শিরোনাম

\ এনামুল হক এনা \
পটুয়াখালী, ৬ ডিসেম্বর, ২০২৫ (বাসস) : জেলার বাউফল উপজেলায় বন সুন্দরি কুল চাষ করে কৃষিতে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছেন যুব উদ্যোক্তা আবু জাফর (৩৫)। জীবিকার প্রয়োজনে শুরুতে ছোটখাটো ব্যবসা করলেও পরে নিজের আগ্রহ, শ্রম ও নিষ্ঠাকে সঠিক জায়গায় কাজে লাগিয়ে গড়ে তুলেছেন সম্ভাবনাময় কুলচাষের সমন্বিত কৃষি মডেল।
পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার জৌতা গ্রামের দাখিল মাদরাসা শিক্ষক মো. ইসাহাকের মেধাবী পুত্র আবু জাফর মাদরাসা লাইন থেকে এমএ পাস করে বাউফলের কৃষিখাতে একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছেন। এমএ পাস করার পর এ এক অন্যরকম পথচলা বেছে নিয়েছেন তিনি।
সরেজমিনে উপজেলার জৌতা গ্রামে গিয়ে দেখা যায় যুব উদ্যোক্তা আবু জাফর কুল বাগান পরিচর্যা করছেন। এসময় বাসসকে তিনি জানান, কৃষির প্রতি তার আগ্রহ জন্মায় তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে। তিনি বলেন, ইউটিউবে দেশের বিভিন্ন এলাকায় কৃষির উন্নতি দেখে উৎসাহিত হই। ভাবলাম, আমাদের দেশেই তো অনেক সম্ভাবনা। পরে সিদ্ধান্ত নিলাম কুল চাষ করব। সেই সিদ্ধান্তই আজ তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে।
বর্তমানে তিনি কুল চাষের পাশাপাশি ধান, পেয়ারা এবং বিভিন্ন পুষ্টিসমৃদ্ধ মৌসুমি ফল চাষ করছেন। গত বছর কুল বিক্রি করে দেড় লাখ টাকা লাভ করেছেন জাফর। এবার তিনি আশা করছেন, তিন থেকে পাঁচ লাখ টাকার কুল বিক্রি করতে পারবেন। পাইকারি দরে প্রতি কেজি ১২০ টাকা এবং খুচরা দরে ১৫০ টাকা মূল্য পাচ্ছেন তিনি। তার ভাষায়, ‘পরিশ্রম করলে কৃষিতে লাভ হয়—এটা এখন নিজ চোখে দেখছি।’
তিনি জানান, আমার পরিবারে ছয়জন সদস্য। এই কয়েক বছরের কৃষির আয়ের মাধ্যমে পরিবারের জীবনযাত্রায় ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। শুরুতে পরিবারের সবাই, বিশেষত মা তার কৃষিকাজকে খুব একটা ভালোভাবে নেননি। ‘মা আমাকে বলেছিলেন—তোমাকে লেখাপড়া করালাম এই মাইনদারি (চাষাভুষা) কাজ করার জন্য? পরে যখন দেখলেন কৃষিতেই আমার সফলতা, তখন তিনি বলেন—তুমি এগিয়ে যাও, দোয়া করি। এখন সবাই আমাকে সমর্থন করে বলে জানান তিনি।
আবু জাফর জানান, তিনি ৫০ শতাংশ জমিতে বন সুন্দরি জাতের কুল চাষ করছেন। উন্নত জাত, যত্ন ও আধুনিক প্রযুক্তির কারণে ফলনও বেশ ভালো হচ্ছে। তিনি স্মলহোল্ডার এগ্রিকালচারাল কম্পিটিটিভনেস প্রজেক্ট—এসএসিপি (SSACP-RAINS) এর আওতায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ, পরামর্শ ও সহায়তা পেয়েছেন বলেও জানান।
