বাসস
  ০৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৭:৩৮

নলেন গুড়ের ঐতিহ্য ধরে রাখতে প্রয়োজন সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা

নলেন গুড় তার মৌ মৌ ঘ্রাণের জন্য বেশ জনপ্রিয়। ছবি : বাসস

।। শাহজাহান নবীন।।

ঝিনাইদহ, ৭ ডিসেম্বর ২০২৫ (বাসস): অগ্রহায়ণ শেষ হতে না হতেই বাড়তে শুরু করেছে শীত। শীতের তীব্রতার সাথে ঝিনাইদহের গ্রামে গ্রামে খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন চাষিরা। সেই রস থেকেই তৈরি হচ্ছে খেজুরের গুড়। যা ‘নলেন গুড়’ নামে খ্যাত।

স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, মৌসুমের শুরুতে খেজুরগাছ চেঁছে নলি পোঁতা হয়। নলি পোঁতার পর প্রথমবার সংগ্রহ করা রস থেকে তৈরি গুড়কে ‘নলেন গুড়’ বলে। তবে বাস্তবে গাছ কাটার পর প্রথম দুই থেকে তিন সপ্তাহ পর্যন্ত রসের এই বিশেষ ঘ্রাণ থাকে। তাই এসময়টায় খেজুর রস সংগ্রহ করে নলেন গুড় তৈরি করা হয়। নলেন গুড়, ঘ্রাণ, রং ও স্বাদে অনন্য। তাই এ কারণে সারাদেশে এই গুড়ের চাহিদাও বেশি।                  

জেলার বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, ঘন কুয়াশায় মোড়ানো ভোরে গাছিরা খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করেন। 

হিমেল বাতাস ও মাঝারি শীত উপেক্ষা করে গাছিদের রস সংগ্রহের কর্মযজ্ঞ নিত্যদিনের। আড়মোড়া ভাঙা ভোরের আলো ফোটার আগেই কাঁধে বাক্ (বাঁশের তৈরি) নিয়ে মাঠের পানে ছুটে চলেন গাছিরা। গাছ থেকে রস সংগ্রহ করে মাটির হাঁড়ি ভরে বাঁকে ঝুলিয়ে বাড়িতে ফেরেন। সেই রস বড় বড় পাত্রে ঢেলে জ্বাল দেওয়া হয়। এসময় বাড়িতে বাড়িতে গৃহবধূরা রস জ্বালানোর কাজে ব্যস্ত হয়ে পরেন। এভাবেই তাদের শীতকালের প্রতিটি দিন শুরু হয়।  

দীর্ঘ সময় ধরে জ্বালানোর পরে টলমলে খেজুর রস ধীরে ধীরে মিষ্টি লাল খয়েরি রং ধারণ করে নলেন গুড়ে পরিণত হয়। মৌসুমের শুরুতে রস থেকে তৈরি হওয়া এসব গুড় ঝিনাইদহ-যশোর অঞ্চলে নলেন গুড় নামে পরিচিত। এই গুড় সুঘ্রাণ, গুণাগুন ও স্বাদের কারণেই জনপ্রিয়।

জেলার সদর উপজেলার গাছি খলিলুর রহমান বাসসকে বলেন, ‘শীত মৌসুমের শুরু থেকে প্রথম দুই থেকে তিন সপ্তাহ  খেজুর গাছ থেকে যে রস সংগ্রহ করা হয়, তার ঘ্রাণ ভিন্ন। এই রস থেকে নলেন গুড় বানানো হয়। 

নলেন গুড়ের চাহিদা বেশি। এটা খেতেও সুস্বাদু। নলেন গুড় তার মৌ মৌ ঘ্রাণের জন্য বেশি জনপ্রিয়।’

গৃহবধূ নাজেরা খাতুন বলেন, ‘বাড়িতে রস জ্বালানোর কাজটা নারীরাই করে। পুরুষরাও সহযোগিতা করে। গুড় তৈরি করা বেশ কষ্টের কাজ। তবে বছরের এই মৌসুমে গুড় তৈরি করতে পারলে সারা বছর সেই গুড় দিয়েই আমরা পিঠা পায়েস করি। বাড়তি চিনি বা মিষ্টি কেনা লাগে না। চাষি গৃহস্থ পরিবারগুলোতে খেজুর গুড় এখনো ঐতিহ্যবাহী খাবার।’

গাছি জাকির হোসেন বলেন, এখন খেজুর গাছ কমে যাচ্ছে। ইট ভাটার জ্বালানি জোগান দিতে গিয়ে অনেকেই খেজুর গাছ কেটে বিক্রি করে দিয়েছে। এছাড়া গাছির সংখ্যাও কমছে।

মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ীদের কারণে গাছিরা খেজুর গুড়ের ন্যায্য দাম পায় না। যে কারণে দিন দিন রস সংগ্রহ ও গুড় তৈরির পরিমাণ কমছে। তিনি খেজুর গুড়ের ঐতিহ্য বজায় রাখতে সরকারের বিশেষ উদ্যোগ কামনা করেন ।

ঝিনাইদহের প্রবীণ সমাজসেবক ও সচেতন নাগরিক প্রতিনিধি এম. রায়হান বাসসকে বলেন, ‘কনকনে শীতেও খেজুর গাছে উঠে তাদের রস নামানোর মতো কঠিন কাজ করতে হয়।

গাছিদের পরম মেহনতের ফলে আমরা খেজুর রস ও গুড় খেতে পারি। কিন্তু গাছিদের জীবনমানের উন্নয়নে কখনোই সরকারি বা বেসরকারি কোনো উদ্যোগ নেয়া হয় না।’

তিনি বলেন, ঝিনাইদহ-যশোর-চুয়াডাঙ্গা অঞ্চলে গাছিরা এখন নলেন গুড় তৈরিতে ব্যস্ত। ফড়িয়া ও মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করা গেলে গাছিরা গুড়ের ন্যায্য দাম পাবে। এতে গাছিদের মুখেও হাসি ফুটবে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. কামরুজ্জামান বাসসকে বলেন, প্রতি বছর ঝিনাইদহ জেলায় প্রায় ৭২ মেট্রিক টন খেজুর গুড় উৎপাদন হয়। এ বছরও গুড় উৎপাদন ভালো হবে। নিরাপদ রস ও গুড় উৎপাদনে গাছিদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। বাজারে গুড়ের দামও ভালো। নলেন গুড়ের চাহিদা বেশি, জোগান কম। যে কারণে নলেন গুড়ের দাম ভালো পাচ্ছেন গাছিরা।