বাসস
  ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৯:৩৬
আপডেট : ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১০:১০

ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী নারীর স্বাস্থ্যসেবা

ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ (বাসস) : মিনতি চাকমা, দীর্ঘ দিন ধরে যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত। এ ব্যাপারে চিকিৎসা নিতে তেমন কোন উদ্যোগ গ্রহণ করেননি তিনি। উদ্যোগী হবেনই বা কী করে, বাড়ি থেকে অনেক দূরে উপজেলা সদরে সরকারি হাসপাতাল। সেখানে বেশির ভাগ সময়ই ডাক্তার থাকেন না। দীর্ঘদিন পর ডাক্তার পাওয়া গেলেও সরকারি ওষুধ জোটে না। 

খাগড়াছড়ির দীঘিনালা উপজেলার উপেন্দ্র কারবারিপাড়া গ্রামের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর এক অসচ্ছল পরিবারের সদস্য মিনতী চাকমা। তার বয়স ৪৫ বছর। তিনি ধূমপানে আসক্ত। দারিদ্র্যতা, পরিবেশ, অসচেতনতা ও কুসংস্কারে আচ্ছন্ন থাকার কারণে এসব ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী নারীদের স্বাস্থ্যসেবা ব্যাহত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। একই জেলার পানছড়ি উপজেলার কাশি কারবারিপাড়া এলাকার ৩২ বছর বয়সী মালতি রাণী ত্রিপুরা। দীর্ঘদিন মেয়েলী স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছেন তিনি। সরকারি তেমন কোন সুচিকিৎসা পাচ্ছেন না। কারণ, হাপাতালের পরিবেশ জরাজীর্ণ, অপরিচ্ছন্ন ও অনিয়মে ভরা। মশা-মাছি আর দুর্গন্ধে চিকিৎসা ও নার্সিং সেবা পাওয়াতো দূরের কথা হাসপাতালের বেডে শুয়ে থাকাই দায়। হাতেগোনা কয়েকটি বেসরকারি এনজিও আছে যারা মাঝে মধ্যে কিছু কিছু চিকিৎসা সেবা প্রদান করে। তবে তাদের বাণিজ্যিক কাজ ও মিশনারি কাজেই বেশি মনোযোগী হতে দেখা যায়।

২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী পার্বত্য এলাকার মোট জনসংখ্যা ১৫,৯৮,২৯১ জন। এদের প্রায় অর্ধেকই নারী। বাঙালি ছাড়াও এখানে ১৩টি নৃগোষ্ঠী বসবাস করে। এরা হচ্ছে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, মুরং, তঞ্চঙ্গ্যা, বম, পাংখোয়া, খুমি, চাক, লুসাই, উসাই, বনযোগী এবং খিয়াং। মোট জনসংখ্যার ৪৭ শতাংশ বাঙালি, ২৬ শতাংশ চাকমা, ১২ শতাংশ মারমা এবং ১৫ শতাংশ অন্যান্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী। 

দেশের সমতল ও পাহাড়ি অঞ্চলে বসবাসরত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী এলাকায় সরেজমিনে দেখা যায়, নারীদের শিক্ষা ও সচেতনতার অভাবে তারা অনেক রোগ ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছেন। পাশাপাশি সেখানে সরকারের স্বাস্থ্য শিক্ষা ও গণসচেতনতা কার্যক্রম নেই বললেই চলে। পরিবার ও সমাজে স্বাস্থ্য সচেতনতা না থাকায়— বয়ঃসন্ধিকালে কিশোরী, বাল্যবধূ, নববিবাহিতা, গর্ভবতী, শিশুকে বুকের দুধ পান করানো মায়েরা রক্তস্বল্পতাসহ নানান জটিল ও কঠিন মেয়েলীরোগে ভোগেন। এছাড়া ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নারীরা প্রায় ম্যালেরিয়া, টাইফয়েড, জন্ডিস, যক্ষ্মা, ক্যান্সার, ডায়রিয়া, চর্মরোগ, রক্তশূন্যতা, মাতৃত্বকালীন জটিলতা, প্রসবকালীন সম্যসা, নবজাতকের মৃত্যু, কৃমিরোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। 

