বাসস
  ১০ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৩:০৬

দেশে মানসিক চিকিৎসা গবেষণায় পর্যাপ্ত বাজেটের ঘাটতি রয়েছে: ডা. নূর আহমেদ

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মানসিক রোগ বিভাগের চেয়ারম্যান ও সহযোগী অধ্যাপক ডা. নূর আহমেদ গিয়াসউদ্দিন। ছবি: বাসস

\ বরুন কুমার দাশ \

ঢাকা, ১০ ডিসেম্বর, ২০২৫ (বাসস) : দেশের স্বাস্থ্য খাতেই যেখানে সামগ্রিক বাজেট অপ্রতুল, সেখানে মানসিক রোগ বিষয়ক গবেষণার জন্য বরাদ্দ একেবারেই কম। পর্যাপ্ত বাজেট ও গবেষণা কর্মকর্তার অভাবে এই খাতের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের মানসিক রোগ বিভাগের চেয়ারম্যান ও সহযোগী অধ্যাপক ডা. নূর আহমেদ গিয়াসউদ্দিন বাসসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন।

মানসিক রোগ বিষয়ে গবেষণার বাজেট ও সরকারি বরাদ্দ পর্যাপ্ত কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে ডা. নূর আহমেদ বলেন, ‘আমাদের স্বাস্থ্য খাতে সামগ্রিক চিকিৎসার জন্যই বাজেট পর্যাপ্ত নয়। সেই প্রেক্ষাপটে গবেষণার ক্ষেত্রে আসলে এই বাজেট অনেক কম। এছাড়া মানসিক রোগের কারণ উদঘাটন ও প্রতিকারের জন্য যে ধরনের গবেষণা প্রয়োজন, তার জন্য পর্যাপ্ত গবেষণা কর্মকর্তাও নেই। তাই এই খাতের উন্নয়নের জন্য পর্যাপ্ত বাজেটের পাশাপাশি গবেষণা কর্মকর্তার পদ সৃষ্টি ও নিয়োগ অত্যন্ত জরুরি।’

দেশে মানসিক রোগীর সংখ্যা বাড়ছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বর্তমানে মানসিক রোগীর সংখ্যা বেশি দেখা যাচ্ছে। এর পেছনে বহুমুখী কারণ রয়েছে। প্রথমত, বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে প্রচার-প্রচারণা চালানোর ফলে মানুষের মধ্যে সচেতনতা আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। মানুষ এখন বুঝতে শিখছে যে মনেরও অসুখ হতে পারে এবং তার জন্য চিকিৎসকের কাছে যাওয়া প্রয়োজন। এই সচেতনতার কারণেই মানুষ এখন আগের চেয়ে বেশি সংখ্যায় চিকিৎসকের শরণাপন্ন হচ্ছেন। দ্বিতীয়ত, বর্তমান সমাজ ব্যবস্থার জটিলতা ও পারিপার্শ্বিক নানা কারণে মানুষ তীব্র মানসিক চাপের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এই সামাজিক ও ব্যক্তিগত চাপগুলো থেকেই মানসিক রোগের উৎপত্তি হচ্ছে। এছাড়া দেশে ধীরগতিতে হলেও মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের সংখ্যা ও চিকিৎসা কেন্দ্রের সংখ্যা কিছুটা বেড়েছে, ফলে মানুষ এখন হাতের কাছে চিকিৎসক পাওয়ায় সেবা নিতে আসছেন। এসব মিলিয়েই বর্তমানে মানসিক রোগীর সংখ্যা বা হাসপাতালের বহির্বিভাগে রোগীর ভিড় আগের তুলনায় বেশি মনে হচ্ছে।’

বাংলাদেশে কি পরিমাণ মানুষ মানসিক রোগে ভুগছেন, এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাম্প্রতিক এপিডেমিওলজিক্যাল সার্ভের তথ্য তুলে ধরেন ডা. নূর আহমেদ গিয়াসউদ্দিন। 

