বাসস
  ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৫:১৬

দুবলার চরের শুঁটকি খাতে সরকারের রাজস্ব আয় ৬ কোটি টাকা 

দুবলার চরে একটি মৌসুমি জেলে পল্লিতে শুঁটকি বিক্রি করছেন এক বিক্রেতা। ছবি : বাসস

আজাদ রুহুল আমিন

বাগেরহাট, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫(বাসস): সুন্দরবনের দক্ষিণ প্রান্তে বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষে অবস্থিত দুবলার চর একটি মৌসুমি জেলে পল্লি। এটি বাংলাদেশে শুঁটকি উৎপাদনের জন্য বিশেষভাবে পরিচিত।  

দেশের বিভিন্ন জেলার মৎস্যজীবীরা বছরের সাত মাস এই এলাকায় এসে মাছ ধরা ও শুকানোর কাজ করে। এটি তাদের বার্ষিক আয়ের প্রধান অবলম্বন।  

প্রতিবছর বর্ষা মৌসুম শেষে অক্টোবর থেকে মার্চ পর্যন্ত প্রায় ৭ মাস খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, পিরোজপুর, চট্টগ্রাম এবং কক্সবাজার থেকে হাজারো জেলে এখানে এসে সাময়িক বসতি স্থাপন করেন। 

তারা এসময় সমুদ্র থেকে মাছ ধরে শুকিয়ে বাজারে নেয়ার উপযোগী করে তোলেন। 

জেলে পল্লির বাসিন্দা নূর ইসলাম মাতবর বাসসকে বলেন, বর্ষা মৌসুম শেষ হলে সাগর ও নদীতে মাছের উপস্থিতি বাড়ে। মাছ ধরাও সহজ হয়। তাই এসময় বিভিন্ন জেলার জেলেরা এসে দুবলার চরে অস্থায়ী বসতি গড়েন। বর্ষা আসার আগে আগেই আবার ব্যবসা গুটিয়ে চলে যান।

তিনি বলেন, এসময় শত শত বিশাল আয়তনের ইঞ্জিন চালিত নৌকা, মাঝিমাল্লা, মাছ ধরার জাল নিয়ে সাগরে মাঝ আহরণ করে। তারা সাগর থেকে নৌকা বোঝাই মাছ ধরে এনে শুঁটকি পল্লিতে বিক্রি করে আবার দ্রুত ধাবিত হয় সাগর পানে। 

স্থানীয় বাসিন্দা শুঁটকি ব্যবসায়ী রিয়াজুল বাওয়ালি জানান, অধিকাংশ জেলেদের কোন ঠিকানা নেই। সঞ্চয় নেই। যখন মাছ ধরার  মৌসুম আসে তখন কাজ থাকে। উপার্জনও থাকে। আবার মাছ ধরার মৌসুম চলে গেলে তাদের হাত-পা গুটিয়ে ঘরে বসে থাকতে হয়। ঋণ করে সংসার চালাতে হয়।  কোনো সঞ্চয় না থাকায় দাদন নিয়েই জেলেরা মাছ ধরতে আসতে বাধ্য হয়। 

তিনি বলেন, জেলেদের জন্য সরকারি কোনো আর্থিক অনুদানের ব্যবস্থা নেই। সরকারের পক্ষ থেকে জেলেদের আর্থিক সহযোগিতা করা হলে তাদের স্বচ্ছলতা আসার পাশাপাশি সরকারের রাজস্ব আয় বৃদ্ধি পেত। 

রিয়াজুল জানান, বিভিন্ন জেলা থেকে আগত মৌসুমি জেলেরা মূলত মাছ শিকার এবং শুঁটকি প্রক্রিয়াজাতকরণের কাজে ব্যস্ত থাকেন। মাছ শিকারের অনুমতি নিতে তারা বাগেরহাট সুন্দরবনের পূর্ব বন বিভাগের নিয়মিত প্রক্রিয়া হিসেবে বোট লাইসেন্স সার্টিফিকেট (বিএলসি) এবং জ্বালানি কাঠের জন্য প্রতিদিনের ধার্যকৃত  ফি ডিএফসি প্রদান করে সংলগ্ন চরে তাদের মৌসুমি ব্যবসা পরিচালনা করেন।

মেহের আলীর খাল, আলোরকোল, মাঝের চর, নারিকেলবাড়িয়া, মানিকখালী এবং শ্যালারচরসহ বিভিন্ন স্থানে জেলেরা পল্লি গড়ে তোলেন। শুঁটকি প্রক্রিয়ার জন্য লইট্টা, তেলফ্যাসা, ছুরি, চাকা চিংড়ি, বৈরাগী এবং রূপচাঁদার মতো মাছ শুকানো হয়। শিকারের পর মাছগুলো বাছাই করে বাঁশ কাঠ দিয়ে বিভিন্ন স্তরের মাচা বানিয়ে শুকাতে দেওয়া হয়। পর্যাপ্ত রোদ পেলে শুঁটকি প্রস্তুত হতে তিন থেকে পাঁচ দিন সময় লাগে। 