জাফরের দাবি, কৃষি অফিসের নির্দেশনা অনুযায়ী তিনি বাগান পরিচর্যা, সার ব্যবস্থাপনা ও রোগবালাই দমন এবং বাজারসংযোগ বিষয়ে আধুনিক জ্ঞান লাভ করেছেন। এতে তার ফসলের উৎপাদন বেড়েছে এবং বাজারজাতকরণ সহজ হয়েছে।
জৌতা গ্রামে গিয়ে জানা যায়, স্থানীয় মানুষজন জাফরের কৃষি উদ্যোগকে অত্যন্ত ইতিবাচকভাবে দেখছেন। তারা মনে করেন, তার সাফল্য দেখে এলাকার আরো অনেক তরুণ কৃষির প্রতি আগ্রহী হচ্ছেন।
স্থানীয় কৃষক রিপন হাওলাদার বলেন, জাফর ভাইকে আমরা নিয়মিত দেখি বাগানে কাজ করতে। তিনি পরিশ্রমী মানুষ। এখন তার বাগান দেখে মনে হয় মন দিয়ে কেউ কিছু চেষ্টা করলে কৃষিতে অনেক কিছুই করা সম্ভব। আরেক কৃষক শাহে আলম বলেন, আগে আমাদের গ্রামে কুলের বাগান তেমন ছিল না। এখন জাফরের সফলতা দেখে অনেকে কুলের চাষ করার কথা ভাবছে। স্থানীয় দোকানদার রাসেল জানান, জাফর ভাইয়ের কুল এলাকার বাইরে থেকে লোক এসে কিনে নিয়ে যায়। এতে আমাদের বাজারও চাঙ্গা হয়।
স্কুল শিক্ষক মহিউদ্দীন তালুকদার বলেন, ‘জাফরের মতো একজন শিক্ষিত যুবক কৃষিকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়ে সফল হওয়ায় আমরা গর্বিত। শ্রম ও নিষ্ঠাকে কাজে লাগিয়ে কৃষিখাতে একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে সফল যুব উদ্যোক্তা হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছেন তিনি।
বাউফল উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. মিলন বলেন, ‘জৌতা গ্রামের তরুণ উদ্যোক্তা আবু জাফর আধুনিক কৃষির একটি সফল উদাহরণ। আমরা নিয়মিত তাকে কারিগরি সহায়তা, প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ দিয়ে থাকি। বন সুন্দরি জাতের কুল অত্যন্ত সম্ভাবনাময়। সঠিক পরিচর্যা করলে প্রতি বছরই যে ভালো ফলন পাওয়া যায়, তা সেই কাজটাই জাফর করে দেখিয়েছেন।’
তিনি বলেন, বাউফলে কুল চাষের সম্ভাবনা দিনদিন বাড়ছে। আমরা চাই এ ধরনের উদ্যোগ আগামী দিনে আরো তরুণদের কৃষিতে যুক্ত করুক।
জাফর জানান, তার লক্ষ্য বাণিজ্যিকভাবে আরও বড় পরিসরে কুল চাষ করা। পাশাপাশি স্থানীয় তরুণদের প্রশিক্ষণ দিয়ে কৃষিতে উদ্বুদ্ধ করা। তিনি আশা করেন, সরকারি সহায়তা ও প্রযুক্তির সহজলভ্যতা থাকলে এ অঞ্চলের কৃষিচিত্র আরও বদলে যাবে।
তার ভাষায়, ‘আমি শুধু নিজের উন্নতি চাই না। চাই গ্রামের মানুষ কৃষিকে গুরুত্ব দিক। কৃষিই আমাদের শক্তি। আমি চাই একদিন জৌতা গ্রাম হবে কুল চাষের জন্য পরিচিত একটি মডেল এলাকা।’
শ্রম, চেষ্টা এবং দৃঢ় মনোভাব থাকলে কৃষিতে সফলতা অর্জন সম্ভব—এ কথার বাস্তব প্রমাণ উপস্থাপন করে যেন সামনে এগিয়ে চলেছেন বাউফলের এই তরুণ উদ্যোক্তা আবু জাফর।