বাসস
  ০১ অক্টোবর ২০২৫, ১৩:১৮

ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় বাড়ছে নারীর অংশগ্রহণ : সাহস, প্রতিভা ও দায়িত্ববোধের অনন্য সাক্ষর

প্রতীকী ছবি

ঢাকা, ১ অক্টোবর, ২০২৫ (বাসস) : একসময় যাকে বলা হতো ‘অন্তঃপুরবাসিনী’, সেই নারীই এখন হয়ে উঠছেন রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বের কাণ্ডারী। বাংলাদেশের নারীরা আজ শুধু গৃহিণী বা সংসারের সীমাবদ্ধতায় আটকে নেই। সমাজে নারীর ভূমিকার রূপান্তর কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়, এটি সময়ের পরিপক্বতায় অর্জিত এক সংগ্রামী পথচলা। আজ বাংলাদেশের প্রতিটি অগ্রগতির দৃশ্যে নারী অবিচ্ছেদ্য অংশ। প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে রয়েছে নারীর অবদান। তারা শুধু ঘরের দেয়ালে সীমাবদ্ধ নয়, বরং চ্যালেঞ্জিং, ঝুঁকিপূর্ণ ও শারীরিকভাবে ফবসধহফরহম পেশাগুলোতেও সমানতালে অংশ নিচ্ছেন। তারা পুরুষের সঙ্গে সমানভাবে দায়িত্ব পালন করছেন। কখনো সেনাবাহিনীর ক্যাডেট, কখনো পুলিশ অফিসার, সাংবাদিক, নিরাপত্তাকর্মী, আবার কখনো ট্রেন, বিমান বা জাহাজ চালক। একই সঙ্গে উপজেলা প্রশাসন থেকে শুরু করে উচ্চপদস্থ প্রতিটি দপ্তরেও রয়েছে নারীর সরব পদচারণা। নারীর এমন সাহসী অভিযাত্রা আজ কেবল অগ্রগতি নয়, বরং হয়ে উঠেছে এক অনুপ্রেরণার প্রতীক।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ক্যাডেট অফিসার ফাহিমা বিন রনি (ছদ্মনাম) ছিলেন একজন সাহসী উদাহরণ। কয়েক বছর আগে আফ্রিকার একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকায় শান্তিরক্ষা মিশনে অংশ নেওয়ার প্রস্তাব পান তিনি। পরিবারের আপত্তি ছিল প্রবল। যুদ্ধের ভয়াবহতা, অনিশ্চয়তা এবং প্রাণহানির আশঙ্কা পরিবারের মনে ভয় জন্মায়। কিন্তু ফাহিমা নিজের সিদ্ধান্তে অনড় থাকেন। অনেক বুঝিয়ে, যুক্তি দিয়ে রাজি করান পরিবারের সবাইকে। এরপর পাড়ি জমান দূর আফ্রিকায়, পেশাগত দায়িত্বের টানে। সফলভাবে মিশন শেষ করে বিজয়ীর বেশে ফিরে আসেন দেশের মাটিতে। এই গল্প কেবল একজন নারী সেনা কর্মকর্তার সাহসের দলিল নয়, এটি পরিবর্তিত বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি।

এমনই আরেক সাহসী নারীর নাম লাবন্য মাহমুদ। তিনি একজন পেশাদার সাংবাদিক। সাংবাদিকতা এমন একটি পেশা, যেখানে মুহূর্তেই বদলে যেতে পারে পরিস্থিতি। সংবাদ সংগ্রহের জন্য তাকে ছুটতে হয় হরতাল, আন্দোলন, সংঘর্ষ, দুর্ঘটনা কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগের স্থানে। সাথে সামলাতে হয় ঘর, স্বামী ও সন্তানদেরও। লাবন্য বলেন, ‘আমি ছেলে-মেয়ে আলাদা করে দেখি না। ছেলেরা পারলে আমি কেন পারবো না? আমি অন্য দশজন পুরুষ সাংবাদিকের মতোই এ পেশায় কাজ করি। পেশায় চ্যালেঞ্জ  বা ঝুঁকি থাকবেই। তাই বলে ঘরে বসে থাকবো? বিবেক বিবেচনা শিক্ষা, দক্ষতা ও কৌশলী হলে এ পেশায় সফল হওয়া কঠিন নয়। তার এই মনোভাবই প্রমাণ করে, নারী কেবল দায়িত্ব নিতে জানে না, বরং তা সফলভাবে পালন করতেও জানে।

