বাসস
  ০৪ নভেম্বর ২০২৫, ১৬:৩৫

বজ্রযোগিনী গ্রামের অতীশ দীপংকর গ্রন্থাগার গবেষকদের জন্য অমূল্য তথ্য ভাণ্ডার

মুন্সীগঞ্জ জেলার বজ্রযোগিনী গ্রামে শ্রীজ্ঞান অতীশ দীপংকরের জন্মভিটায় নির্মিত গ্রন্থাগার। ছবি: বাসস

\ মো. মঞ্জুর মোর্শেদ \

মুন্সীগঞ্জ, ৪ নভেম্বর, ২০২৫ (বাসস ) : জেলার বজ্রযোগিনী গ্রামে শ্রীজ্ঞান অতীশ দীপংকরের জন্মভিটায় নির্মিত গ্রন্থাগারটি হাজার বছরের ইতিহাস বহন করে চলেছে। এটি এখন গবেষক ও পর্যটকদের জন্য এক অমূল্য তথ্য ভাণ্ডার। ইতিহাসের অমূল্য দলিলের সন্ধানে অনেক গবেষকই আসেন এই গ্রন্থাগারে। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা ও সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ করা হলে এই গ্রন্থাগারটি উপমহাদেশের গুরুত্বপূর্ণ গবেষণাকেন্দ্রে পরিণত হবে।  

ইতিহাস পাঠে জানা যায়, বাঙালি বৌদ্ধাচার্য দীপংকর শ্রীজ্ঞান অতীশ ৯৮২ খ্রিষ্টাব্দে বিক্রমপুর পরগনায় বর্তমান মুন্সীগঞ্জ জেলার বজ্রযোগিনী গ্রামে গৌড়ীয় রাজ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন বিক্রমপুরের ছোট নগরীর রাজা কল্যাণশ্রী। মাতার নাম প্রভাবতি। তিন ভাইয়ের মধ্যে অতীশ দীপংকর ছিলেন দ্বিতীয়। তাঁর অপর দুই ভাইয়ের নাম ছিল পদ্মগর্ভ ও শ্রীগর্ভ। পিতা মাতা তার নাম রেখেছিলেন চন্দ্রগর্ভ । কিন্তু ‘অতীশ দীপংকর’ ও ‘শ্রীজ্ঞান’  প্রভৃতি উপাধিগুলোর কাছে তার ‘চন্দ্রগর্ভ’ নাম ম্লান হয়ে যায়।

বাল্যজীবনে দীপংকর তাঁর মায়ের কাছ থেকে বেধ শিক্ষা গ্রহণ করেন। তিন বছর বয়সে বিদ্যালয়ে গিয়ে পড়ালেখা শুরু করেন। ১০ বছর বয়সেই শিল্প, জ্যোতিষ বিদ্যা, বেধ-বেদান্তে, সংস্কৃত ভাষা ও বৌদ্ধ ধর্মের বিভিন্ন বিষয়ের উপর জ্ঞান অর্জন শুরু করেন।

তিব্বতের রাজা চংছুব দীপংকর শ্রীজ্ঞানকে অতীশ উপাধি দেন। ‘অতীশ’ শব্দের অর্থ ‘শান্তি’ বা ‘জ্ঞানের অগ্রপথিক’। তিব্বতীয়রা অতীশ দীপংকর শ্রীজ্ঞানকে ‘জোবো’ বা প্রভু দেবতা রূপে পূজা করেন। দীপংকর কৃষ্ণ গিরি বা কানহেরী বিহারে রাহুল গুপ্তের কাছে বৌদ্ধদের ত্রিশিক্ষা নামক তত্ত্ব গ্রন্থে জ্ঞান লাভের জন্য যান।

দীপংকর শৈশবেই ইষ্টদেবীর উপদেশে রাজ্য ত্যাগ করে যোগ্য গুরুর সন্ধানে দেশ ত্যাগ করেন। উনিশ বছর বয়সে দীপংকর ওদন্তপুরী বিহারের আচার্য পরম পণ্ডিত আচার্য শিলরক্ষিতের কাছ থেকে ভিক্ষু ব্রতে দীক্ষা লাভ করেন। তখন তাঁকে ‘দীপংকর শ্রীজ্ঞান’ উপাধি দেওয়া হয়। 

৩১ বৎসর বয়সে ১০১২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি উচ্চতর ও গভীরতর জ্ঞানের সন্ধানে ভারতবর্ষ ত্যাগ করে পূর্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ সুবর্ণদ্বীপে (বর্তমান ইন্দোনেশিয়ায়) যান। ১৪ মাস সমুদ্র যাত্রা শেষে সুবর্ণদ্বীপে পৌঁছেন। সেসময় পূর্ব ভারতের সুবর্ণদ্বীপ ছিল বৌদ্ধধর্ম চর্চার একটি প্রধান কেন্দ্র। এখানে  ধর্মকীর্তির শিষ্যত্ব গ্রহণ করে ১২ বছর অধ্যয়ন করে ১০২৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি আবার ভারতবর্ষে ফিরে আসেন। 

