শিরোনাম

ঢাকা, ৪ ডিসেম্বর, ২০২৫ (বাসস) : মঙ্গলবার বিকেলে ফরিদপুরের সদরপুর থানার খলাসিডাঙ্গি বাবুরচরে একটি মোটা স্টিলের দরজায় তালাবদ্ধ ঘরে সাড়ে তিন বছর ও দেড় বছরের দুই শিশু আটকে পড়লে তাদের অভিভাবকের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
অভেদ্য দরজার পেছনে আটকে পড়া শিশুদের অসহায় কান্না দেখে দেশের জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এ নম্বরে একটি কল আসে।
কয়েক মিনিটের মধ্যেই কল রিসিভার কনস্টেবল আবু জিহাদ সরকার সদরপুর ফায়ার সার্ভিস স্টেশনকে সতর্ক করেন। ফায়ারফাইটার মেহেদী হাসান দ্রুত একটি উদ্ধার দল সমন্বয় করেন, যারা জানালা ভেঙে ভীত দুই শিশুকে নিরাপদে বের করে আনে।
এসময় শিশুদের কোনো আঘাত লাগেনি, এটি জরুরি সেবাটির দ্রুততা ও সমন্বয়েরই প্রমাণ।
একই দিন বিকেলে ফরিদপুর জেলায় ঢাকা-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়েতে আড়িয়াল খাঁ সেতুর কাছে ঢাকা-গামি একটি যাত্রীবাহী বাসের সাথে একটি ট্রাকের ভয়াবহ সংঘর্ষ ঘটে।
সংঘর্ষে বাসটির সামনের অংশ দুমড়ে-মুচড়ে যায় এবং যাত্রীরা ভেতরে আটকা পড়ে। এক প্রত্যক্ষদর্শী ৯৯৯ নম্বরে ফোন করেন এবং কনস্টেবল আবদুল্লাহ আল মামুন সঙ্গে সঙ্গে ভাঙ্গা ফায়ার সার্ভিস ও হাইওয়ে পুলিশকে সক্রিয় করেন।
ফায়ার ডিসপ্যাচার মেহেদী হাসানের নির্দেশনায় উদ্ধারকারীরা ভাঙা-চূর্ণবিচূর্ণ ধ্বংসস্তূপ থেকে ৯ জন আহত যাত্রীকে বের করে আনে। তাদের ফরিদপুর জেলা হাসপাতালে পাঠানো হয়। তবে, ঘটনাস্থলেই তিনজন মারা যায়।
এই ঘটনাগুলোই প্রমাণ করে যে, ৯৯৯-বাংলাদেশের টোল-ফ্রি, সার্বক্ষণিক জরুরি হেল্পলাইন-ভয়, বিপদ ও অনিশ্চয়তার মুহূর্তে মানুষের জন্য অপরিহার্য জীবনরেখায় পরিণত হয়েছে।
২০১৭ সালে চালু হওয়া ৯৯৯ সেবা যেকোনো ফোন থেকে পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস এবং অ্যাম্বুলেন্সের সাথে সংযোগ ঘটায়। চালুর পর থেকে এ বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৬ কোটি ৬০ লাখের বেশি কল এসেছে, যার মধ্যে ২ কোটি ৯০ লাখের বেশি-প্রায় ৪৪ শতাংশ সরাসরি জরুরি সহায়তায় রূপ নিয়েছে।
শিশু উদ্ধারে থেকে শুরু করে বিপন্ন মানুষকে সহায়তা দেওয়া পর্যন্ত এই সেবা নীরবে নাগরিক জীবনের অংশ হয়ে উঠেছে।
গত বছর যশোরের রূপদিয়া রেলস্টেশনে এক গর্ভবতী নারী ৯৯৯-এ কল করার পর তাৎক্ষণিক চিকিৎসা সহায়তা পেয়েছিলেন। ঢাকায় রিনা বেগম নামে এক নারী অল্পের জন্য বিপদ থেকে রক্ষা পান; মধ্যরাতে তার বাসায় ঢুকে পড়া দু’জন পরিচিত ব্যক্তি মাদক গ্রহণ ও ছুরি প্রদর্শন শুরু করে। আতঙ্কিত হয়ে রিনা ৯৯৯-এ ফোন করলে পুলিশ দ্রুত পৌঁছে যায়, অনুপ্রবেশকারীরা পালিয়ে যায়।
রিনা বলেন, ‘৯৯৯ সম্পর্কে শুনে ভেবেছিলাম হয়ত কোনোদিন কাজে লাগতে পারে। সেদিন রাতে এটি আমাকে বাঁচিয়েছে।’
তবে দ্রুত বাড়তে থাকা নির্ভরশীলতা নতুন চ্যালেঞ্জও এনেছে।
