শিরোনাম

\ বরুন কুমার দাশ \
ঢাকা, ৩ ডিসেম্বর, ২০২৫ (বাসস) : শীতকালে শিশুদের ডায়রিয়ার প্রকোপ বাড়ে। এ সময় বিভিন্ন ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ বেশি হওয়ায় বাইরের খাবার থেকে তাদের দূরে রাখাই সবচেয়ে জরুরি। এসব খাবারে জীবাণুর ঝুঁকি থাকে, যা শিশুদের দ্রুত অসুস্থ করে। তাই বাড়িতে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নভাবে রান্না করা খাবারই শিশুদের জন্য নিরাপদ, বললেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের শিশু বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. আব্দুল কাদের।
বাসসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, শীতকালে শিশুদের ডায়রিয়া থেকে রক্ষা করতে চাইলে বাড়িতে তৈরি নরম ও সহজে হজমযোগ্য খাবার যেমন—ভাত, কলা, আপেল (চামড়া ছাড়া), ওটস এসবই শিশুদের জন্য ভালো। সব খাবার ভালোভাবে রান্না করা এবং খাওয়ার উপযোগী তাপমাত্রায় আছে কি না, তা খেয়াল রাখতে হবে। পাশাপাশি শিশুদের ও তাদের যত্ন নেওয়া ব্যক্তিদের নিয়ম করে হাত ধোয়ার অভ্যাস করানো জরুরি।
শীতকালে রোগের প্রাদুর্ভাব বাড়ে কি-না, এমন প্রশ্নের জবাবে ডা. আব্দুল কাদের বলেন, ‘শীতকালেই যে সব রোগ হঠাৎ বেড়ে যায়, বিষয়টা এমন নয়। মূলত শীতের শুরুতে এবং শীতের শেষে আবহাওয়া পরিবর্তনের সময়টিতে শিশুদের অসুস্থতা বেড়ে যায়। এ সময় ‘অ্যাকিউট ব্রঙ্কাইটিস’ নামক রোগের প্রকোপ দেখা দেয়। এটি একটি ভাইরাল ডিজিজ, যা দেখতে অনেকটা নিউমোনিয়ার মতো মনে হলেও এটি মূলত ব্রঙ্কিওলাইটিস। এতে শিশুদের তীব্র শ্বাসকষ্ট হয়, অনেক সময় অক্সিজেন দিতে হয়, নেবুলাইজ করতে হয় এবং শিশু খেতে না পারলে স্যালাইন বা ফ্লুইড দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে। এছাড়া যাদের ‘কোল্ড সেনসিটিভিটি’ বা ঠান্ডাজনিত সংবেদনশীলতা রয়েছে, তাদের এই সময়ে অ্যাজমা বা শ্বাসকষ্ট বেড়ে যায়। বড়দের ক্ষেত্রে এটিকে আমরা সাধারণত অ্যাজমাই বলি, তবে দুই বছরের কম বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রে একে ‘হুইজি চাইল্ড’ বলা হয়। ঠান্ডা আবহাওয়া শুরু হলে এসব শিশুদের শ্বাসকষ্টের সমস্যা বেড়ে যায়।’
তিনি আরও বলেন, ‘শীতকালে রোটা ভাইরাসের কারণে ডায়রিয়ার প্রকোপ বাড়ে। তবে দূষিত পানিজনিত ডায়রিয়া এখন আর নেই বললেই চলে। কেননা মানুষের সচেতনতার কারণে আমাদের দেশে এখন নিরাপদ পানির ব্যবহার বেড়েছে এবং পুকুরের পানি খাওয়ার দিন শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু রোটা ভাইরাস কিংবা সিজনাল ভেরিয়েশনের (ঋতু পরিবর্তন) কারণে শীতকালে এই ডায়রিয়া দেখা দেয়। বিশেষ করে শিশুরা যখন বাইরে খোলা খাবার খায়, তখন এই ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে।’
শিশুদের সুরক্ষা বিষয়ে পরামর্শ চাইলে এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বলেন, ‘বাচ্চারা স্বভাবতই মুখে হাত দেয়, অথবা কিছু না কিছু মুখে দেয়। এটাকে পুরোপুরি ঠেকানো কঠিন। তাই অভিভাবকদের যথাসম্ভব শিশুকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা, বাইরের খাবার এড়িয়ে চলা এবং পর্যাপ্ত পরিমাণ নিরাপদ পানির ব্যবস্থা রাখতে হবে। খেয়াল করে এসব কেয়ার করতে পারলে শিশু অনেকটাই সুস্থ থাকবে।’
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সার্বিক পরিস্থিতি এবং রোগীর চাপ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এখানে সারা বছরই রোগীর চাপ থাকে এবং সবসময়ই এটি ওভারলোডেড থাকে। তবে বর্তমান পরিস্থিতি বর্ণনাতীত। শীতের আগমনে শিশুদের নিউমোনিয়া ও ডায়রিয়া বাড়লেও কমছে না ডেঙ্গুর প্রকোপ। ফলে ঢাকা মেডিকেলে রোগীর চাপ এত বেড়েছে যে এক বেডে গড়ে ৬ জন শিশুকে চিকিৎসা দিতে হচ্ছে। তাই যথাযথ ও স্বাচ্ছন্দ্যে সেবা নিশ্চিত করতে হাসপাতালের বেড সংখ্যা বাড়ানো এখন জরুরি হয়ে পড়েছে।’
