শিরোনাম

বরুন কুমার দাশ ও আব্দুর রউফ
ঢাকা, ২২ ডিসেম্বর, ২০২৫ (বাসস) : দেশের চিকিৎসা বিজ্ঞানে এক যুগান্তকারী অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে।
পক্ষাঘাতগ্রস্ত, দীর্ঘমেয়াদি স্নায়বিক রোগে আক্রান্ত ও হাড় ও জোড়ার বিভিন্ন জটিল রোগীদের পুনর্বাসনে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো চালু হয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ভিত্তিক রোবটিক রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টার।
ইতোমধ্যে প্রতিদিন ৩০ থেকে ৩৫ জন রোগী এখানে চিকিৎসাসেবা পাচ্ছেন।
চীন সরকারের কারিগরি ও আর্থিক সহায়তায় বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএমইউ) সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালে এই অত্যাধুনিক সেন্টারটি স্থাপন করা হয়েছে।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আহতরা এখানে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে বিশ্বের সর্বাধুনিক রোবটিক চিকিৎসা সেবা পাচ্ছেন।
সেন্টারের কার্যক্রম সম্পর্কে বিএমইউ’র ফিজিক্যাল মেডিসিন ও রিহ্যাবিলিটেশন বিভাগের চেয়ারম্যান ও রোবোটিক রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টারের ফোকাল পারসন অধ্যাপক ডা. এম এ শাকুর জানান, সেন্টারটিতে মোট ৬২টি যন্ত্র স্থাপন করা হয়েছে। এর মধ্যে ৫৭টি রোবট এবং পাঁচটি ফিজিক্যাল থেরাপি ট্রেনিং বেড রয়েছে।

৫৭টি রোবটের মধ্যে ২২টি সম্পূর্ণ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন বা এআই প্রযুক্তিনির্ভর। এসব রোবট ‘নিউরোপ্লাস্টিসিটি’ অর্থাৎ মস্তিষ্কের ক্ষতিগ্রস্ত স্নায়ু পুনর্গঠনের প্রক্রিয়ায় সহায়তা করে, যা প্রচলিত ফিজিওথেরাপির তুলনায় অনেক বেশি কার্যকর।
তিনি জানান, স্ট্রোক বা স্পাইনাল কর্ড ইনজুরিতে আক্রান্ত রোগীদের স্বাভাবিক হাঁটার ক্ষমতা ফিরিয়ে আনতে সেন্টারে রয়েছে ‘জিপু এআই-১ ও ৯’ (ZEPU AI1 & 9), যেগুলো গেইট ট্রেনিং রোবট হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
হাত ও পায়ের কার্যক্ষমতা নিখুঁতভাবে ফিরিয়ে আনতে এবং ফিডব্যাক দিতে ব্যবহার করা হবে ‘জিপু এআই-২’ (ZEPU AI2) ও ‘জিপু এআই-৩’3Õ (ZEPU AI3)।
এ ছাড়া রয়েছে মাল্টি জয়েন্ট কনস্ট্যান্ট স্পিড ট্রেনিং সিস্টেম ‘জিপু এআই-৪’ (ZEPU AI4)-সহ আরও উন্নত রোবটিক প্রযুক্তি, যা রোগীদের অত্যন্ত নিখুঁত ও স্বাভাবিক ভঙ্গিতে হাঁটার অনুশীলন করায়। প্রচলিত চিকিৎসার বিপরীতে এসব রোবট দীর্ঘ রোগীকে সময় ধরে ক্লান্তিহীনভাবে থেরাপি দিতে সক্ষম।
জানা গেছে, এই প্রকল্পে চীন সরকার প্রায় ২৫ কোটি টাকা মূল্যের রোবটিক যন্ত্রপাতি অনুদান দিয়েছে।
প্রযুক্তিগত দিক থেকে এটি দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম আধুনিক রোবটিক রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টার হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে, যা বাংলাদেশের চিকিৎসা খাতে একটি যুগান্তকারী মাইলফলক। এসব রোবটের মাধ্যমে রোগীর অবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে অত্যন্ত নিখুঁতভাবে ফিজিওথেরাপি, স্নায়ুবিক পুনর্বাসন এবং দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসাসেবা দেওয়া সম্ভব হবে।
বিএমইউ কর্তৃপক্ষ জানায়, সেন্টারটি চালুর প্রস্তুতি হিসেবে চীনের সাত সদস্যের বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারদের একটি বিশেষজ্ঞ দলের তত্ত্বাবধানে ইতোমধ্যে ২৯ জন চিকিৎসক ও ফিজিওথেরাপিস্টকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জনবল পর্যাপ্ত অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা অর্জন করলে এবং প্রয়োজনীয় কার্যক্রম সফলভাবে সম্পন্ন হলে সেন্টারটি পুরোদমে চালু করা হবে।
এই সেন্টার থেকে স্ট্রোক, পক্ষাঘাত, স্নায়বিক বৈকল্য, দীর্ঘমেয়াদি ব্যথা, নার্ভ ইনজুরি, ফ্রোজেন শোল্ডার, দুর্ঘটনাজনিত জটিলতা এবং শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের দুর্বলতায় ভোগা রোগীরা উপকৃত হবেন।
সেন্টারটি চালুর মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রযুক্তিনির্ভর পুনর্বাসন চিকিৎসায় এক নতুন যুগে প্রবেশ করেছে।
সংশ্লিষ্টদের মতে, দেশীয় চিকিৎসাব্যবস্থার জন্য এটি শুধু একটি প্রযুক্তিগত অগ্রগতি নয়, বরং পক্ষাঘাতগ্রস্ত ও দীর্ঘমেয়াদি অসুস্থতায় ভোগা মানুষের জন্য নতুন আশার আলো।
এর আগে রোবোটিক রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টার উদ্বোধনকালে স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম বলেন, ‘এই কেন্দ্রটি শুধু রোগ নিরাময়ের জায়গা নয়, বরং বহু মানুষের স্বপ্ন বাস্তবায়নের কেন্দ্র। চীন সরকার এখানে প্রায় ২৫ কোটি টাকা সমমূল্যের রোবট অনুদান দিয়েছে। পাশাপাশি এগুলো পরিচালনার জন্য আমাদের চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।’
উপদেষ্টা জানান, জুলাই আন্দোলনে আহত ব্যক্তিরা, বিশেষ করে যাদের হাত-পায়ের রগ কেটে গেছে বা গুলিতে স্নায়ুবিক জটিলতা তৈরি হয়েছে, তারা এখানে অগ্রাধিকারভিত্তিতে বিনামূল্যে সেবা পাবেন।
এদিকে বাংলাদেশকে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি দেওয়ার পাশাপাশি বিএমইউ'র ২৭ জন স্টাফকে বিশেষ প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। তাছাড়া বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য চীনে চিকিৎসাসেবা সহজ করতে গ্রিন চ্যানেল চালু করেছে চীনা সরকার। এর ফলে বাংলাদেশিরা চীনে গিয়ে দ্রুততম সময়ে স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও রোগ নির্ণয়ের সুযোগ পাবেন।
বিএমইউ কর্তৃপক্ষ আরও জানায়, অভিজ্ঞ চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধানে সাধারণ রোগীরাও নামমাত্র মূল্যে এই আধুনিক সেবা নিতে পারবেন। এতে স্নায়ু, হাড় ও জোড়া রোগে আক্রান্ত এবং পক্ষাঘাতগ্রস্ত রোগীদের চিকিৎসার জন্য আর বিদেশে যেতে হবে না বলে তারা আশা প্রকাশ করেন।