প্রতিদিন হেল্পলাইনে প্রায় ২৪ হাজার কল আসে, অথচ এখানে মাত্র ৮০ জন কল রিসিভার ও ২০ জন ডিসপ্যাচার কাজ করেন। উদ্বেগজনক বিষয় হচ্ছে, ৫৬ শতাংশ কল অপ্রয়োজনীয় বা মজা করার জন্য করা হয়, যা লাইন ব্যস্ত রাখে এবং প্রকৃত জরুরি সেবায় বিলম্ব ঘটায়।
৯৯৯ সেবার প্রধান ও অতিরিক্ত ডিআইজি মহিউল ইসলাম বাসসকে বলেন, ‘এই অপ্রয়োজনীয় কলগুলো শুধু আমাদের কল রিসিভারদের মানসিকভাবে ক্লান্ত করে না, বরং প্রকৃত জরুরি সেবায় বিলম্ব ঘটায়-যা জীবনহানিকর হতে পারে।’
তিনি বলেন, ৯৯৯ বাংলাদেশ পুলিশের সবচেয়ে জনপ্রিয় সেবা এবং দ্রুত সেবা নিশ্চিত করার কারণে এর জনপ্রিয়তা দিন দিন বাড়ছে।
তিনি আরও বলেন, ‘৯৯৯-এর প্রতিটি কর্মকর্তা আন্তরিক ও প্রতিশ্রুতিবদ্ধভাবে দ্রুত সেবা প্রদান করছেন।
গড়ে ৩৫-৪০ মিনিটের মধ্যে কলাররা সেবা পান বলে তিনি জানান।
৯৯৯ প্রধান বলেন, তাদের কাছে মাত্র ১০০টি কল স্টেশন রয়েছে, যেখানে মাত্র ৮০ জন কল রিসিভারকে প্রতিদিন ২৪ হাজার থেকে ২৫ হাজার কল রিসিভ করতে হয়। এটা মানবিকভাবে অসম্ভব।
সেবা সম্প্রসারণের জন্য সরকারকে দুটি প্রকল্প জমা দেওয়া হয়েছে-একটি বিদ্যমান ১০০ কল স্টেশন উন্নয়নে ৫৯ কোটি টাকা ব্যয়ে এবং আরেকটি নতুন ১০০ কল স্টেশন স্থাপনে ৫৫২ কোটি টাকা ব্যয়ে।
এ সমস্যা মোকাবিলায় কর্তৃপক্ষ গণমাধ্যম, কমিউনিটি পুলিশিং, স্কুল, মসজিদ ও পাড়া-মহল্লায় সচেতনতা কার্যক্রম চালাচ্ছে। পাশাপাশি তরুণ ও প্রশিক্ষিত জনবল নিয়োগের কাজ চলছে।
হটলাইনের গুরুত্ব বিবেচনায় সরকার বৃহৎ সম্প্রসারণ পরিকল্পনা নিয়েছে। পূর্বাচলে ১০০টি নতুন ওয়ার্কস্টেশন এবং ডেমরা থানার আওতাধীন আমুলিয়ায় ৫০০-ওয়ার্কস্টেশনের একটি বড় কেন্দ্র স্থাপনের প্রস্তাব রয়েছে-৫৫২ কোটি টাকার প্রকল্প। এই প্রকল্পের লক্ষ্য হলো সেবার গতি, নির্ভুলতা এবং নির্ভরযোগ্যতা বাড়ানো।
মহিউল ইসলাম বলেন, প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হলে আমরা জনগণকে আরো দ্রুত এবং নিরাপদ সেবা দিতে পারব।
মাত্র ৮০টি ইনকামিং লাইন থাকায় অপ্রয়োজনীয় কল প্রতিদিন জট তৈরি করছে। প্রকৃত বিপদে পড়া মানুষ অনেক সময় দেরিতে সেবা পাচ্ছে, কারণ লাইনগুলো ব্যস্ত থাকে।
শিশু উদ্ধারে থেকে শুরু করে দুর্ঘটনায় আটকে পড়া মানুষকে বাঁচানো পর্যন্ত, ৯৯৯ বারবার প্রমাণ করছে যে এটি সংকট মুহূর্তে প্রথম যোগাযোগের জায়গা। তবে এর কার্যকারিতা নির্ভর করছে শুধু অবকাঠামোর ওপর নয়, জনগণের দায়িত্বশীল ব্যবহারের ওপরও।
প্রকৃত জরুরি ঘটনার সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সচেতনতা, সম্প্রসারণ ও দক্ষতার প্রয়োজনও বাড়ছে। বাংলাদেশের ৯৯৯ শুধু একটি হেল্পলাইন নয়-এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ জনসেবা, যা কোটি মানুষের আস্থা অর্জন করেছে। অব্যাহত বিনিয়োগ ও সহযোগিতার মাধ্যমে আগামী দিনে আরও অনেক জীবন বাঁচাতে সক্ষম হবে পরিষেবাটি।