বর্তমানে সাংবাদিকতা পেশাটি সারা বিশ্বেই ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, সংবাদকর্মীরা হুমকি, নিপীড়ন, এমনকি প্রাণনাশের মতো পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছেন।

বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। তথাপি, এ পেশায় নারীর অংশগ্রহণ বেড়েই চলেছে। নারী সাংবাদিকরা শুধু দৈনন্দিন সংবাদ কাভারেজে নন, গবেষণা, অনুসন্ধান, যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলে রিপোর্টিং, মানবাধিকার কিংবা অপরাধ প্রতিবেদনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন। তবে জনপ্রিয় টিভি সাংবাদিক শাহনাজ মুন্নী আফসোস করে বলেন, টেলিভিশন সাংবাদিকতায় এখনও নারীর অংশগ্রহণ আশানুরূপ নয়। তিনি মনে করেন, এই পেশায় নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব।

নারীর অগ্রযাত্রার অন্যতম ক্ষেত্র পুলিশ বাহিনী। নারীরা আজ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় দক্ষতা, দায়িত্ববোধ ও সাহসিকতার অনন্য নজির স্থাপন করছেন। সীমান্তে বহিঃশত্রুর আক্রমণ প্রতিরোধে তারা অস্ত্র হাতে পাহারা দিচ্ছেন, যেখানে আগে কেবল পুরুষদের দেখা যেত। বন্দর দিয়ে আমদানি-রপ্তানি পণ্যের রেজিস্ট্রেশন, চেকপোস্টে পাসপোর্ট, যাত্রীদের তথ্য যাচাই এবং ব্যাগেজ তল্লাশির মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বেও নারীরা সমানতালে কাজ করছেন।

নারী চোরাচালানকারী কিংবা নারী অপরাধী শনাক্ত ও গ্রেফতারে নারী পুলিশ সদস্যদের ভূমিকা অপরিসীম। দিন-রাত রাষ্ট্রের নিরাপত্তায় তারা কাজ করছেন পুলিশ অফিসার হিসেবে, এবং এ সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। এটি শুধুমাত্র একটি সংখ্যাগত অগ্রগতি নয়, বরং জাতীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থায় নারীর দক্ষতা ও নির্ভরযোগ্যতার প্রমাণ।

বর্তমানে অপারেশনাল দায়িত্ব ছাড়াও পুলিশের প্রায় সব ইউনিটেই নারী সদস্যরা কর্মরত রয়েছেন। অনেক শিক্ষিত ও প্রশিক্ষিত নারী এখন এই চ্যালেঞ্জিং পেশায় যুক্ত হচ্ছেন এবং সফলতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন।

স্বাধীন বাংলাদেশের শুরুর দিকে পুলিশে কোনো নারী সদস্য ছিল না। ১৯৭৪ সালে প্রথমবারের মতো পুলিশ বাহিনীতে ১৪ জন নারী সদস্য নিয়োগ পান। আজ বাংলাদেশ পুলিশে ১৫ হাজারেরও বেশি নারী সদস্য কাজ করছেন, যা মোট জনবলের ৭.৯ শতাংশ। নারী পুলিশ সদস্যরা কনস্টেবল থেকে শুরু করে সহকারী পুলিশ সুপার, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, পুলিশ সুপার, এমনকি ডিআইজি পদেও দায়িত্ব পালন করছেন। বর্তমানে নারী ডিআইজি রয়েছেন ২ জন, অ্যাডিশনাল ডিআইজি ৩ জন, পুলিশ সুপার ৭১ জন, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রয়েছেন ১০৯ জন ও সহকারী পুলিশ সুপার রয়েছেন ১০০ জন। এ ছাড়া নারী ইন্সপেক্টর রয়েছেন ১০৯, এসআই ৭৯৭, সার্জেন্ট ৫৮, এএসআই ১ হাজার ১০৯, নায়েক ২১১ এবং কনস্টেবল ১২ হাজার ৫৯৪ জন।

