শিরোনাম

শাহজাহান নবীন
ঝিনাইদহ, ৬ ডিসেম্বর ২০২৫ (বাসস): আজ ৬ ডিসেম্বর। ১৯৭১ সালের এই দিনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কবল থেকে মুক্ত হয় ঝিনাইদহ জনপদ। দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে যশোর ও ঝিনাইদহ পাক বাহিনীর কাছে হয়ে ওঠে এক আতঙ্কের জনপদ। ডিসেম্বর মাসের শুরু থেকেই বীর মুক্তিযোদ্ধা ও গেরিলা বাহিনীর তীব্র আক্রমণে দিশেহারা হয়ে পড়ে পাক বাহিনী।
১৯৭১ এর ৬ ডিসেম্বর পাক হানাদার ও তাদের দোসরদের পরাজিত করে ঝিনাইদহকে স্বাধীন করে মুক্তিযোদ্ধারা। সেদিন ঝিনাইদহের আকাশে প্রথম উড্ডীন হয় স্বাধীন বাংলাদেশের লাল সবুজের পতাকা।
মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ঝিনাইদহে মুক্তি বাহিনীর সঙ্গে পাক বাহিনীর প্রথম সম্মুখ যুদ্ধ হয় ১ এপ্রিল। জেলার সদর উপজেলার বিষয়খালী বাজারে মুক্তিবাহিনীর তীব্র প্রতিরোধের মুখে পড়ে পাক হানাদাররা। ওই যুদ্ধে তুমুল প্রতিরোধ গড়ে তোলেন বীর মুক্তি সেনানীরা।
ঝিনাইদহ জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পাঠে জানা যায়, বিষয়খালীতে ১ এপ্রিল ‘প্রথম সম্মুখ প্রতিরোধ যুদ্ধ’ হয়। ওই দিন পাকবাহিনী যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে ভারী অস্ত্রসস্ত্রসহ কামানবাহী ট্যাংকের বহর নিয়ে ঝিনাইদহ দখলের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। খবর পেয়ে মুক্তিবাহিনী ঝিনাইদহের বিষয়খালীতে অবস্থান নেয়। পাকবাহিনী বিষয়খালী বাজারের উপকণ্ঠে পৌঁছানো মাত্রই মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ শুরু হয়। মুক্তিযোদ্ধারা বেগবতী নদীর ওপর বিষয়খালী সেতু গুড়িয়ে দেন। ফলে সেতুর অন্য প্রান্তে আটকা পড়ে পাক সেনাদের বহর।
পাকবাহিনীর সাথে মুক্তিবাহিনীর দীর্ঘ ৮ ঘণ্টার সম্মুখ যুদ্ধ হয়। পরে মুক্তিবাহিনীর তুমুল আক্রমণে পিছু হটতে বাধ্য হয় পাকহানাদার বাহিনী।
এছাড়া ১৯৭১ এর ৪ এপ্রিল শৈলকূপা উপজেলার গাড়াগঞ্জ যুদ্ধ, একই দিন শৈলকূপা উপজেলার আলফাপুর যুদ্ধ, ২৬ নভেম্বরের কামান্না যুদ্ধ আজও ঝিনাইদহবাসীর স্মৃতিতে ভাস্বর।
ঝিনাইদহের বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. তাজউদ্দিন আহমেদ মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করে বাসসকে বলেন, ‘আমি ইস্ট পাকিস্তান রেজিমেন্ট (ইপিআর) এ ছিলাম। বাঙালি সেনাদের অস্ত্র সমর্পণের জন্য পাক আর্মি নির্দেশ দেয়। আমরা নির্দেশ অমান্য করে অস্ত্র নিয়ে ক্যান্টনমেন্ট থেকে পালিয়ে ভারতে চলে যাই। পরে সিলেট সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে যুদ্ধ করেছি। মৌলভীবাজারের ধলই সীমান্তে বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানের সতীর্থ হিসেবে যুদ্ধ করেছি। আমি সেদিন পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলাম।’
তিনি বলেন, ১৯৭১ সালে নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে সারাদেশেই গেরিলা আক্রমণ বাড়ায় মুক্তিবাহিনী। গেরিলা আক্রমণে সারাদেশের বিভিন্ন এলাকায় পাক হানাদার বাহিনী দিশেহারা হয়ে পড়ে। সেই দিনগুলো মনে পড়লে আজও শরীর শিউরে ওঠে।
জেলার বীর মুক্তিযোদ্ধা এসএম মশিউর রহমান বাসসকে বলেন, প্রথম স্বাধীন জেলা যশোর। ঝিনাইদহ তখন যশোরের একটি মহকুমা। বৃহত্তর যশোর জেলা একই দিনে স্বাধীন হয়। যশোর ক্যান্টনমেন্টে মুক্তিবাহিনীর তীব্র আক্রমণে পাক বাহিনী বেহাল হয়ে পড়ে। ৬ ডিসেম্বর ঝিনাইদহ হানাদার মুক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ি ঘর থেকে দলে দলে সর্বস্তরের মানুষ রাস্তায় বেরিয়ে আসেন। তারা জাতীয় পতাকা হাতে নিয়ে বিজয়োল্লাস করতে থাকে। আজও চোখের সামনে সেই দিনগুলো ভেসে বেড়ায়।
তিনি বলেন, আমি তখন ছাত্র। তরুণ যুবকেরা দেশ স্বাধীন করার জন্য জান প্রাণ দিয়ে লড়াই শুরু করে। পাকিস্তানি বাহিনীর মনোবল ভেঙে দিতে আমরা বিষয়খালী সেতু ভেঙে দিই। এরপর তারা আর ঝিনাইদহ শহর হয়ে কুষ্টিয়া মাগুরার দিকে যাওয়ার সাহস করেনি। সেই সময়ের কথা এখনো চোখের সামনে ভাসে। মুক্তিযুদ্ধ ছিল মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত সংগ্রাম। মুক্তিযোদ্ধাদের মাথায় স্বাধীনতা ছাড়া অন্য কোনো চিন্তা তখন ছিল না। খাওয়া-দাওয়ার কথাও আমরা ভুলে যেতাম। গ্রামের মানুষ, শহরের মানুষ মুক্তিযোদ্ধাদের দেখলেই পরম যত্ন করতেন।
জানা গেছে, মুক্তিযুদ্ধে জেলায় ২৭৬ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। তাঁদের মধ্যে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন দুজন। তাঁরা হলেন বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান ও বীর প্রতীক সিরাজুল ইসলাম।