌসুমে এর সৌরভে ছড়িয়ে পড়ে চারদিক। 

প্রতিদিন দেশি-বিদেশি দর্শনার্থীর পদচারণায় মুখরিত হয় রোজ গার্ডেন। মূল ভবনের সামনেই রয়েছে একটি পুকুর। পুকুরের দুই পাশে ঠিক মাঝামাঝি জায়গায় রয়েছে শান বাঁধানো পাকা ঘাট।

অনেক দিন বন্ধ থাকার পর সংস্কার শেষে নতুন রূপে ফিরেছে ভবনটি। ঐতিহাসিক স্থাপনা হিসেবে সংরক্ষণের জন্য সরকার এটি অধিগ্রহণ করেছে। ভবনটিতে প্রবেশ করতে পারবেন সকাল ১১টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত। তবে এটি রবিবার পুরোদিবস এবং সোমবার অর্ধদিবস বন্ধ থাকে। ভবনটিতে প্রবেশে ৩০ টাকার টিকেট কিনতে হবে।

রোজ গার্ডেনে নানা উপায়ে যাওয়া যায়। গুলিস্তান, পল্টন থেকে রিকশা যোগে ৮০-১০০ টাকায় যেতে পারবেন সেখানে। অথবা মেট্রোরেল যোগে মতিঝিল থেকে রিকশা নিয়েও যাওয়া যাবে। গুগল ম্যাপে ‘রোজ গার্ডেন’ সার্চ করলেই সহজেই ঢাকার যে কোন জায়গা থেকে যেতে পারবেন সেখানে।

যারা ছবি তুলতে ভালোবাসেন তাদের জন্য রোজ গার্ডেন হতে পারে স্বর্গরাজ্য। প্রাচীন প্রাসাদের সামনে, ফোয়ারার পাশে, ফুলের বাগানে, শান বাঁধানো পুকুরে, প্রাচীন মূর্তির সামনে ক্যামেরায় বন্দি করতে পারেন নিজেকে। যারা প্রাচীন স্থাপত্যে ছবি তুলতে পছন্দ করেন তাদের জন্য রোজ গার্ডেন একটি আকর্ষণীয় স্থান হতে পারে।

রোজ গার্ডেনে ঘুরতে আসা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রাইসা ইসলামের সাথে কথা হয় বার্তা সংস্থা বাসস’র। তিনি বলেন, ‘অনেকদিন পরিকল্পনা করে বন্ধুদের নিয়ে এখানে এসেছি। এখানকার পরিবেশ যথেষ্ট ভালো। চারদিকে কোলাহল থাকলেও ভেতরের পরিবেশ চমৎকার। এখানে এলে পুরনো ফিরে যাওয়া যায়। ওইসময়কার মানুষের রুচির প্রশংসা করতেই হয়। এতো সুন্দর গুছানো পরিবেশ সচরাচর খুব কম দেখা যায়।’

আরেক শিক্ষার্থী জাহিদুর ইসলাম রিফাত বলেন, ‘পুরান ঢাকায় ঘুরতে আসলে সাধারণত মানুষ  লালবাগ কেল্লা বা আহসান মঞ্জিল দেখতে যায়। কিন্তু আমি মনে করি, রোজ গার্ডেন দেখতে আসা উচিত। আমি এখানে এসেছি ফেসবুকে ছবি দেখে। তবে ছবিতে রোজ গার্ডেন যতটা সুন্দর দেখায়, বাস্তবে তার চেয়েও বেশি আকর্ষণীয় মনে হয়েছে আমার।’