হাসপাতালের ২১০ নম্বর ওয়ার্ডের উদাহরণ দিয়ে ডা. আব্দুল কাদের বলেন, ‘গত চার মাস ধরে আমরা দেখছি যে ওয়ার্ডটিতে মাত্র ১৪টি বিছানা রয়েছে, সেখানে প্রতি বেডে গড়ে ৬ জনের বেশি রোগী থাকছে। একটি বেডের ওপর দুইজন, দুই বেডের মাঝখানের ফ্লোরে দুইজন এবং বেডের সামনের অংশে আরও দুইজন রোগীকে রাখতে হচ্ছে। অর্থাৎ, এই ১৪টি বেডের নির্ধারিত জায়গায় তিল ধারণের ঠাঁই নেই। এই অমানবিক পরিস্থিতিতে চিকিৎসকরা কষ্ট করে হলেও সাধ্যমতো সেবা দেওয়ার চেষ্টা করছেন, কিন্তু রোগীদের নুন্যতম বসার বা শোয়ার জায়গা দিতে না পারাটা চিকিৎসকদের জন্যও অত্যন্ত কষ্টের।’
এবারের শীতে ডেঙ্গুর অস্বাভাবিকতা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন ঢামেকের এই চিকিৎসক। তিনি বলেন, ‘সাধারণত প্রতি বছর বর্ষার পর ডেঙ্গু কমে যায়। কিন্তু এ বছর শীত চলে আসার পরেও ডেঙ্গু কমার কোনো লক্ষণ নেই। তাছাড়া অক্টোবরের শেষ বা নভেম্বরে ডেঙ্গু কমে আসার কথা থাকলেও এ বছর সংক্রমণের হার শুরুর মতো একই গতিতে চলছে।’
ডা. আব্দুল কাদের বলেন, ‘এই সময়টায় ব্রঙ্কিওলাইটিস বাড়ে। এটা সম্পূর্ণ সিজনাল ভেরিয়েশনের কারণে হয়, তাই এটাকে নির্মূল করার নির্দিষ্ট কোনো প্রতিরোধ ব্যবস্থা নেই। তবে কিছু বিষয়ে একটু সতর্ক থাকলেই এই ঝুঁকি এড়ানো যায়। যেমন, অনেক বাবা-মা আবহাওয়া পরিবর্তনের সময় শিশুদের পোশাক নিয়ে অতিরিক্ত সচেতনতা দেখাতে গিয়ে ভুল করে ফেলেন। সন্ধ্যার দিকে সামান্য শীতে শিশুকে এত বেশি গরম কাপড় পরান যে শিশু ঘেমে যায়। এই ঘাম থেকেই ঠান্ডা লাগতে পারে। আবার কেউ কেউ বিকেলে গরম মনে করে ফ্যান চালিয়ে ঘুমান, যা ছোট বাচ্চারা সহ্য করতে পারে না।’ তাই তাপমাত্রার সাথে সামঞ্জস্য রেখে শিশুকে সঠিক পোশাক পরানো এবং প্রয়োজন বুঝে ফ্যান ব্যবহারের পরামর্শ দেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, ‘গোসল নিয়ে অনেক অভিভাবকের ভুল ধারণা আছে। কেউ নিয়মিত গোসল করান, আবার কেউ শীতের ভয়ে শিশুদের গোসল করানো কমিয়ে দেন। মূলত গোসল কম করানোর অভ্যাসটি ঠিক নয়, বরং নিয়মিত গোসল করানোই স্বাস্থ্যসম্মত। তবে সেক্ষেত্রে পানির তাপমাত্রা যেন সহনশীল ও আরামদায়ক হয়। অর্থাৎ খুব ঠান্ডাও না, আবার খুব গরমও না-এমন সহনীয় তাপমাত্রার পানি দিয়ে শিশুকে নিয়মিত গোসল করাতে হবে। অতিরিক্ত গরম পানিতে গোসল করালে শিশুদের ঘাম হতে পারে, যা থেকে ঠান্ডা লাগার ঝুঁকি থাকে।’
চিকিৎসা সেবায় রোগীদের ভোগান্তি নিয়ে জানতে চাইলে ডা. আব্দুল কাদের বলেন, ‘সারা দেশের মানুষ যেকোনো জটিলতায় সবার আগে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ছুটে আসেন। এমনকি ঢাকার মধ্যে আরও তিনটি সরকারি মেডিকেল কলেজ থাকা সত্ত্বেও রোগীরা ঢামেককেই একমাত্র ভরসাস্থল মনে করেন। তাছাড়া জেলা পর্যায়ের চিকিৎসকরাও রোগীকে রেফার করার ক্ষেত্রে ঢাকা মেডিকেলকে বেছে নেন। তাই অন্যান্য হাসপাতাল সম্পর্কে রোগীদের তেমন কোনো ধারণা থাকে না।’
এ সময় তিনি মুগদা মেডিকেলের উদাহরণ দিয়ে বলেন, ‘মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল অত্যন্ত ভালোমানের একটি সরকারি হাসপাতাল। সেখানকার সেবার মান ঢাকা মেডিকেলের মতোই স্ট্যান্ডার্ড। কিন্তু প্রচারণার অভাবে কিংবা মানুষ না জানার কারণে সেখানে রোগীর চাপ কম। পুরান ঢাকায় মিটফোর্ড এবং শেরেবাংলা নগরে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালও ভালো সেবা দিচ্ছে। রোগীরা যদি এসব হাসপাতালে যান, তবে তারা যেমন স্বাচ্ছন্দ্যে সেবা পাবেন, তেমনি ঢাকা মেডিকেলের ওপর থেকেও অমানবিক চাপ কমবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের দেশের বাস্তবতা মেনে নিয়ে আমরা আমাদের সর্বোচ্চ দিয়ে সেবা করে যাচ্ছি। তবে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শয্যা সংখ্যা বাড়ানো এখন সময়ের দাবি। যদি তা বাড়ানো যায় তাহলে আমরা রোগীদেরকে আরও স্বাচ্ছন্দ্যে সেবা দিতে পারবো।’