তিনি বলেন, ‘এ পর্যন্ত দেশে দুটি এপিডেমিওলজিক্যাল সার্ভে হয়েছে। সর্বশেষ জরিপের তথ্যানুযায়ী, বিগত এক বছরে মানসিক রোগে ভুগেছেন এমন মানুষের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৪ থেকে ১৮ শতাংশ। অর্থাৎ প্রতি ১০০ জন মানুষের মধ্যে ১৪ থেকে ১৮ জন কোনো না কোনো মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত। এর মধ্যে ২ থেকে ৪ শতাংশ মানুষ গুরুতর বা তীব্র মানসিক রোগে ভুগছেন। আর ১২ থেকে ১৪ শতাংশ মানুষ ভুগছেন মৃদু মানসিক রোগ বা ‘নিউরোটিক ডিজিজ’-এ, যার মধ্যে উদ্বেগ ও বিষণ্নতা অন্যতম।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘এই পরিসংখ্যান বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। বিশ্বজুড়েও তীব্র মানসিক রোগীর হার ১ থেকে ৪ শতাংশ এবং মৃদু মানসিক রোগীর হার ১০ থেকে ১২ শতাংশের মধ্যেই থাকে।’


মানসিক রোগের চিকিৎসায় দেশে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও হাসপাতালের সংখ্যা পর্যাপ্ত কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে ডা. নূর আহমেদ বলেন, ‘বর্তমানে মানসিক রোগের চিকিৎসক এবং চিকিৎসা কেন্দ্রের সংখ্যা আগের চেয়ে বেড়েছে, কিন্তু তা এখনো পর্যাপ্ত নয়। সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো দেশের মানসিক রোগীর তুলনায় চিকিৎসকের সংখ্যা কম, আর যারা আছেন তাদের বেশিরভাগই ঢাকাকেন্দ্রিক। ফলে ঢাকার বাইরে থেকে একজন রোগীকে চিকিৎসা নিতে ঢাকায় আসতে হলে তাকে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হয়। এটি তাদের জন্য শারীরিক ও মানসিকভাবে যেমন কষ্টসাধ্য, তেমনি আর্থিক অপচয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সময় এবং অর্থের এই অপচয়ের কারণে অনেকেই মাঝপথে চিকিৎসা বন্ধ করে দেন। তাই মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হলে শুধু মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের সংখ্যা বাড়ালেই হবে না, বরং এর সাথে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য পেশাজীবী যেমন ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট এবং সাইকিয়াট্রিক নার্সের সংখ্যাও বাড়াতে হবে। সেই সাথে সবচেয়ে জরুরি বিষয় হলো, এই বিশেষজ্ঞদের ঢাকা শহরের বাইরে জেলা শহরগুলোতেও পদায়ন করতে হবে, যেন এই সেবা সম্প্রসারণ ও বিকেন্দ্রীকরণ করা যায়।’

দেশে বিশেষায়িত হাসপাতালের প্রয়োজন সম্পর্কে জানতে চাইলে এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বলেন, ‘বর্তমানে আমাদের দেশে দুটি পূর্ণাঙ্গ মানসিক হাসপাতাল রয়েছে। একটি পাবনা মানসিক হাসপাতাল এবং অন্যটি ঢাকার শেরেবাংলা নগরে অবস্থিত জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল। এর বাইরে সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোতে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ কর্মরত আছেন। কিন্তু সমস্যা হলো জেলা পর্যায়ে। যেসব জেলায় মেডিকেল কলেজ নেই, সেই জেলা শহরগুলোতে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের কোনো পদই নেই। ফলে সেখানকার মানুষ এসব সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।’ 

এই সংকট নিরসনে তিনি জেলা হাসপাতালগুলোতে মানসিক রোগের জুনিয়র এবং সিনিয়র কনসালট্যান্ট পদ সৃষ্টি করার পরামর্শ দেন, যাতে তৃণমূল পর্যায়ের মানুষেরা নিজ জেলাতেই সেবা পেতে পারেন।

