শিরোনাম

চট্টগ্রাম, ২১ ডিসেম্বর, ২০২৫ (বাসস) : নির্বাচন কমিশন গত ১১ ডিসেম্বর ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে নির্বাচনী আনন্দ-উচ্ছ্বাসে ভাসছে চট্টগ্রাম নগরী ও জেলার ১৬ নির্বাচনী আসনের ভোটার ও প্রার্থীরা। সাধারণ মানুষের মাঝে দেখা দিয়েছে অভূতপূর্ব উৎসাহ-উদ্দীপনা।
তফসিল ঘোষণার আগে ও পরে ঢাকা ও চট্টগ্রামে বিএনপি ও ইনকিলাব মঞ্চের দুই প্রার্থীর ওপর সন্ত্রাসীদের গুলি চালানোর ঘটনায় প্রার্থী ও ভোটারদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের দাবি জানিয়েছেন চট্টগ্রামের ভোটাররা।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি) ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, ইসলামী ফ্রন্ট-সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মনোনীত প্রার্থীরা নিজ নিজ এলাকায় ভোটারদের দ্বারে দ্বারে ছুটছেন।
শীত এলেই জনজীবনে এক ধরনের স্থিরতা নামে। ভোরের কুয়াশা, দুপুরের মৃদু রোদ আর সন্ধ্যার ঠান্ডা বাতাস— সবকিছুর সঙ্গে মানিয়ে নিতে মানুষ খোঁজে উষ্ণতা। সেই উষ্ণতার সবচেয়ে সহজ ও পরিচিত উৎস এক কাপ গরম চা। কিন্তু এবারের শীত অন্যরকম। শীতের সঙ্গে এসে জুড়েছে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ফলে ঠান্ডার মধ্যে রাজনীতির উত্তাপ ছড়িয়ে পড়েছে শহর ও গ্রামগঞ্জের প্রতিটি কোণে। আর এই উত্তাপের সবচেয়ে দৃশ্যমান কেন্দ্র হয়ে উঠেছে চায়ের দোকানে গণতন্ত্র নিয়ে নীরব আড্ডা।
চট্টগ্রামের রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে শুরু করে সাধারণ জনগণ— সবার মধ্যে ভোটের উৎসবমুখর মনোভাব তৈরি হয়েছে। চায়ের দোকানের আড্ডায় সবাই ব্যস্ত নির্বাচনী তর্কে।
চট্টগ্রাম নগরীর শুলকবহর, চকবাজার, বহদ্দারহাট, কাজীর দেউড়ি বাজারসহ বিভিন্ন অলিগলি ঘুরে দেখা যায়, চায়ের দোকানগুলোতে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ভিড় লেগে থাকছে। কেউ আসছেন কাজের ফাঁকে, কেউ নির্বাচনী প্রচারের অংশ হিসেবে, কেউবা নিছক সময় কাটাতে। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে আলোচনা হচ্ছে প্রার্থীর যোগ্যতা, এলাকার উন্নয়ন, রাস্তা-ঘাট, স্কুল, হাসপাতাল— সবই। এই আড্ডাগুলোতে বড় বক্তৃতা নেই, নেই মাইকের আওয়াজ; কিন্তু আছে সাধারণ মানুষের সরল প্রশ্ন আর প্রত্যাশা।
এবি পার্টি’র চট্টগ্রাম মহানগরের সদস্য সচিব ছিদ্দিকুর রহমান বলেন, নির্বাচন মানে শুধু ভোটগ্রহণ নয়; নির্বাচন মানে মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক, দায়বদ্ধতা ও আস্থার প্রশ্ন।
চায়ের দোকানে বসে যে সাধারণ মানুষগুলো কথা বলছে, তারা উন্নয়ন চায়, নিরাপত্তা চায়, সম্মান চায়। তারা প্রতিশ্রুতি শুনে অভ্যস্ত, কিন্তু এবার বাস্তবায়ন দেখতে চায়।
জাতীয় নাগরিক পার্টি’র চট্টগ্রাম উত্তর জেলা সমন্বয় কমিটির সদস্য শিক্ষক মোহাম্মদ কাইমুদ্দিন বলেন, রাজনৈতিক নেতাকর্মী থেকে শুরু করে সচেতন নাগরিক সমাজ— সবাই তফসিল ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়ে ভবিষ্যৎ নির্বাচন সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠিত হবে এমন প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছেন।
স্থানীয়রা জানান, তফসিল ঘোষণার মধ্য দিয়ে চট্টগ্রামের ১৬ আসনে নির্বাচনী মাঠ উষ্ণ হতে শুরু করেছে। দলীয় প্রার্থী, জোটের হিসাব, সম্ভাব্য ভোটব্যাংক সব মিলিয়ে দিন যত এগোবে রাজনৈতিক তৎপরতা আরো জোরদার হবে বলেও মন্তব্য করেন ভোটাররা।
চট্টগ্রাম-৯ আসনে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী ও চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি আবু সুফিয়ান বলেন, ভোটার অংশগ্রহণহীন গত তিনটি নির্বাচনে ভোট দিতে না পারা সাধারণ মানুষ এবার স্বাগত জানাচ্ছেন সত্যিকারের ভোট দেওয়ার সুযোগকে।