এই এলাকায় শুকানো মাছ চট্টগ্রামের আসাদগঞ্জ পাইকারি বাজারে পাঠানো হয়। এখান থেকেই সারাদেশের ৬৪ জেলার পাইকার ও ব্যবসায়ীরা শুঁটকি ক্রয় করে বড় বড় হাট বাজারে বিক্রি করেন। 

দীর্ঘদিন সংরক্ষণযোগ্য এবং সুস্বাদু হওয়ায় শুঁটকি মাছের দাম একটু বেশি । কিন্তু তাতে শুঁটকি মাছের প্রতি মানুষের আগ্রহ কমেনি। বরং দেশবিদেশে শুঁটকির কদর দিনদিন বাড়ছে। এটি প্রোটিনের চাহিদা পূরণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। 

পুষ্টিবিদ ডাক্তার জোবায়ের হোসেন বাসসকে বলেন, শুঁটকি মাছ উচ্চ মানসম্পন্ন প্রোটিন সমৃদ্ধ। তাই যারা তাজা মাছের প্রোটিন খেতে পান না, তাদের জন্যে শুঁটকির প্রোটিন খুবই উপকারী। এছাড়াও সামুদ্রিক মাছের শুঁটকি খেলে চোখের জ্যোতি বাড়ে। 

তবে শুধু পুষ্টিগুণই নয়, দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে শুঁটকি মাছ। একদিকে মৎস্যজীবীরা মৌসুমি মাছ ধরে সহজে বিক্রি করতে পারছেন শুঁটকি ব্যবসায়ীদের কাছে। অন্যদিকে শুঁটকি মাছ প্রক্রিয়াকরণের সাথে যুক্ত হয়ে শত শত নারী পুরুষ জীবিকা নির্বাহ করছেন। শুঁটকি মাছ থেকে সরকারের রাজস্ব আয়ও দিন দিন বাড়ছে।   

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, দুবলার চরের এই মৌসুমি কার্যক্রমে প্রায় ৩৫ হাজার মানুষ সরাসরি জড়িত থাকেন। জেলেদের দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটানোর জন্য চর এলাকায় অস্থায়ী বাজার গড়ে ওঠে। এসব এলাকায় সুন্দরবন ভ্রমণে আসা দেশি-বিদেশি পর্যটকদের শুঁটকি কিনতে ভিড় করতে দেখা যায়। এই  অস্থায়ী শুঁটকি পল্লিতে সোলার প্যানেল ও জেনারেটরের মাধ্যমে বিদ্যুতের ব্যবস্থা থাকে। পশু-পাখি, বাঘ, হরিণ, শূকরসহ নানা প্রজাতির বন্যপ্রাণীর  অভয়াশ্রম বলেই এই এলাকায় আলোর সীমিতকরণ করা হয়েছে। এসময় দুবলার চরের শুঁটকি পল্লি সোলার প্যানেল আর জেনারেটরের আলোয় এক অপরূপ রূপে সজ্জিত হয়ে ওঠে। 

পূর্ব সুন্দরবন বিভাগীয় বাগেরহাটের বন কর্মকর্তা (ডিএফও) রেজাউল করিম চৌধুরী বাসসকে বলেন, শুঁটকি শিল্প স্থানীয় অর্থনীতিতে বড় ধরনের ভূমিকা রেখে চলেছে।  শুঁটকি উৎপাদন এবং সরবরাহ প্রক্রিয়া থেকে সরকারের উল্লেখযোগ্য রাজস্ব আয় হয়। ২০২৪-২০২৫  অর্থবছরে এই অঞ্চলে ৬৩,৫০০ কুইন্টাল শুঁটকি উৎপাদিত হয়েছে। এ থেকে সরকারের রাজস্ব আয় হয়েছে ৬ কোটি টাকা। 

তিনি বলেন, মাছ শিকার, মাছ শুকানো, শুঁটকি প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সংমিশ্রণে দুবলার চর বাংলাদেশের অর্থনীতি ও সমাজে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সুন্দরবনে জলদস্যু ও বনদস্যুদের কারণে অনেক সময় রাজস্ব আদায়ে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়। তবে আগামী মৌসুমে সরকারের রাজস্ব আয় বেশি হবে বলে আশা করছি। কারণ বর্তমানে বনবিভাগের নজরদারি এবং ডাকাতের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করতে ড্রোন ব্যবহৃত হচ্ছে। 

ডিএফও বলেন, সুন্দরবন বাংলাদেশের ফুসফুস। এই অভয়ারণ্যকে রক্ষা করতে পারলেই সুন্দরবন  দেশের অর্থনৈতিক মুক্তির অন্যতম বৃহৎ শিল্প খাত হয়ে উঠবে।