বাসস
  ০৯ নভেম্বর ২০২৫, ১৩:২৫

দেশে নারীদের মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতা দিন দিন বাড়ছে 

প্রতীকী ছবি

ঢাকা, ৯ নভেম্বর, ২০২৫ (বাসস) : যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য এবং অধিকার (এসআরএইচআর) হচ্ছে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যা মানবাধিকার, স্বাস্থ্যের উন্নয়ন ও সামাজিক ন্যায়ের সাথে সম্পর্কিত। এটি মানুষের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিভিন্ন দিকগুলো নিয়ে আলোচনা করে। এর মাঝে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির ব্যবহার, যৌন রোগের প্রতিরোধ এবং যৌন শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করা অন্যতম। 

সরকারের জনকল্যাণমুখী উদ্যোগের ফলে বাংলাদেশে নারীদের মধ্যে প্রজনন স্বাস্থ্য সচেতনতা দিন দিন বাড়ছে। ফলে নারী ও শিশু স্বাস্থ্যগত বিষয়ে বেশ সাফল্য পেয়েছে বাংলাদেশ। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে আরও বেশি কাজ করার জায়গা রয়েছে। 

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শহরাঞ্চলের পাশাপাশি গ্রামাঞ্চলেও এখন অনেক নারী নিয়মিত স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যাচ্ছেন, পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি ব্যবহার করছেন এবং মাসিক স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলছেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে স্বাস্থ্যসেবা সম্প্রসারণ, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারণা এবং নারীদের শিক্ষার হার বৃদ্ধির ফলে এ পরিবর্তন এসেছে। আগে যেখানে প্রজনন স্বাস্থ্য নিয়ে খোলামেলা আলোচনা ছিল না, এখন তরুণ প্রজন্ম থেকে শুরু করে গৃহিণীরা পর্যন্ত বিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। 

পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের তথ্য মতে, গ্রামীণ নারীদের মধ্যে গর্ভনিরোধক ব্যবহারের হার উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। বিশেষ করে কিশোরী ও  তরুণীদের মধ্যে মাসিক স্বাস্থ্য সেবায় স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহারের প্রবণতাও আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। তবে এখনও অনেক নারী দারিদ্র্য, কুসংস্কার এবং পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবার অভাবে প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ে প্রয়োজনীয় সেবা পাচ্ছেন না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। 

প্রজনন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের নারীরা নিজের অধিকার বিষয়ে সচেতন হচ্ছেন। ফলে সবক্ষেত্রেই নজর কাড়া সফলতা এসেছে। যার ছোঁয়া লেগেছে স্বাস্থ্য তথা প্রজনন খাতেও। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ও সরকারের নেওয়া উদ্যোগগুলো সফল হয়েছে মূলত নাগরিকদের সচেতনতার কারণে।

বিশেষ করে এতে নারীর ভূমিকা প্রশংসনীয়। কারণ তারা সনাতন পদ্ধতিতে চিকিৎসা না করে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে শিখেছেন। 

সূত্র বলেছে, জনবহুল দেশ হওয়া সত্ত্বেও জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য সাফল্য আছে। একজন মা এখন গড়ে দুটি সন্তানের জন্ম দেন। পাঁচ দশক আগের মায়েরা গড়ে ছয়টি সন্তানের জন্ম দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে। সন্তান জন্ম দেওয়ার হার কমে যাওয়ায় প্রজনন স্বাস্থ্যে সুফল পাচ্ছে বাংলাদেশ।

জানা যায়, স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে দেশের প্রধান সমস্যা ছিল জনসংখ্যা ও দারিদ্র্য। বাংলাদেশ এ দুটি ক্ষেত্রেই সাফল্য দেখিয়েছে। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে সাফল্য এসেছে মূলত মোট প্রজনন হার বা টোটাল ফার্টিলিটি রেট (টিএফআর) কমাতে পারার কারণে। ফলে নারী শিক্ষার সুযোগ বেশি পাচ্ছে, উপার্জনে বেশি সময় দিতে পারছে।

জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলছেন, প্রজননক্ষম নারীর সারাজীবনে (সাধারণত ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়স পর্যন্ত) সন্তান জন্ম দেওয়ার সংখ্যা-ই টিএফআর। যেসব দেশ জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ বা জনসংখ্যা কমাতে চায়, তাদের অন্যতম লক্ষ্য থাকে টিএফআর কমিয়ে আনা। স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশ ক্রমাগতভাবে টিএফআর কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। 

বিশ্ব ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে টিএফআর ছিল ৬ দশমিক ৯। অর্থাৎ ওই সময় বাংলাদেশের একজন মা গড়ে প্রায় সাতটি সন্তানের জন্ম দিতেন। ১৯৮১ সালে টিএফআর কমে দাঁড়ায় ৬ দশমিক ২-এ। এরপর তা আরও কমতে থাকে। বিশ্ব ব্যাংকের পরিসংখ্যান বলছে, বর্তমানে টিএফআর ২। যদিও সর্বশেষ বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্যজরিপ বলছে, টিএফআর এখন ২ দশমিক ৩।

১৯৭৩-১৯৭৮ সালে দেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। এতে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি বেশ গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়। ১৯৭৬ সালে দেশে প্রথম জনসংখ্যা নীতি প্রণয়ন করা হয়। 

এরপর সবকটি পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় জনসংখ্যাকে বিশেষ গুরুত্ব দেয় সরকার। মা ও শিশুর স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা ডা. নাজনীন আক্তার বলেন, স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টিখাত কর্মসূচির ওপরও বেশ জোর দেওয়া হয়েছে। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে জনসংখ্যা নীতি একাধিক বার হালনাগাদ করা হয়েছে। এতে মানুষ সচেতন হয়েছে।

পাশাপাশি প্রজনন স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটেছে। 

সূত্র জানায়, দেশে জন্মনিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মাঠ কর্মী। তাদের নিরলস কাজ ছাড়াও গণমাধ্যম জন্মনিয়ন্ত্রণ বিষয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে। এর সঙ্গে সারাদেশে যুক্ত ছিল ছোট-বড় বহু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বা এনজিও। ছোট পরিবার, সুখী পরিবার-এই প্রচারণা ব্যাপকভাবে চলেছিল। ছেলে হোক মেয়ে হোক, দু’টি সন্তাই যথেষ্ট-এই স্লোগানও ব্যাপক জনপ্রিয় হয়েছিল। স্বাধীনতার সময় সক্ষম দম্পতিদের ৮ শতাংশ জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করত, এখন সেই হার বেড়ে ৬২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম বলেন, ‘নারী শিক্ষা ও নারীর ক্ষমতায়ন কম সন্তান নেওয়ার পক্ষে কাজ করেছে। মানুষ অর্থনৈতিক অগ্রগতির কথা ভেবে পরিবার ছোট করেছে। ’

পাকিস্তানের সঙ্গে তুলনা করলে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বিশ্ব ব্যাংক বলছে, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের টিএফআর ছিল ৬ দশমিক ৬। অর্থাৎ বাংলাদেশের চেয়ে পাকিস্তানের টিএফআর কম ছিল। বর্তমানে পাকিস্তানের টিএফআর ৩ দশমিক ৫। অর্থাৎ বাংলাদেশের চেয়ে বেশি।

শুধু অর্থনীতি নয়, টিএফআর নারীর স্বাস্থ্যে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। নারী স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক রওশান আরা বেগম এই প্রতিবেদকে বলেন, ‘সন্তান কম হওয়ায় নারী কাজের সুযোগ বেশি পাচ্ছে, শিক্ষার সুযোগ বেশি পাচ্ছে। বারবার সন্তান ধারণ, সন্তান জন্মদান ও সন্তান প্রতিপালনের যে স্বাস্থ্যঝুঁকি, তা আগের চেয়ে কমেছে। টিএফআর কমে যাওয়ার কল্যাণমূলক সুবিধা বাংলাদেশের নারীরা ভোগ করতে পারছে।’

তবে বাংলাদেশের সব এলাকায় টিএফআর সমান নয় বা সমানভাবে কমেনি। সিলেট, চট্টগ্রাম ও ময়মনসিংহ বিভাগে টিএফআর বেশি।

সরকারি হিসাব বলছে, দেশের জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি। টিএফআরআরও কমানো সম্ভব হলে দেশের ওপর জনসংখ্যার চাপ বাড়বে না। বাংলাদেশে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হয়ে ছিল মূলত টিএফআর কমানোর মাধ্যমে। কিন্তু গত একদশকে সেই অগ্রগতি কিছুটা থেমে আছে। ২০১১ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত টিএফআর কমছে না বা খুব সামান্য কমছে। এ বিষয়ে অধ্যাপক রওশান আরা বেগম বলেন, ‘দেশে বাল্যবিবাহ অনেক বেশি। আবার কমবয়সী নারীদের মধ্যে টিএফআর বেশি।’ 

‘জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের বর্তমান সমস্যাগুলো সকলের জানা। পিছিয়ে পড়া এলাকা বা বিশেষজনগোষ্ঠী ভিত্তিক জন্মনিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি নিতে হবে। জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীর অপূর্ণ চাহিদা দূর করতে হবে,’ যোগ করেন অধ্যাপক মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম।