শিরোনাম

\ এনামুল হক এনা \
পটুয়াখালী, ২৭ অক্টোবর, ২০২৫ (বাসস) : জেলার বাউফল উপজেলার নুরাইনপুর বাজারে মো. হেমায়েত উদ্দিনের স্টেশনারি দোকানে নিশ্চিন্তে বসে আছে একটি সাদা বক। সকালে সূর্য উঠতে না উঠতেই বাজার জমে ওঠে হকারের হাঁকডাক, দোকানিদের দরদাম আর চায়ের দোকানে গরম ভাপ ওঠা চায়ের কাপ। আর এসব ব্যস্ততার মাঝেই হেমায়েত উদ্দিনের দোকানে বসে থাকা বকটিকে কেউ কৌতুহলী হয়ে দেখছে, কেউ ছবি তুলছে, আবার কেউবা হাসিমুখে বলছে, ওই তো বকের দোকান।
জানা যায়, গত চার মাস ধরে হেমায়েতের দোকানই বকটির ঠিকানা। বাজারের মানুষ এখন তাকে চেনে ‘হেমায়েতের বক’ বা ‘বক ভাই’ নামে। দোকানদারের মতোই নিয়মিত সে দোকানে আসে, নির্দিষ্ট জায়গায় বসে থাকে, মাঝে মধ্যে আবার ক্রেতাদের দিকেও তাকায়। কেউ খাবার দিলে নেয় না, শুধু হেমায়েতের হাতের মাছই খায়, যেন সেই মানুষটাই তার একমাত্র আপন এবং বিশ্বাসের জায়গা।
জানা যায়, এই বন্ধুত্বের সূচনা এক ভয়াবহ ঝড়ের রাতে। স্থানীয়রা বলেন, বাজারসংলগ্ন খানবাড়ির বিশাল রেইনট্রি গাছে বহু বছর ধরে বকের বাসা ছিল। গত বর্ষায় এক রাতে ঝড়ে সেই গাছের ডাল ভেঙে পড়লে নিচে ছিটকে পড়ে একটি ছোট বকছানা। আহত ছানাটিকে দেখে আশেপাশের মানুষ ছুটে আসে, কিন্তু তখনই একটি গুইসাপ সেটিকে আক্রমণ করতে আসে। মুহূর্তেই দৌড়ে গিয়ে দোকানদার মো. হেমায়েত উদ্দিন ছানাটিকে উদ্ধার করেন।
দোকানদার মো. হেমায়েত উদ্দিনের সাথে কথা হলে তিনি বলেন, বাচ্চাটাকে যখন দেখলাম, বুক কেঁপে উঠেছিল। গুইসাপটাও খুব কাছে চলে এসেছিল। ওকে তুলেই দোকানে নিয়ে আসি। তারপর কাপড় গরম করে ক্ষত পরিষ্কার করি, মাছ রান্না করে ঝোলের তরলটা খাওয়াই। কয়েক দিন পর ধীরে ধীরে দাঁড়াতে শুরু করে। এরপর থেকে বকটি আর কোথাও যায়নি। দোকানই হয়ে ওঠে তার নিরাপদ আশ্রয়।
তিনি বলেন, ওকে কখনও বেঁধে রাখিনি। সব সময় দোকানের আশপাশে থাকে। ক্ষুধা পেলে টুপি ধরে টানাটানি করে। তখন বুঝি, মাছ দিতে হবে। ছোট মাছ কিনে ফ্রিজে রাখি ওর জন্য। অসুস্থ হলে নাপা ট্যাবলেট দিই, তাতে ভালো হয়ে যায়।
নুরাইনপুর বাজারের তারকা ‘বক ভাই’ কে না চিনে এমন কেউ নেই। দোকানে বসে থাকা বক দেখতে প্রতিদিনই আসে আশপাশের গ্রামের মানুষ। কেউ ভিডিও করে সোশ্যাল মিডিয়ায় দেয়, কেউ শুধু দেখতে আসে।
স্থানীয় ব্যবসায়ী খলিল মিয়া বলেন, মানুষ আর পাখির এমন বন্ধুত্ব আগে কখনও দেখিনি। প্রতিদিন দেখি ওদের পাশাপাশি বসে থাকতে দেখে মনটা ভালো হয়ে যায়।
বাজারে আসা বিভিন্ন শ্রেণি পেশার লোকজন জানান, বকটি নিয়ম শৃঙ্খলাও শিখে নিয়েছে। দোকানের নির্দিষ্ট জায়গায় বসে, কখনও কিছু নষ্ট করে না, এমনকি মলত্যাগও নির্দিষ্ট স্থানে করে। অনেকেই বলেন এ যেন প্রাণীর শরীরে এক মানবিক আত্মা।
পাশের উপজেলা থেকে কলেজছাত্রী আনাস তাসিয়া মিম বলেন, সোশ্যাল মিডিয়ায় বক পাখিটার ভিডিও দেখে এখানে এসেছি। কাছে গিয়ে দেখলাম, বকটা ভয় পায় না, বরং দোকানদারের সঙ্গে খেলছে। এমন বন্ধুত্ব মানুষকে প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা শেখায়।
৭০ বছর বয়সী স্থানীয় আবদুর রহিম বলেন, এই বয়সে এমন দৃশ্য দেখে মন ভরে যায়। মানুষ যদি এমন করে প্রাণিকুলকে ভালোবাসতে শেখে, তাহলে পৃথিবীটা আরও সুন্দর হবে। হেমায়েতের মতো মানুষরাই প্রকৃত দয়ালু মানুষ।
হেমায়েত উদ্দিন বলেন, এখন বক ছাড়া তার দোকান কল্পনাই করা যায় না। ও সকালে দোকান খোলার সময়ই চলে আসে। বিকেলে আমি দোকান বন্ধ করলে উড়ে গিয়ে গাছের ওপর বসে থাকে, আবার সকালে ফিরে আসে। কখনও মনে হয় ও বুঝতে পারে আমি ওর জন্য অপেক্ষা করছি।
এই বক পাখি আর এক মানুষের গল্প এখন বাজার ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়েছে চারপাশে। অনেকে বলেন, এটি শুধু এক প্রাণ বাঁচানোর ঘটনা নয় এ এক শিক্ষার গল্প, যেখানে ভালোবাসা ও সহমর্মিতাই সবচেয়ে বড় শক্তি।
একটি ঝড়ে আহত ছোট্ট পাখিকে বাঁচিয়ে হেমায়েত উদ্দিন আজ বন্ধুত্বের এক প্রতীক হয়ে উঠেছেন। নুরাইনপুর বাজারের সাদা বকটি এখন কেবল একটি পাখি নয়, মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নেওয়া এক নীরব বার্তাবাহক।