দেশের উত্তরাঞ্চলের রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, গাইবান্ধা, নাটোর, জয়পুরহাট, বগুড়া, দিনাজপুর, রংপুর, পাবনা ও সিরাজগঞ্জ জেলায় সাওতাল সম্প্রদায়ের জনগোষ্ঠীর বসবাস। বৃৃহত্তর সিলেটে মূলত মনিপুরী, খাসিয়া, গারো, পাত্র বা পাতারা, ত্রিপুরা, হাজং ও গারো সম্প্রদায় সম্পর্কে বিঞ্চপ্রিয়া মনিপুরী ডক্টরস এসোসিয়েশনের সভাপতি ডা. পরেশ চন্দ্র সিংহ বলেন, শিক্ষা দীক্ষায় মনিপুরীরা এগিয়ে। শিক্ষা ও সচেতনতা বেড়েছে বলে, তারা উন্নত চিকিৎসা নিতে সবাই চেষ্টা করেন। ময়মনসিংহের গারো ও কোঁচ বাঙালিদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দীর্ঘদিন থেকে বসবাস করছে তারা। নগরায়নের যুগে দ্রুত পরিবর্তন ঘটেছে তাদের জীবনমান। প্রত্যন্ত অঞ্চলের পাহাড় টিলা কেন্দ্রিক তাদের বসবাস হলেও বর্তমান জীবনমান পাল্টে গেছে। তবে পাহাড়ি জনপদ পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতি, বর্ণ, গোত্রের নৃগোষ্ঠী নারীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, তারা সুবিধাবঞ্চিত, চিকিৎসাবঞ্চিত এমনকি মৌলিক অধিকারবঞ্চিত। অবহেলিত এ নারী সমাজকে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন প্রতিকুল পরিবেশের সাথে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকতে হয়। এদের চিকিৎসা সেবা প্রদানে সরকারি তেমন কোন উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ চোখে পড়ে না। 

ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী নারীরা ঘরে ও বাইরে খেটে চলে উদয়াস্ত। একদিকে স্বামীর সাথে ফসলের মাঠে অন্যদিকে ঘরে প্রেমময়ী স্ত্রী ও স্নেহময়ী মা হিসেবে সমানভাবে ভূমিকা রাখেন। এ নারী একজন সক্রিয় উপার্জনকারী। সন্তান জন্ম দেয়া থেকে শুরু করে লালন পালন করা ও ঘর-গৃহস্থালির যাবতীয় কাজ এক হাতেই সমাধান করতে হয় তাকে। দেশের প্রতিটি মানুষের মতো তারও রয়েছে স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির অধিকার। নারী হওয়ার সুবাদে কতিপয় স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। যেমন- প্রজনন ও মাতৃত্বকালীন স্বাস্থ্যসেবা। এটি নারী জীবনের খুবই স্পর্শকাতর সময়। একটি গুরুত্বপূর্ণ অধিকারও। রাষ্ট্রীয় পরিমণ্ডলে এমনিতেই নারীর অবস্থান প্রান্তিক। নৃগোষ্ঠী নারীর অবস্থান আরও প্রান্তিক। আর তাই তার অবস্থান বড় বেশি নাজুক। সাধারণ বিচারে নৃগোষ্ঠী নারী হিসেবে সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে তার যে নির্ধারিত অবস্থান সেই অবস্থান সমাজে বিদ্যমান পারিপার্শ্বিকতার প্রেক্ষিতে আর দশটি মূল ধারার নারীর অবস্থান থেকে অনেক নিচে। কিংবা সুযোগ-সুবিধা একেবারেই অনুপস্থিত। পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত এলাকাগুলোতে, এমনকি  উপজেলা পর্যায়েও এটি একটি চলমান বাস্তবতা। স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা, কিংবা স্বাস্থ্য সেবার অপ্রতুলতার কারণে নৃগোষ্ঠী নারীর স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির সুযোগ সংকুচিত। অধিকার ক্ষুণ্ন করা একটি সাংবিধানিক অপরাধ। স্বাস্থ্য অধিকার থেকে বঞ্চনার ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামে নৃগোষ্ঠী নারীদের মধ্যে রক্তশূন্যতার ব্যাপকতা, প্রজনন সমস্যা, শিশু মৃত্যুর হার রীতিমতো অস্বাভাবিক। উষ্ণায়ন ও জলবায়ুর পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের জন্য হুমকির পাশাপাশি রোগ-বালাই, অসুখ-বিসুখ বৃদ্ধির প্রবণতা কিন্তু অনেক বেশি দৃশ্যমান। পরিবারে ও সমাজে উপেক্ষিত, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেবা থেকে বঞ্চিত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী  নারীরা বিভিন্ন রোগ-ব্যাধির সহজ শিকার। যুগ যুগ ধরে এ গোষ্ঠীর নারীরা শ্রমে ঘামে পরিবার পরিজনকে আগলে রাখলেও তাদের নিজের সুস্থ স্বাভাবিক জীবন আজো নিশ্চিত হয়নি।