মানসিক রোগের চিকিৎসার ধরন এবং চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢামেকের এই চিকিৎসক বলেন, ‘মানসিক রোগের চিকিৎসা পদ্ধতি অন্যান্য সাধারণ রোগের চেয়ে কিছুটা ভিন্ন। কারণ এই রোগ নির্ণয়ের জন্য নির্দিষ্ট কোনো রক্ত পরীক্ষা, সিটি স্ক্যান কিংবা এমআরআই-এর মতো দৃশ্যমান পরীক্ষা নেই, যা দেখে নিশ্চিত হওয়া যায় রোগী কোন রোগে ভুগছেন। এখানে রোগ নির্ণয় সম্পূর্ণ নির্ভর করে চিকিৎসকের পর্যবেক্ষণ ক্ষমতার ওপর। চিকিৎসককে সরাসরি রোগী দেখে, কথা বলে এবং আচরণ বিশ্লেষণ করে রোগ নির্ণয় করতে হয়। 

তাই এই বিষয়ে বিশেষজ্ঞ শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে থেকে প্রশিক্ষণ নেয়া ছাড়া একজন চিকিৎসকের অন্য কোনো বিকল্প নেই।’

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে বর্তমানে যেসব ইনস্টিটিউট ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র রয়েছে তা মানসিক রোগের চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণের জন্য মোটামুটি যথেষ্ট। তবে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে বা উচ্চতর গবেষণার জন্য বিদেশে প্রশিক্ষণের প্রয়োজন।’

মানসিক রোগ থেকে দূরে থাকার উপায় এবং সুস্থ থাকার পরামর্শ দিয়ে ডা. নূর আহমেদ বলেন, ‘ভালো থাকতে হলে সামাজিকভাবে এবং ব্যক্তিগতভাবে কিছু নিয়ম মেনে চলতে হবে। মানসিকভাবে সুস্থ থাকার প্রধান শর্ত হলো সুন্দর চিন্তা করা, ভালো খাবার খাওয়া, ভালো মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করা এবং ভালো উপদেশ গ্রহণ করা।’ 
এছাড়া মনের খোরাক যোগাতে সুন্দর ও রুচিশীল বই পড়া, ভালো চলচ্চিত্র দেখা এবং একটি সুন্দর সুশৃঙ্খল জীবনযাপন করা জরুরি বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

মাদক ও নেশাজাতীয় দ্রব্যকে মানসিক রোগের অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করে তিনি বলেন, ‘কেউ যদি মানসিক রোগ থেকে দূরে থাকতে চায়, তবে তাকে অবশ্যই মদ্যপান, ধূমপান ও যে কোনো ধরনের নেশাজাতীয় দ্রব্য পরিহার করতে হবে। অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন ও খাদ্যাভ্যাস পরিত্যাগ করতে হবে।’ 

এ সময় রোগ শনাক্তকরণ ও দ্রুত চিকিৎসার গুরুত্ব তুলে ধরে ডা. নূর আহমেদ বলেন, ‘অনেক সময় আমরা বুঝতে পারি না যে আমরা বা আমাদের প্রিয়জন মানসিক রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। কারো স্বাভাবিক আচরণের মধ্যে যদি হঠাৎ কোনো অসংগতি দেখা দেয়, তবে দেরি না করে দ্রুত বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া উচিত। কারণ মানসিক রোগের ক্ষেত্রে একটি বিষয় প্রমাণিত- যেই রোগীর চিকিৎসা যত দ্রুত শুরু করা হয়, তার সেরে ওঠার বা স্বাভাবিক জীবনে ফেরার সম্ভাবনা তত বেশি থাকে।’ তাই এমন কোনো লক্ষণ দেখা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কুসংস্কার বা ঝাড়ফুঁকের পেছনে না দৌড়ে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।