কোনো ধরনের নিরাপত্তা শঙ্কা নেই জানিয়ে তিনি বলেন, যে সমস্ত ঘটনা ঘটছে, সেগুলোর ব্যাপারে কড়া পদক্ষেপ নিতে হবে; নইলে ভবিষ্যতে সুযোগ সন্ধানী পতিত স্বৈরাচার অরাজকতা সৃষ্টির সুযোগ নেবে। ভোটারদের কাছ থেকে অভূতপূর্ব সাড়া পাচ্ছেন এবং তরুণ ভোটাররা আমাদের দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ৩১ দফার সমর্থনে ধানের শীষের প্রতি ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে ভোটারদের আকৃষ্ট করছেন বলেও জানান তিনি।
তফসিল ঘোষণার অনেক আগে থেকেই রাজনৈতিক দলগুলোর সম্ভাব্য প্রার্থীরা মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন। উঠান বৈঠক, গণসংযোগ, দলীয় কর্মীদের চাঙা করা— সবকিছুতেই এবার তরুণদের অংশগ্রহণ বেশি নজরে পড়ছে। চট্টগ্রামে প্রার্থী হিসেবেও তরুণদের দেখা যাচ্ছে।
চট্টগ্রাম-৭ (রাঙ্গুনিয়া) আসনে ইসলামী ফ্রন্টের প্রার্থী এডভোকেট ইকবাল হাছান বলেন, তফসিল ঘোষণা হওয়ায় আমরা আশাবাদী। অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের ইচ্ছাই প্রতিফলিত হোক, এটাই প্রত্যাশা। নির্বাচন কমিশনকে অবশ্যই সব দলের জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে।
এই দেশের মানুষ বিগত তিনটি নির্বাচনে ভোট দিতে পারেনি উল্লেখ করে জামায়াতে ইসলামী চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আমির ও চট্টগ্রাম-৩ (সন্দ্বীপ) আসনের প্রার্থী আলাউদ্দিন সিকদার বলেন, তরুণ ভোটারদের মাঝে ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনা দেখা দিয়েছে। তফসিল ঘোষণার আগে থেকে প্রার্থীরা মাঠে-ময়দানে গণসংযোগ করছেন। এক্ষেত্রে দু’টি দুঃখজনক ঘটনা ঘটে গেছে। চট্টগ্রাম-৮ আসনে বিএনপি’র প্রার্থী এরশাদ উল্লাহ’র ওপর হামলা হলো। এরপর গত ১২ ডিসেম্বর ঢাকা-৮ আসনে ইনকিলাব মঞ্চের প্রার্থী ওসমান হাদিকে প্রকাশ্যে দিবালোকে গুলি করে হত্যার ঘটনা অত্যন্ত উদ্বেগজনক।
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের মতো পতিত স্বৈরাচার ও সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ভোটারদের সবাইকে সচেতন থাকতে হবে।
সর্বক্ষেত্রে সামাজিকভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে চাঁদাবাজ ও সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে।
ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর উচ্ছ্বসিত যুবক চট্টগ্রাম নগরীর ষোলশহর নাজির পাড়ার বাসিন্দা ইরফানুর রহমান বলেন, ২০১০ সালে ভোটার হলেও সংসদ নির্বাচনে এবারই প্রথম ভোট দেব। ২০১৪ সালের প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন একতরফা নির্বাচনে ইচ্ছে করেই ভোট কেন্দ্রে যাইনি। ২০১৮ সালের নির্বাচনে বেশ আগ্রহ নিয়েই কেন্দ্রে গিয়েছিলাম, কিন্তু পরিস্থিতি বিবেচনায় আর দেওয়া হয়নি। আর ২৪ সালেও তো হলো একতরফা ডামি ভোট।
নগরীর হকার্স মার্কেট-এর কাপড় বিক্রেতা নুর আজাদ (৩৪) বলেন, আমরা এতোদিন ভেবেছিলাম সরকার নির্বাচন দেবে না, কিন্তু তফসিল ঘোষণার মাধ্যমে বুঝতে পারলাম দেশে নির্বাচন হবে। তবে, আমরা চাই হানাহানি মুক্ত একটি স্বচ্ছ নির্বাচন।
পটিয়ার ধলঘাট ক্যাম্প এলাকার নতুন ভোটার ইমাম হোসেন বলেন, আমি চাই আমাদের ভোটের মূল্যায়ন হোক, আমাদের তরুণদের ভোটে দেশের ক্ষমতায় যোগ্য শাসক আসুক। আমরা পরিবর্তন চাই, উন্নয়ন চাই। এবার প্রথমবার ভোট দিতে পারবো— এই ভাবনাই আমাদের সবচেয়ে বেশি উচ্ছ্বসিত করছে।
নগরীর চকবাজার এলাকার পান দোকানি আবদুর রহমান জানান, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণায় আমরা খুশি। কিন্তু আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন জরুরি। সন্ত্রাসীদের হাতে অবৈধ অস্ত্র রয়েছে। এখন এসব অস্ত্র উদ্ধার করতে হবে। যাতে করে ভোটাররা শান্তিপূর্ণ এবং ভয়হীনভাবে ভোট দিতে পারি।