রাজধানীর বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হসপিটালের অধ্যাপক ডা. জি. এম. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাস করা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী নারীরা অবহেলিত। উপযুক্ত স্বাস্থ্য সেবা না পেয়ে তারা বিভিন্ন রোগ-শোকে ভোগেন। উপজেলা শহরের কাছাকাছি যারা বসবাস করেন তারা সরকারি স্বাস্থ্যসেবা পেয়ে থাকেন। কিন্তু যারা নিতান্তই প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাস করে তাদের কাছে এনজিও স্বাস্থ্য কর্মীরাও যেতে পারে না। তাই দেশে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী নারীরা স্বাস্থ্য সমস্যা ও রোগ-ব্যাধি নিয়েই জীবনযাপন করেন।

ওই চিকিৎসক আরো বলেন, স্বাস্থ্য সমস্যা ও রোগ-ব্যাধির বিবিধ কারণ রয়েছে, তার মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য হলো- পরিবারে শিক্ষা ও সচেতনতার অভাব, সমাজে স্বাস্থ্যশিক্ষার অভাব, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস, ঋতুস্রাবকালীন অপরিষ্কার থাকা, পুষ্টি জ্ঞানের অভাব, অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে রান্না-বান্না ও খাওয়া-দাওয়া, ধূমপান ও মাদক সেবন, প্রাচীন রীতিনীতি ও কুসংস্কার, মদ্যপান, খাবার তালিকায় সুষম খাদ্যের অনুপস্থিতি, কাঁচা বন্যপ্রাণী ভক্ষণসহ বিভিন্ন অনিয়ম ও উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপনের জন্য তারা স্বাস্থ্য সমস্যা ও রোগ-ব্যাধিতে ভোগেন।

খাগড়াছড়ি সদর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কেন্দ্রের এক চিকিৎসক বলেন, শিক্ষা ও সচেতনতার বিকল্প নেই। নিজেকে সুস্থ ও সুন্দর রাখতে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী নারীদের গণশিক্ষা ও স্বাস্থ্যশিক্ষা নিতে হবে। আরো যা যা করতে হবে- নিজেকে, পরিবারকে ও চারপাশের পরিবেশকে পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে, যথাযথ স্বাস্থ্য ও পুষ্টি সচেতন হতে হবে, ভুল নিয়ম-নীতি ও কুসংস্কার ত্যাগ করতে হবে, খাবার আগে ভাল করে হাত ধুতে হবে, স্যানিটেশন টয়লেট ব্যবহার করতে হবে, খাবারঘর ও রান্নাঘর নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে, ধূমপান, মাদকসহ সকল প্রকার নেশা ত্যাগ করতে হবে, ফলমূল খাওয়ার আগে ধুয়ে নিতে হবে, বন্য পশু-পাখি ও কাঁচা তরকারি ভালভাবে রান্না করে খেতে হবে, ঋতুস্রাবকালীন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে, বিশেষ করে মাতৃত্বকালীন পাঁচবার বডি-চেকাআপ করাতে হবে এবং ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী চলতে হবে, শিশুদের সময়মতো টিকা নিতে হবে, এনজিও স্বাস্থ্য কর্মীর সাথে নিয়মিতভাবে যোগাযোগ রাখতে হবে, কোন প্রকার রোগ-ব্যধি কিংবা স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দিলে ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে।