শিরোনাম

ইব্রাহিম খলিল মামুন
কক্সবাজার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০২৫ (বাসস): পশ্চিমে হেলে পড়েছে লাল সূর্য। সাগরের বালুচরে বসানো চেয়ারে বসে (কিটকট) সেই সূর্যের অপরূপ রূপ উদাস দৃষ্টিতে দেখছেন কেউ। আবার কেউ বালুচরে দাঁড়িয়ে সূর্যকে পেছনে রেখে ছবি তোলায় ব্যস্ত। সবমিলিয়ে বছরের শেষ সূর্যাস্ত দেখতে সমুদ্রসৈকতে ছিল পর্যটকদের উপচে পড়া ভিড়। আজ বুধবার বিকেলে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে দেখা গেছে এমন চিত্র।
তবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)’র চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে শোক পালনের অংশ হিসেবে তারকামানের হোটেলগুলো তাদের থার্টি ফার্স্ট নাইটের আয়োজন বাতিল করেছে।
কক্সবাজার জেলা পুলিশের মুখপাত্র ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার অলক বিশ্বাস বাসসকে জানান, থার্টি ফার্স্ট নাইট উদ্যাপন উপলক্ষে কক্সবাজার শহর এলাকাসহ সমুদ্র সৈকতে আতশবাজি, পটকা ও ফানুস ওড়ানো সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। একই সঙ্গে যেকোনো ধরনের দুর্ঘটনা এড়াতে আতশবাজি ও ফটকা বিক্রি ও বিপণন কেন্দ্র বন্ধ রাখারও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া জেলার উন্মুক্ত স্থান ও রাস্তায় প্রকাশ্যে কোনো ধরনের কনসার্ট, নাচ কিংবা গানের অনুষ্ঠান আয়োজন না করারও জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থে ৩১ ডিসেম্বর সন্ধ্যা ৬টা থেকে ১ জানুয়ারি সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত কক্সবাজার জেলার সকল বার ও মদের দোকানে মদ ক্রয়-বিক্রয় বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
থার্টি ফার্স্ট নাইট উপলক্ষে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব, অপপ্রচার ও উস্কানিমূলক বক্তব্য ছড়িয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করা, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানো, নাশকতা, সহিংসতা কিংবা বোমা হামলাসহ যেকোনো ধরনের ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড থেকে সবাইকে বিরত থাকার আহ্বান জানান অলক বিশ্বাস।
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় আরো নিষিদ্ধ করা হয়েছে উচ্চ শব্দে গাড়ির হর্ন বাজানো, প্রতিযোগিতা, জয় রাইড এবং বেপরোয়া গতিতে গাড়ি বা মোটরসাইকেল চালানো। থার্টি ফার্স্ট নাইট উদযাপন উপলক্ষে আগত নারী পর্যটকদের কোনো ধরনের ইভটিজিং বা উত্ত্যক্ত না করার বিষয়েও কঠোরভাবে সতর্ক করা হয়েছে।
আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে হোটেল ও মোটেলসমূহে ইনডোরে কোনো অনুষ্ঠান আয়োজন করা হলে সে বিষয়ে এবং আগত সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের তথ্য ডিএসবি (ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চ)কে অবহিত করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
সরেজমিনে বিকেল ৪টায় সমুদ্রসৈকতের সুগন্ধা পয়েন্টে গিয়ে দেখা যায়, এক কিলোমিটার সৈকতে অন্তত ৫০ হাজার পর্যটকের সমাগম হয়েছে। ভাটার কারণে পানি নেমে যাওয়ায় দেখা দেয় বিশাল বালুচর। সেখানে প্রিয়জনদের নিয়ে বছরের শেষ সূর্যাস্তের মুহূর্ত ক্যামেরায় বন্দী করতে পর্যটকেরা ব্যস্ত রয়েছেন। সবারই যেন চোখ ডুবন্ত সূর্যের দিকে। বিকেল সোয়া ৫টার দিকে ডুবে যায় সূর্য। পর্যটকদের অনেকেই তখন হইহুল্লোড় শুরু করে দেন। অনেকে হাত তুলে বিদায় জানান সূর্যকে। উচ্চ স্বরে অনেককে বলতে শোনা যায়, বিদায় ২০২৫।
