শিরোনাম

॥ আল-আমিন শাহরিয়ার ॥
ভোলা, ১৬ ডিসেম্বর ২০২৫ (বাসস): ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে যে সাতজন বীর সন্তানের কথা জাতি আজো শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছে বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামাল তাদেরই একজন। স্বাধীনতা যুদ্ধ আর পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে বিজয়ের কেতন উড়ানোর যেসব কারিগর রয়েছেন, ইতিহাসের পৃষ্ঠা ঘাটলে দেখা যায়, বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামাল তাদের মধ্যে অন্যতম। দেশমাতৃকা রক্ষায় তার অনবদ্য সংগ্রাম আর যুদ্ধ বিজয়ের ত্যাগকে এখনো স্মরণ করছে দেশ, মনে রেখেছেন ভোলাবাসী।
ভোলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পাঠে জানা যায়, বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ সিপাহী মোহাম্মদ মোস্তফার জন্ম ১৯৪৯ সালে ভোলার দৌলতখান থানার পশ্চিম হাজীপুর গ্রামে। বাবার নাম হাবিলদার হাফিজ। পারিবারিক বাধার কারণে ১৯৬৭ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে যোগদেন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। প্রশিক্ষণ শেষে তাকে নিয়োগ করা হয় ৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট কুমিল্লায়।
১৯৭০ সালে তিনি বিয়ে করেন ১৬ বছরের কিশোরী পেয়ারা বেগমকে। তিনি যখন মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেন তখন পেয়ারা বেগম ছিলেন অন্তঃস্বত্ত্বা। মোহাম্মদ মোস্তফা স্ত্রীকে বলেছিলেন তার অনুপস্থিতিতে যদি ছেলে হয় নাম 'বাচ্চু' আর মেয়ে হলে নাম 'টুনি' রাখতে।
১৯৭১ সালের উত্তাল রাজনৈতিক পরিবেশে পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ ৪ ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে অভ্যন্তরীণ গোলোযোগ নিয়ন্ত্রণের অজুহাতে সিলেট ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মোতায়েন করে। ভালো বক্সার হিসাবে রেজিমেন্টে তার সুনাম ছিলো। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর কয়েকদিন পূর্বে বক্সার হিসাবে সিপাহি মোহাম্মদ মোস্তফা অবৈতনিক ল্যান্স নায়েক হিসাবে পদোন্নতি পান।
এরই মধ্যে পাকিস্তানি চক্রান্ত বুঝতে পেরে কয়েক জন বাঙালি সৈনিককে সঙ্গে নিয়ে মেজর শাফায়াত জামিল, অধিনায়ক লে. কর্নেল খিজির হায়াত খানসহ সকল পাকিস্তানি অফিসার ও সেনাদের গ্রেফতার করেন। এরপর তারা মেজর খালেদ মোশারফের নেতৃত্বে আশুগঞ্জ, উজানিস্বর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এন্ডারসন খালের পাশ দিয়ে প্রতিরক্ষা অবস্থান নেন।
১৪ এপ্রিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হেলিকপ্টার গানশীপ, নেভাল গানবোট ও এফ-৮৬ বিমান যোগে ত্রিমুখী আক্রমণ চালায় মুক্তিবাহিনীর ৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রতিরক্ষা অবস্থানের উপর। গঙ্গাসাগর প্রতিরক্ষা অবস্থানের দরুইন গ্রামে নিয়োজিত আলফা কোম্পানির ২নং প্লাটুনের একজন সেকশন কমান্ডার ছিলেন মোহাম্মদ মোস্তফা। পাকিস্তানি আক্রমণে প্লাটুনটির সমস্ত রেশন ধ্বংস হয়ে যায়। এতে দীর্ঘ সময় ধরে অভুক্ত অবস্থায় ছিলেন। এমন অবস্থায় মোহাম্মদ মোস্তফা তার এল. এম. জি. সাথে নিয়ে আখাওড়া রেল ষ্টেশনে মেজর শাফায়াত জামিলকে রেশনের অনুরোধ করলে মেজর শাফায়াত জামিল তাদেরকে রেশনের বন্দোবস্ত করে দেন।
১৭ এপ্রিল সকাল থেকে বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী তীব্র গোলাবর্ষণ শুরু করে প্লাটুন পজিশনের উপরে। প্রচন্ড আক্রমণের খবর পেয়ে মেজর শাফায়াত হাবিলদার মুনিরের নেতৃত্বে ডি কোম্পানির ১১ নম্বর প্লাটুন পাঠান অবস্থানকে আরো শক্তিশালী করতে। ১৮ এপ্রিল সকালে বর্ষণমুখর পরিস্থিতিতে শত্রু দরুইল গ্রামের কাছে পৌঁছে দুপুর ১২ টায় অবস্থানের পশ্চিম দিক থেকে মূল আক্রমণ শুরু করে।
মোস্তফার ক্রমাগত নিখুঁত ফায়ারে পাকিস্তানিদের প্রায় ২০-২৫ জন হতাহত হন এবং তাদের সম্মুখ গতি মন্থর হয়ে পড়ে। এর এক পর্যায়ে মোস্তফার এল.এম.জি.-র গুলি নিঃশেষ হয় এবং তিনি মারত্মক ভাবে জখম হন। তখন পাকিস্তান বাহিনীর সৈনিকরা এসে তাকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সরকার তাঁকে মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বসূচক খেতাব ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ দিয়ে সম্মান জানায়।