পুলিশে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ানোর চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছেন পুলিশের আইজিপি। তিনি বলেন, ‘২০১৫ সালের মধ্যে নারী পুলিশ পুরো বাহিনীর ১৫ শতাংশে পৌঁছানোর লক্ষ্য ছিল। ছয় বছর পর ২০২১ সালে এসে পুলিশ বাহিনীতে নারী পুলিশের সংখ্যা এখন লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেক (৭.৯ শতাংশ)।’ পুলিশ বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটে নারী সদস্যরা দায়িত্ব পালন করলেও আগে ট্রাফিক সার্জেন্ট পদে নারী সদস্যদের কাজ করতে দেখা যায়নি। ২০১৭ সালে প্রথমবার ২৮ জন নারী সার্জেন্ট ঢাকার রাজপথে দায়িত্ব পালন শুরু করেন। নারী সদস্যদের জন্য থানাগুলোতে আলাদা ডেস্ক খোলা হয়েছে, যাতে নারী ভুক্তভোগীরা সহজে ও নিরাপদে অভিযোগ জানাতে পারেন। পুলিশের বিশেষ শাখায় কর্মরত উপ-পরিদর্শক সাফিয়া আফরোজ জানান, নারী হিসেবে তিনি কোনো বাড়তি প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়েননি। বরং সহকর্মীদের সহযোগিতা পেয়েছেন।

নারীর অংশগ্রহণে নিরাপত্তা খাতেও এসেছে বৈচিত্র্য। ব্যাংক, শপিংমল, রেস্টুরেন্ট, পোশাক কারখানা, মাল্টিন্যাশনাল অফিসে নারী নিরাপত্তাকর্মীদের উপস্থিতি বাড়ছে। একজন নিরাপত্তাকর্মী আয়েশা আক্তার বলেন, ‘এ কাজ করতে গিয়ে কখনো মনে হয়নি আমি নারী বলে কম গুরুত্ব পাচ্ছি। তবে দীর্ঘ সময় কাজ করতে হয়, ছুটি কম, মজুরি তুলনামূলক কম-এমন কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে।’ তবুও, আত্মমর্যাদার জায়গা থেকে তিনি গর্বের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন।

শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণও বেড়েছে উল্লেখযোগ্যভাবে। স্বাধীনতা-পরবর্তী ৫০ বছরে কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম সাফল্যগাথা। ১৯৭৪ সালে এ হার ছিল মাত্র ৪ শতাংশ।

২০১৬-১৭ সালের শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, বর্তমানে এ হার ৩৬.৩ শতাংশ। এক কোটি ৮৭ লাখ নারী আজ কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতে কর্মরত। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডি-র গবেষণা বলছে, জিডিপিতে নারীর অবদান প্রায় ২০ শতাংশ। তবে গৃহস্থালি ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের মূল্যায়ন করলে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৮ শতাংশে।

শিক্ষা, চিকিৎসা, ব্যাংক, প্রশাসন, কূটনীতি, বাণিজ্য—প্রায় সব পেশায় নারীরা এখন দৃশ্যমান এবং কার্যকর ভূমিকা রাখছেন। নারী পাইলট, নাবিক, ট্রেনচালক, ম্যাজিস্ট্রেট, জেলা প্রশাসক, ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী, আইনজীবী, বিচারক, বিজ্ঞানী—সবখানেই নারী আজ সাফল্যের প্রতীক। এমনকি সীমান্ত পাহারায়, বন্দরে, কাস্টমস বিভাগে, বিদেশি শান্তিরক্ষা মিশনেও নারীরা দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের সিনিয়র সহকারী সচিব আফরোজা আক্তার রিবার মতে, নারীরা এখন আর অবরোধবাসিনী নন। তাদের অংশগ্রহণ আজ শুধু সমতা প্রতিষ্ঠা নয়, বরং দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন ও অগ্রগতির চালিকাশক্তি। তিনি বলেন, "নারীদের অংশগ্রহণ এখন শুধু চাকরি বা ব্যবসার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, বরং ঝুঁকিপূর্ণ এবং চ্যালেঞ্জিং পেশাগুলোতেও তারা দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন।"

বাংলাদেশের নারী জাগরণ আজ আর স্লোগানে সীমাবদ্ধ নয়। এটি এখন বাস্তবতা। ঘর সামলে বাইরের পৃথিবীতে নিজেদের যোগ্যতায় স্থান করে নিচ্ছেন নারীরা। পেশাগত লিঙ্গবৈষম্য যতই থাকুক না কেন, তা নারীর অগ্রযাত্রাকে আর থামাতে পারছে না। বরং প্রতিটি চ্যালেঞ্জকে তারা রূপান্তর করছেন সম্ভাবনায়। একজন নারী আজ শুধুই মা, বোন বা স্ত্রী নন-তিনি একজন লড়াকু পেশাজীবী, দেশপ্রেমিক সৈনিক এবং অর্থনীতির অন্যতম চালকশক্তি।