শিরোনাম

।। বিপুল ইসলাম।।
লালমনিরহাট, ৩০ অক্টোবর, ২০২৫ (বাসস) : এক সময় গ্রাম হোক বা শহর—অন্ধকার দূর করার একমাত্র ভরসা ছিল কুপি বাতি আর হারিকেন। যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আবিষ্কৃত হলো হ্যাজাক লাইট, যা আরও উজ্জ্বল আলো দিত। বিদ্যুৎবিহীন সেই সময়ে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো লালমনিরহাটের প্রতিটি ঘরেও এই তিন আলোর উৎস ছিল জীবনের অপরিহার্য অংশ।
বিশেষ করে ‘হারিকেন’ শব্দটি উচ্চারিত হলে আজও মনে ভেসে ওঠে শৈশবের সেই দৃশ্য—ক্ষীণ আলোর উষ্ণতায় ঘেরা পারিবারিক সময়। পরিবারে সবাই একসঙ্গে বসে গল্প করত, হাসত, আনন্দে সময় কাটাত।
সময় বদলেছে, এখন চারপাশ আলোকিত বিদ্যুতের আলোয়। তবুও হারিকেনের সেই নরম আলো আর অতীতের স্মৃতি আজও মনে জাগায় মিষ্টি এক নস্টালজিয়া—যা মনে করিয়ে দেয় হারিয়ে যাওয়া শান্ত, সরল দিনের কথা।
জানা যায়, হারিকেন কেবল আলোর যন্ত্র নয়; এটি মানুষের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা এক আবেগ, এক নির্ভরতার প্রতীক। বিয়ে, সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান, কিংবা সাংস্কৃতিক আসরে আলো জ্বালানোর জন্য ব্যবহৃত হতো এই প্রদীপ। যুগের পরিবর্তনে হ্যাজাক লাইটের ব্যবহার শুরু হয়, যা আরও উজ্জ্বল আলো দিত এবং বড় অনুষ্ঠান বা ধর্মীয় সভায় ব্যবহৃত হতো। শিক্ষার্থীরাও সন্ধ্যা হলেই হারিকেনের আলোয় পড়াশোনা করত।
বিদ্যুৎ আসার পর ধীরে ধীরে হারিকেনের প্রয়োজন কমে যায়। আজকের দিনে হারিকেন, কুপি বাতি ও হ্যাজাক লাইট কেবলই অতীতের স্মৃতি।
ইতিহাসে কুপি বাতি ও হারিকেনের আবিষ্কারের নির্দিষ্ট সময় জানা না গেলেও যুগে যুগে এই আলোর যন্ত্র মানুষের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। অন্যদিকে, জানা যায় হ্যাজাক লাইট ১৯১০ সালে জার্মান বিজ্ঞানী ম্যাক্স গ্রেটেজ আবিষ্কার করেন। এটি তেল বা গ্যাস ব্যবহার করে বায়ুচাপের সাহায্যে উজ্জ্বল আলো ছড়ায়।
লালমনিরহাট সদর উপজেলার বড়বাড়ী ইউনিয়নের সাবেক সদস্য করিম মেম্বার স্মৃতিচারণ করে বলেন, ছোটবেলায় সন্ধ্যার আগে হারিকেনের কাচের চিমনি খুলে ধুয়ে পরিষ্কার করতাম। কেরোসিন তেল ঢেলে দিয়াশলাই জ্বালিয়ে আলো দিতাম। আলো কমানোর জন্য চাকতি ঘুরাতে গিয়ে অনেক সময় শলাকাটি তেলের ভেতর পড়ে যেত, তখন সেটা বের করা ছিল কষ্টসাধ্য কাজ। হাতের কেরোসিন খাবারে পড়লে বকুনি খেতে হতো। গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই কেরোসিন তেল রাখা হতো কাচের বা প্লাস্টিকের বোতলে, গলায় রশি বেঁধে বাঁশের খুঁটিতে ঝুলিয়ে।
একই ইউনিয়নের খেদাবাগ এলাকার প্রবীণ শিক্ষক পাটোয়ারী মাস্টার বলেন, হারিকেন ও কুপির মৃদু আলোয় ছাত্রদের পড়াতাম। বাতাসে আলো নিভে গেলে চুলা থেকে পাটকাঠি জ্বেলে আবার হারিকেন জ্বালাতে হতো।
আদিতমারী উপজেলার মুদি দোকানদার নজরুল ইসলাম জানান, ২০-২৫ বছর আগেও সন্ধ্যায় হারিকেন জ্বালানোর জন্য কেরোসিন তেল কিনতে মানুষের লাইন লেগে যেত। এখন কেরোসিন তেলই বাজারে পাওয়া যায় না। বিদ্যুতের সহজ লভ্যতায় হারিকেন ও কুপি বাতি এখন ইতিহাসের পাতায় স্থান পেয়েছে। নতুন প্রজন্মের অনেকেই চোখে দেখেনি সেই আলো, যা একসময় ছিল গ্রামীণ জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
একই এলাকার আজিত মাস্টার বলেন, কুপি, হারিকেনসহ রাতের উজ্জ্বল আলোর সবচেয়ে ভালো উৎস ছিল ‘হ্যাজাক লাইট’। প্রায় ৩০ বছর আগেও এ লাইট ব্যবহৃত হতো। আজ এটি অচেনা। শুধু তাই নয়, একসময় হ্যাজাক লাইট ভাড়া দেওয়া ও মেরামতের ব্যবসাও ছিল বেশ জমজমাট, এখন তা বিলুপ্ত।
লালমনিরহাটের বড়বাড়ী ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও বীর মুক্তিযোদ্ধা ইয়াসিন আলী মোল্লা স্মৃতিচারণ করে বলেন, একসময় গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে হারিকেন ও কুপির আলোই ছিল শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার একমাত্র ভরসা। উঠান বা বারান্দায় বসে শিশুরা সেই আলোয় পড়ত। ডাকপিয়নেরা চিঠির ব্যাগ কাঁধে নিয়ে হাতে হারিকেন জ্বালিয়ে পথে বের হতো। এখনো কিছু বাড়িতে হয়তো মরিচা ধরা হারিকেন পড়ে আছে, তবে সেগুলো আর ব্যবহারের উপযোগী নয়।
তিনি আরও বলেন, এখন ঘরে ঘরে, হাটবাজারে, রাস্তাঘাটে সর্বত্রই বৈদ্যুতিক আলোর ঝলকানি। প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে হারিকেনের জায়গা নিয়েছে সোলার লাইট ও বিদ্যুৎ। জ্বালানি খাতে উন্নতির ফলে কুপি, হারিকেন ও হ্যাজাক লাইট এখন প্রায় বিলুপ্ত। নতুন প্রজন্মের অনেকেই জানে না—এসবই ছিল এক সময় আলোর প্রধান উৎস।
গুণীজনদের মতে, দেশে বিদ্যুৎ এখন আর বিলাসিতা নয়—এটি প্রতিটি ঘরের প্রয়োজনীয় বাস্তবতা। দেশের প্রায় প্রতিটি গ্রামে আজ আলো পৌঁছে গেছে। শহরের পাশাপাশি গ্রামীণ এলাকাগুলোতেও এখন ব্যবহৃত হচ্ছে সোলার প্যানেল, রিচার্জেবল লাইট, ব্যাটারি ফ্যান, এলইডি বাল্ব—যা বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব।
এক সময় যে হারিকেনের আলোয় শিশুরা পড়াশোনা করত, আজ তাদের সন্তানরা ল্যাপটপ ও মোবাইলের আলোয় অনলাইন ক্লাস করছে। এ যেন এক যুগ থেকে আরেক যুগে আলোর বিবর্তনের গল্প।
তবুও, অনেকেই আজও সেই অতীতকে ভুলে যেতে পারেন না। কারও আলমারির কোনে, কারও বারান্দায় বা দোকানের তাকের ওপর এখনো পড়ে আছে মরিচা ধরা হারিকেন—যা দেখে মনে পড়ে যায় শৈশবের সেসব শান্ত সন্ধ্যা, যখন অন্ধকার দূর হতো মৃদু কেরোসিনের আলোয়।
বিদ্যুতের এই যুগে হারিকেন, কুপি বাতি ও হ্যাজাক লাইটের ব্যবহার বিলুপ্ত হলেও এর স্মৃতি এখনো জড়িয়ে আছে বাঙালির জীবনের সঙ্গে। এটি কেবল এক যন্ত্রের ইতিহাস নয়—এক সময়ের জীবনধারা, ঐতিহ্য ও সামাজিক বন্ধনের প্রতীক।