শিরোনাম

ঝালকাঠি, ১৯ ডিসেম্বর, ২০২৫ (বাসস): ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক ও মুখপাত্র, আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-৮ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী শরীফ ওসমান বিন হাদির মৃত্যুর খবরে ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলা সদরের বাড়িতে চলছে শোকের মাতম। তার সহযোদ্ধা, প্রতিবেশী ও তার শুভাকাঙ্ক্ষীরা জানিয়েছে, হাদির মৃত্যু খবর প্রচারিত হওয়ার পর ঝালকাঠির নলছিটি পৌর শহরের খাসমহল এলাকা পরিণত হয়েছে শোক, ক্ষোভ ও আর্তনাদের শহরে।
বৃহস্পতিবার রাত থেকে শুক্রবার বিকেল পর্যন্ত হাজার মানুষ হাদির পৈতৃক বাড়িতে এসে আহাজারি করে। নলছিটির সাধারণ মানুষের মতে, ওসমান হাদির হত্যাকাণ্ড শুধু একটি রাজনৈতিক হত্যাই নয়, এটি একটি সময়, একটি চেতনা ও একটি সম্ভাবনাকে থামিয়ে দেয়ার চেষ্টা।
জানা যায়, হাদির বোন মাসুমা সুলতানা ও ভগ্নিপতি মাওলানা আমির হোসেন শুক্রবার দুপুরের দিকে ঢাকার উদ্দেশ্য রওয়ানা দেন। হাদির অনুসারী, এনসিপি, গণঅধিকার পরিষদ ও স্থানীয় ছাত্রদলের কিছু নেতা-কর্মীকে বৃহস্পতিবার রাতে ও শুক্রবার জুমার নামাজের পর ঝালকাঠি শহরের কলেজ মোড়ে খুলনা বরিশাল মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে দেখা যায়।
হাদির বাড়ির সামনে দাঁড়ালে চোখে পড়ে এক নিঃশব্দ সরু পথের পাশে একটি ছোট টিনের ঘর। যেখানে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন শরিফ ওসমান বিন হাদি। কোনো অট্টালিকা নয়, কোনো বিলাসিতা নয়। এই সাধারণ টিনের ঘর থেকেই উঠে এসেছিল এমন একজন মানুষ, যিনি রাজধানী ঢাকার রাজপথের শাহবাগসহ বিভিন্ন স্থানে দাঁড়িয়ে কথা বলেছিলেন বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী রাজনীতি এবং নতুন রাষ্ট্রচিন্তার পক্ষে। বাড়িতে আবেগ জড়িত কণ্ঠে এলাকাবাসীর বক্তব্য, বিপ্লবী বড় অট্টালিকা থেকে আসে না, ওসমান হাদি উঠে এসেছিল এই টিনের ঘর থেকেই।
হাদির মৃত্যু সংবাদ ছড়িয়ে পড়ার পরপরই নলছিটির খাসমহল এলাকায় বৃহস্পতিবার রাত থেকেই তার বাড়িতে ছুটে আসছেন আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী, সহপাঠী ও শুভানুধ্যায়ীরা। কান্না, আহাজারি আর নিস্তব্ধতায় পুরো এলাকা হয়ে ওঠে ভারী। অনেকেই বাকরুদ্ধ, কেউ কেউ আবার ক্ষোভে ফেটে পড়েন।
নিরাপত্তাজনিত কারণে হাদির পরিবারের সদস্যরা কারও সঙ্গে সাক্ষাৎ বা কথা বলেননি। পুলিশ জানিয়েছিল, পরিস্থিতির গুরুত্ব বিবেচনায় পরিবারটির সঙ্গে যোগাযোগ সীমিত রাখা হয়েছিল। খাসমহলের সরু গলির ভেতরে দাঁড়িয়ে থাকা হাদির টিনের ঘরটি এখন কেবল একটি বসতঘর নয়, এটি হয়ে উঠেছে একটি রাজনৈতিক স্থান।
শুক্রবার সকালে নলছিটির খাসমহল এলাকায় প্রতিবেশী ও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা একযোগে দাবি জানান, শরীফ ওসমান হাদির জীবনী জাতীয় পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে এবং তাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে ‘জাতীয় বীর’ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে।
নলছিটি প্রেসক্লাব সাধারণ সম্পাদক কে এম সবুজ বলেন, ওসমান হাদির জীবন নতুন প্রজন্মের জন্য একটি রাজনৈতিক পাঠ। তিনি শিখিয়েছেন, বিপ্লব মানে শুধু জীবন দেয়া নয়, বরং নিজেকে তৈরি করা, যোগ্য হওয়া এবং দীর্ঘ লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত থাকা। তাই তার জীবনী পাঠ্য পুস্তকে সংযুক্ত করতে হবে।
এদিকে হত্যাকারীদের দ্রুত গ্রেপ্তারের দাবিতে বৃহস্পতিবার (১৮ ডিসেম্বর) রাত সাড়ে ১১টা থেকে ঝালকাঠি শহরের কলেজ মোড় এলাকায় ঢাকা-ঝালকাঠি মহাসড়ক অবরোধ করে ব্লকেড কর্মসূচি পালন করেন জুলাই যোদ্ধা, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), গণ অধিকার পরিষদসহ বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মীরা।
ঝালকাঠি জেলা জামায়াতের আমির অ্যাডভোকেট হাফিজুর রহমান বলেন, ওসমান হাদির হত্যাকাণ্ড নিছক ব্যক্তিগত বা বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। ৫ আগস্টের পর গড়ে ওঠা নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতায় তিনি ছিলেন একটি বিকল্প কণ্ঠস্বর। ইনকিলাব মঞ্চ ও ইনকিলাব কালচারাল সেন্টারের মাধ্যমে তিনি সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনের সমন্বয় ঘটান, যা প্রচলিত সমাজ ও রাস্ট্র কাঠামোতে পরিবর্তন আনতে পারতো।
শরীফ ওসমান বিন হাদির জন্ম ১৯৯৩ সালে। তিনি নলছিটির মরহুম শরীফ মাওলানা আব্দুল হাদির ছেলে। তিন ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন কনিষ্ঠ। বড় ভাই ড. মাওলানা মুফতি আবু বক্কর ছিদ্দিক বরিশাল বাঘিয়া আল আমিন কামিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ ও গুঠিয়া জামে মসজিদের খতিব। মেজ ভাই ওমর ফারুক ঢাকায় একজন ব্যবসায়ী।
ঝালকাঠি ২ আসনে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী মনোনীত প্রার্থী শেখ নেয়ামুল করীম বলেন, হাদির রাজনীতি ছিল নৈতিকতার রাজনীতি, আপসহীন আদর্শের রাজনীতি। শরিফ ওসমান বিন হাদি আমাদের দেখিয়েছেন, রাজনীতি মানে শুধু ক্ষমতা নয়, রাজনীতি মানে নৈতিক সাহস ও সত্যের পক্ষে দাঁড়ানো।
জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) জেলা যুগ্ম সমন্বয়ক মুফতি মাসুম বিল্লাহ বলেন, হাদি এখন আর একজন মানুষের নাম নয়, তিনি লক্ষ কোটি মানুষের চেতনা।