দরুইল গ্রামের আপামর জনগণ অতি সম্মান ও আন্তরিকতার সাথে তাকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ায় শাহাদাত বরণকারী স্থানের পাশেই সমাহিত করেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের দলিলপত্র, দ্বিতীয়, দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ খণ্ড; বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর এক, দুই এবং সেক্টর আট এর ইতিহাস থেকে বীর শ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামালের বিরত্ত্বগাঁথা যুদ্ধজীবনের চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে।
এসব তথ্য জানা গেছে, মেজর খালেদ মোশাররফের (পরে বীর উত্তম ও মেজর জেনারেল) নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট আশুগঞ্জ, উজানিসর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অ্যান্ডারসন খালের পাশে প্রতিরক্ষা অবস্থান নিয়েছিলেন। ১৪ এপ্রিল স্থল, বিমান ও নৌ—তিন পথেই পাকিস্তানি বাহিনী তাদের ওপর প্রচণ্ড হামলা চালায়। মোস্তফা কামাল ছিলেন গঙ্গাসাগর প্রতিরক্ষা অবস্থানের দরুইন গ্রামে আলফা কোম্পানির ২ নম্বর প্লাটুনের একজন সেকশন কমান্ডার। ১৭ এপ্রিল সকাল থেকে মোস্তফা কামালদের অবস্থানের ওপরও তীব্র গোলাবর্ষণ শুরু হয়। প্রচণ্ড আক্রমণ সামাল দিতে শাফায়াত জামিল সেখানে ডি কোম্পানির ১১ নম্বর প্লাটুন পাঠান।
পরদিন সকালে পাকিস্তানি সেনারা দরুইন গ্রামের কাছে পৌঁছায়। এদিন মোস্তফা কামালের হাতে অনেক পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়। একপর্যায়ে মোস্তফা কামালের গুলি নিঃশেষ হয়ে যায়। তিনি মারাত্মকভাবে আহত হন। পাকিস্তানি সেনারা তাঁকে বাংকারে এনে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে।
এ বিষয়ে বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামালের ছোটভাই মরহুম মোস্তাফিজুর রহমানের ছেলে মো. সেলিমের সাথে কথা হয়। তিনি বাসসকে বলেন, আমার দাদী ও বাবা যতদিন বেঁচেছিলেন-ততোদিন আমরা রাষ্ট্রীয়ভাবে পেয়েছি।
তিনি জানান, জেলা সদর ভোলার আলীনগর ইউনিয়নের সাহেবের কাঁচারী নামক এলাকায় মোস্তফা কামালের বাড়ি অবস্থিত। সেখানে তার মা মালেকা বেগম ও ছেলে মোশারেফ হোসেন বসবাস করতেন। মোস্তফা কামালের মা ও ছেলে দু'জনেই মারা গেলে বীর শ্রেষ্ঠের স্মৃতি লালন করে আসছেন-একমাত্র ভাতিজা মো. সেলিম।
তথ্য অনুযায়ী, ২০০৫ সালে ভোলার আলীনগরের সাহেবের কাচারী নামক এলাকায় বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামালের নামে তৎকালীন সরকার একটি যাদুঘর ও গ্রন্থাগার নির্মাণ করেন। পাশাপাশি বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামালের স্মৃতি ধরে রাখতে ওই এলাকাটিকে "মোস্তফা নগর" হিসেবে ঘোষণা করা হয়। অথচ, যাদুঘর ও গ্রন্থাগার বাস্তবায়ন হলেও ‘মোস্তফা নগরটি’ এখনো কাগজ-কলমেই বন্দী হয়ে আছে।
ভোলার জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সদস্য সচীব বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহফুজুর রহমান বাসসকে জানান, বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ সিপাহী মোস্তফা কামাল ভোলা তথা দেশের গর্বিত সূর্য সন্তান। ভোলাতে হলেও তার স্মৃতি সংরক্ষণ করা উচিত।
জেলা কমিটির অপর সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল হোসেন মিয়া বলেন, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ঐতিহ্য ও বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ মোস্তফা কামালের মুক্তি সংগ্রামের বীরত্বগাথা কর্মযজ্ঞের নানা দিক নতুন প্রজম্মকে জানাতে রাষ্ট্রীয়ভাবে কার্যকর ভূমিকা সরকারকেই নিতে হবে।
এদিকে আজ ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস উপলক্ষ্যে ভোলার জেলা প্রশাসকের হলরুমে মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বয়ে আলোচনা সভা ও মুক্তিযুদ্ধে বীর শহীদদের স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামালের ভাতিজা অধ্যক্ষ মো. সেলিমকে আমন্ত্রণ জানানো হয়।
জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ আহব্বায়ক ও জেলা প্রশাসক ডা. শামীম রহমান বলেন, সরকার সবকালেই মুক্তিযোদ্ধাদের বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করছে।