সুবর্ণদ্বীপ থেকে ফিরে আসার পর ভারতীয় উপমহাদেশের বঙ্গের রাজধানী বিক্রমপুরে বিভিন্ন বৌদ্ধ বিহারকেন্দ্রিক শিক্ষালয়ে পাঠ দান শুরু করেন। ভারতে ফিরে আসার সময় দীপংকর মহাবোধি বিহারে বজ্রাসনে বাস করেন। সে সময়ে বাংলাদেশের পালবংশীয় নরপতি মহিপালদেব অতীশ দীপংকরকে তার বিক্রমশিলা বিহারে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে আসেন। খ্রিষ্টীয় একাদশ শতাব্দির প্রথম দিকে নালন্দার বিশ্ব বিখ্যাত বৌদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয় (বিহার) অগ্নিদাহে বিনষ্ট হলে মহিপালদেব শ্রীজ্ঞান অতীশ দীপংকরের পান্ডিত্যে মুগ্ধ হয়ে তাকে নিমন্ত্রণ করেন। মহিপালের আমন্ত্রণে তিনি বিহারে গমন করেন। মহিপালদেবের মৃত্যুর পর তার পুত্র নয়পালদেব দীপংকর শ্রীজ্ঞানকে বিক্রমশীল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিহারের)অধ্যক্ষ নিযুক্ত করেন। বিক্রমশীল বিহারে থাকাকালীন অতীশ দীপংকর সোমপুর বিহারে কিছুদিন বাস করেন ।

দীপংকর শ্রীজ্ঞান দুই শতাধিক গ্রন্থ রচনা, অনুবাদ ও সম্পাদনা করেন। তিব্বতের ধর্ম, রাজনীতি, জীবনী, স্তোত্রনামাসহ তাঞ্জুর নামে এক শাস্ত্রগ্রস্থ সংকলন করেন। এছাড়াও তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনাবলি হলো; বোধি-পথ-প্রদীপ, মহাযান পথ সাধন, হৃদয়-নিশ্চিন্ত, মধ্যমোপদেশ, সত্যদ্বয়বতার, চিকিৎসা-জীব সেবা, A Lamp for the path to Enlightenment , The Method of Curing Head Ailmentsচর্যা সংগ্রহ প্রদীপ ইত্যাদি। বৌদ্ধ শাস্ত্র, চিকিৎসা শাস্ত্র এবং কারিগরি বিদ্যা বিষয়ে তিব্বতি ভাষায়ও তিনি অনেক গ্রন্থ রচনা করেন।

তিব্বতে প্রায় ১২ বছর বাস করে ৭০ বা ৭২ বৎসর বয়সে আনুমানিক ১০৫৩ খ্রিষ্টাব্দে তিব্বতের ন্যাথাং বিহারে তাঁর মহাপ্রয়াণ ঘটে। অতীশের সমাধি মন্দির গ্রো-ম ( Sgro-ma )  নামে পরিচিত।

তাঁর মৃত্যুর আনুমানিক ৯১০ বছর পরে ১৯৬৩ সালে বাংলাদেশ বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সংঘ মহাপণ্ডিত অতীশ দীপংকরের দেহভস্ম চীন থেকে স্বদেশে আনার প্রক্রিয়া শুরু করে। পরবর্তীতে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের পৃষ্টপোষকতায় ১৯৭৮ সালে তাঁর দেহভস্ম বাংলাদেশে এনে ধর্মরাজিক বৌদ্ধ মহাবিহারে সুরক্ষিত করা হয়।

তিনি বাঙালি বৌদ্ধ মহাচার্যদের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম। অতীশ দীপংকর একজন প্রখ্যাত বৌদ্ধ পণ্ডিত ও দার্শনিক। অতীশ দিপংকর পাল সাম্রাজ্যের আমলে একজন বৌদ্ধ ভিক্ষু এবং বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারক ছিলেন।

 ২০০৪ সালে মুন্সীগঞ্জের বজ্রযোগিনীর পণ্ডিত ভিটায় অতীশ দীপংকরের ১০২৪ তম জন্মবার্ষিকী পালন করা হয়। 

২০১৩ সালে ধর্মরাজিক বৌদ্ধ মহাবিহার থেকে অতীশের দেহভস্মের কিছু অংশ পণ্ডিত ভিটায় প্রতিস্থাপনের  মাধ্যমে অতীশ রেলিক্স স্তুপা নির্মাণ করার মাধ্যমে অতীশ দীপংকর মেমোরিয়াল কমপ্লেক্স প্রতিষ্ঠা করা হয়। 

২০১৮ সালে পণ্ডিত ভিটায় গ্রন্থাগার ও অতীশ দীপংকর স্মৃতি জাদুঘর নির্মাণ করা হয়। গ্রন্থাগারে এক হাজারের বেশি বই রয়েছে। এর মধ্যে অতীশ দীপংকরের জীবনীসহ তাঁর রচিত দুই শতাধিক বই আছে। প্রায় ১ একর জমির উপর নির্মিত অতীশ রেলিক্স স্তুপা, গ্রন্থাগার ও জাদুঘরটির সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ করা হলে এবং সরকারি পৃষ্টপোষকতা পেলে এটি উপমহাদেশের গুরুত্বপূর্ণ এক গবেষণাগারে পরিণত হবে।