ঢাকার মোহাম্মদপুর থেকে আসা স্কুল শিক্ষক মোনালিসার (৩০) সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, কক্সবাজার সৈকতের মূল আকর্ষণ সূর্যাস্ত উপভোগ করা। বছরের শেষ সূর্যের লাল আভায় সাগরের পানি যেন রঙিন হয়ে উঠে। এমন দৃশ্য দেখতে খুবই ভালো লাগে।
সৈকতের কলাতলী, সীগাল ও লাবণী পয়েন্টে দাঁড়িয়েও লাখো পর্যটক বছরের শেষ সূর্যকে বিদায় জানান। তবে সমুদ্রসৈকতের উন্মুক্ত স্থানে হয়নি বর্ষবিদায়ের কোনো অনুষ্ঠান। এতে অনেক পর্যটক হতাশা প্রকাশ করেন।
হোটেল মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বছরের শেষ সূর্যকে বিদায় জানাতে আজ বুধবার সৈকতে অন্তত দেড় লক্ষাধিক পর্যটকের সমাগম হয়েছে। নিরাপত্তার কারণে গত আট বছরের মতো এ বছরও সৈকতে বর্ষবিদায় অনুষ্ঠান হয়নি।
তবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মৃত্যুর খবরে শোকের আবহ তৈরি হয়েছে। তাঁর মৃত্যুতে তিন দিনের রাষ্ট্রীয় শোক পালনের ঘোষণা দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। ঘোষণা অনুযায়ী বুধবার সাধারণ ছুটি।
বর্তমানে কক্সবাজার শহরের পাঁচ শতাধিক হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট, গেস্টহাউস ও কটেজের প্রায় ৯০ শতাংশ রুম পর্যটককে ভরা রয়েছে। হোটেলগুলোর দৈনিক ধারণক্ষমতা প্রায় ১ লাখ ৬৭ হাজার। পর্যটনসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২৫ ডিসেম্বর থেকে ৩১ ডিসেম্বর—এই সাত দিনে অন্তত সাড়ে আট লাখ পর্যটক কক্সবাজার ভ্রমণ করেছেন।
তারকা হোটেল ওশ্যান প্যারাডাইসের পরিচালক আবদুল কাদের মিশু বাসসকে বলেন, ‘কক্সবাজারে বিশ্বমানের পর্যটন বিকাশে আমরা শুরু থেকেই বাংলা নববর্ষ, থার্টিফার্স্ট নাইটসহ নানা দিবসকে পর্যটকদের কাছে উপভোগ্য করে তুলি। পর্যটক চাহিদার কারণে এবছরও বলরুমে ইনহাউজ গেস্টদের জন্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও ডিজে পার্টির আয়োজন ছিল। তবে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বেগম খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে আয়োজন সীমিত করে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়েছে।
বেগম খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে তারকা হোটেল গুলোতে থার্টি ফাস্ট নাইটের আয়োজন বন্ধ রাখা হয়েছে জানিয়ে কক্সবাজার হোটেল মোটেল গেস্টহাউস মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কাশেম সিকদার বাসসকে বলেন, প্রতিবছর বিপুলসংখ্যক পর্যটক সৈকতে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখে পুরোনো বছরকে বিদায় জানান। তবে ঘন কুয়াশা থাকায় এবার সূর্যাস্ত ভালোভাবে দেখা যায়নি। সৈকত ও উন্মুক্ত স্থানে কোনো আয়োজন না থাকলেও পর্যটকের আগমন থেমে নেই।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) মো. শাহিদুল আলম বাসসকে বলেন, থার্টি ফার্স্ট নাইট উপলক্ষে সৈকতের কোথাও উন্মুক্ত স্থানে কনসার্ট কিংবা অন্য কোনো অনুষ্ঠানের অনুমতি কাউকে দেওয়া হয়নি। সৈকতে আতশবাজি, পটকা ফুটানো নিষিদ্ধ। তবে প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে একাধিক তারকা হোটেল কনসার্টের আয়োজন করলেও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে সরকারিভাবে তিনদিনের শোক ঘোষণা করায় তা হোটেল কর্তৃপক্ষরা বন্ধ রেখেছেন।
তিনি বলেন, কোন ধরনের হয়রানি কিংবা প্রতারণার শিকার না হয়ে পর্যটকরা যাতে নির্বিঘ্নে কক্সবাজার ভ্রমণ করতে পারেন, তার জন্য জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে একাধিক ভ্রাম্যমাণ আদালতের টিম মাঠে রয়েছে। অভিযোগ পাওয়ার সাথে সাথে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।