শিরোনাম
ঢাকা, ৫ আগস্ট, ২০২৫ (বাসস) : আগামী ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছর পূর্ণ হতে যাচ্ছে। এ সময়ে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে ব্যাপক স্থিতিশীলতা এসেছে। অর্থনীতি ও ব্যাংকিং খাতে আস্থা ফেরায় রিজার্ভ পুনরুদ্ধার সম্ভব হয়েছে।
২০২৪ সালের জুলাইয়ে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০ বিলিয়ন ডলারের নিচে ছিল। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর এক বছরের ব্যবধানে, ২০২৫ সালের জুলাইয়ে তা বেড়ে ৩০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়। যা দেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে ইতিবাচক অগ্রগতির ইঙ্গিত বহন করছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের ২৪ জুলাই পর্যন্ত দেশের মোট রিজার্ভ (গ্রস রিজার্ভ) বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩০ বিলিয়ন ডলারে। তবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসেব অনুযায়ী (বিপিএম৬) অনুযায়ী, বাংলাদেশের নিট রিজার্ভ বর্তমানে ২৪.৯৯ বিলিয়ন ডলার।
অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, অর্থনীতি ও ব্যাংকিং খাতে আস্থা ফিরে আসাই বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
তাদের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ি, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বিনিময় হার স্থিতিশীল থাকায় রিজার্ভ কমে যাওয়া থেমে গেছে এবং এটি ধীরে ধীরে পুনর্গঠিত হচ্ছে।
শিল্পখাত সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, শেখ হাসিনার স্বৈরশাসনের অবসানের পর হুন্ডি, অর্থ পাচার ও দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরার ফলে দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহও বেড়েছে। এর ফলে বৈদেশিক খাতেও ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে।
বাসসের সঙ্গে আলাপকালে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য ড. মনজুর হোসেন বলেন, রপ্তানি আয়, প্রবাসী আয়ের প্রবাহ এবং বিনিময় হার বর্তমানে ইতিবাচক ধারায় রয়েছে। গত কয়েক মাসে রপ্তানি আয় ও প্রবাসী আয়ের প্রবাহ বরং বেড়েছে।
তিনি আরো বলেন, রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স বৃদ্ধি এবং বিনিময় হারের স্থিতিশীলতা বৈদেশিক খাতকে তুলনামূলক ভালো অবস্থানে নিয়ে এসেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বাসস’কে বলেন, ডলার সংকট কমে যাওয়ায় বৈদেশিক খাতের ঘাটতি উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। ফলে রিজার্ভের স্থিতিশীল অবস্থান দেশের চলতি হিসাব ও আর্থিক হিসাবের ভারসাম্যেও প্রতিফলিত হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, রপ্তানি আয় ও প্রবাসী আয়ের জোরালো প্রবাহ রিজার্ভ পুনর্গঠনে সহায়তা করেছে।
২০২৪-২৫ অর্থবছরে রেমিট্যান্স প্রবাহ ৩০.৩৩ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অর্থবছরে সর্বোচ্চ প্রাপ্তি। আগের বছরের তুলনায় যা ছিল ২৬.৮০ শতাংশ বেশি।
এর আগে, ২০২০-২১ অর্থবছরে কোভিড-১৯ মহামারিকালে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স ছিল ২৪.৭৭ বিলিয়ন ডলার। এবছর সেটিও ছাড়িয়ে গেছে। করোনার সময় হুন্ডি চ্যানেলের ওপর বিধিনিষেধ এবং সরকারি ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠালে প্রণোদনা বন্ড চালুর ফলে রেমিট্যান্স প্রবাহ হঠাৎ বেড়ে গিয়েছিল।
গত অর্থবছরের মত চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জুলাইয়েও রেমিট্যান্স প্রবাহের ইতিবাচক ধারা অব্যাহত রয়েছে। এ সময় প্রবাসী বাংলাদেশিরা প্রায় ২.৪৮ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। এটি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৩০ শতাংশ বেশি।
আরিফ হোসেন খান আরো বলেন, মানি লন্ডারিংয়ের প্রবণতা কমে যাওয়া, প্রবাসী আয়ের ভালো প্রবাহ এবং রপ্তানিতে উচ্চ প্রবৃদ্ধি রিজার্ভ বাড়ার মূল চালিকাশক্তি।
তিনি বলেন, প্রায় এক বছর আগে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে দেশব্যাপী পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি দেয়। এরপর জাতীয় অর্থনীতি, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও প্রশাসন সংস্কারে একাধিক নীতিগত পদক্ষেপ নেওয়া হয়, যা জনআস্থা প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এই কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশে রেমিট্যান্স হঠাৎ বাড়ার পেছনে একাধিক কারণ আছে। সরকার পুঁজিবাজারে মূল্য কারসাজি দমনসহ নানা উদ্যোগ নিয়েরছে। পাশাপাশি প্রচলিত ধারার বাইরে গিয়ে রপ্তানি আয় ৪৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। এটিও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে।
প্রবাসী বাংলাদেশিরা বৈধ ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠাতে আরো বেশি উদ্বুদ্ধ হয়েছেন বলেও দাবী করেন তিনি।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, রেমিট্যান্স বৃদ্ধিই রিজার্ভ পুনরুদ্ধারে প্রধান ভূমিকা রেখেছে, যা অর্থনীতিকে স্বস্তি দিয়েছে।
তিনি বলেন, ডলার সংকটের কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতি অনেক সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিল। ব্যাংকগুলোর পক্ষে এলসি (ঋণপত্র) খোলা কঠিন হয়ে পড়েছিল। এখন পরিস্থিতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান এই অর্থনীতিবিদ বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর ব্যাংক খাতে নিয়ন্ত্রণ পুনঃপ্রতিষ্ঠার কাজ শুরু করে। এছাড়াও দুর্বল প্রতিষ্ঠানগুলোর পতন ঠেকাতে সহায়তা এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফেরাতে নানা উদ্যোগ নিয়েছে।
তিনি বলেন, ব্যাংক খাতকে একটি নির্দিষ্ট ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর দখল থেকে মুক্ত করার ক্ষেত্রে সরকার অনেক অগ্রগতি অর্জন করেছে। সর্বোপরি আমরা প্রায় স্থিতিশীল অবস্থার দিকেই এগোচ্ছি। তবে এখনই বলব না, সংকট পুরোপুরি কেটে গেছে।