বাসস
  ০২ নভেম্বর ২০২৫, ১৬:৩১

দেশে খেজুর গুড়ের সংকট নিরসনে গবেষকদের তিন সুপারিশ

খুলনা বিভাগের চুয়াডাঙ্গায় অবস্থিত 'সরোজগঞ্জ' খেজুর গুড়ের হাট। ছবি : বাসস

।। মুহাম্মদ নূরুজ্জামান।।

খুলনা, ২ নভেম্বর, ২০২৫ (বাসস) : খেজুর গাছের সংখ্যা হ্রাস, রস সংগ্রহের ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় (গাছি) নতুন প্রজন্ম আসতে আগ্রহী না হওয়া এবং ভেজাল গুড়ের দৌরাত্ম্যের কারণে দেশে খেজুর গুড়ের সংকট দেখা দিয়েছে। আর এসব কারণে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতির অন্যতম প্রাণকেন্দ্র এবং দেশের বৃহত্তম খুলনা বিভাগের চুয়াডাঙ্গায় অবস্থিত 'সরোজগঞ্জ' খেজুর গুড়ের হাট। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় (খুবি) ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) গবেষকদের এক যৌথ গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে। গবেষণায় এই ঐতিহ্যবাহী হাটের টেকসই ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে।

খুবির ইতিহাস ও সভ্যতা ডিসিপ্লিনের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. মাহমুদ আলম বাসসকে বলেন, ‘ দেশে খেজুর গাছের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে হ্রাস পাচ্ছে। যার একটি বড় কারণ খেজুর গাছ ইটভাটায় জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। সেই সাথে খেজুর রস সংগ্রহের মতো ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় (গাছি) নতুন প্রজন্ম আর আসতে আগ্রহী হচ্ছে না।’

তিনি জানান, এ সংকট উত্তরণের জন্য গবেষকরা কৃষি অধিদপ্তরের মাধ্যমে উপযুক্ত মাটি ও পরিবেশে বেশি বেশি খেজুর গাছের চারা রোপণ, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রশিক্ষণ ও সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির মাধ্যমে গাছির সংখ্যা বৃদ্ধি এবং ভেজাল রোধে বাজার মনিটরিং জোরদার করার পরামর্শ দিয়েছে।

ড. মাহমুদ বলেন,‘সবচেয়ে বড় হুমকি হলো ভেজাল গুড়ের দৌরাত্ম্য। কিছু অসাধু ব্যবসায়ী অতিরিক্ত লাভের আশায় গুড়ের সাথে ক্ষতিকর রাসায়নিক, সোডা, রং ও ফিটকিরি মেশাচ্ছে। যা এই ঐতিহ্যবাহী শিল্পের সুনাম নষ্ট করছে এবং জনস্বাস্থ্যের জন্যও হুমকি। এই সমস্যাগুলো এখনই সমাধান করা না গেলে এই ঐতিহ্যবাহী শিল্প ও অর্থনৈতিক কেন্দ্রটি ঝুঁকির মুখে পড়বে।’

তিনি বলেন, ‘সরোজগঞ্জ হাট বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতির জন্য একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। যা গত প্রায় একশ বছরে একটি মিশ্র অর্থনৈতিক কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। স্থানীয়ভাবে হাটটি তিনশ বছরের পুরোনো বলে দাবি করা হলেও, গবেষণায় দেখা গেছে, ২০ শতকের দ্বিতীয় দশকে 'সরোজগঞ্জ' নামকরণের পরই মূলত এই গুড়ের হাটটি যাত্রা শুরু করে।

ড. মাহমুদ বাসসকে আরও বলেন, ‘২০১৯ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত পরিচালিত এ গবেষণায় জানা যায়, সরোজগঞ্জ হাটে প্রতি মৌসুমে গড়ে ৫ হাজার ৪১২ মেট্রিক টন গুড় বিকিকিনি  হতো। যার গড় আর্থিক মূল্য প্রায় ৭০ কোটি বাংলাদেশি টাকা। এখানে প্রধানত চার ধরনের গুড় পাটালি (নোলেন পাটালি), দানা গুড়, ঝোলা গুড় এবং চিটিয়া গুড় বিক্রি হয়।’

তিনি বলেন, অর্থনৈতিক এই কর্মকাণ্ডকে কেন্দ্র করে একটি গ্রামীণ উদ্যান পালন ভিত্তিক শিল্প গড়ে উঠেছে। এই গুড় শিল্পকে সমর্থন দিতে, অর্থাৎ গুড় সংরক্ষণ ও বাজারজাত করার পাত্র সরবরাহের জন্য একটি সহযোগী মৃৎশিল্পও সেখানে বিকশিত হয়েছে।

ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অফ সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড প্ল্যানিং-এ প্রকাশিত এই গবেষণাটি যৌথভাবে পরিচালনা করেন খুবির ইতিহাস ও সভ্যতা ডিসিপ্লিনের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. মাহমুদ আলম, ঢাবির ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের শিক্ষক মো. নুরুল আলম এবং খুবির ইতিহাস ও সভ্যতা ডিসিপ্লিনের সাবেক শিক্ষার্থী মো. আল-আমিন।

গবেষকরা বলেন, এই তীব্র চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও সরোজগঞ্জ হাট এখনও গ্রামীণ অর্থনীতির একটি বিশাল চালিকাশক্তি হিসেবে টিকে আছে। গবেষণায় এই হাটকে একটি মিশ্র কেন্দ্র হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। যেখানে বাণিজ্য, আর্থিক এবং শিল্প এই তিনটি খাতেরই বৈশিষ্ট্য একীভূত হয়েছে।

বাণিজ্য কেন্দ্র হিসেবে এর গুরুত্ব তুলে ধরে গবেষণাপত্রে উল্লেখ করা হয়, এই হাট থেকে ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রাম, বরিশাল, গাজীপুরসহ দেশের বিভিন্ন জেলার পাইকাররা গুড় সংগ্রহ করেন। শুধু দেশেই নয়, এখান থেকে সংগৃহীত গুড় ভারত, সুইডেন, কানাডা, ইতালি, সৌদি আরব এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশেও রপ্তানি হয়। এই বাণিজ্যের আর্থিক আকারও বিশাল। 

ড. মো. মাহমুদ আলম খেজুর গুড়ের চলমান সংকট থেকে উত্তরণে সরকারের কৃষি অধিদপ্তরের মাধ্যমে সারাদেশে খেজুরের চারা রোপণের উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ দেন। 

তিনি বলেন, নতুন নতুন টেকনোলজি (প্রযুক্তিগত) উদ্ভাবনের মধ্য দিয়ে গাছিদের খেজুরের রস সংগ্রহের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। একইসাথে এ পেশার সঙ্গে জড়িতদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির মাধ্যমে গাছির সংখ্যাও বাড়াতে হবে।

নিরাপদ খাদ্য অধিদপ্তর এবং ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মাধ্যমে বাজার মনিটরিং করে ভেজাল গুড় উৎপাদন এবং বাজারজাত করা বন্ধ করতে তিনি সংশ্লিষ্টদের আরো কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানান।