শিরোনাম
দিদারুল আলম
ঢাকা, ১০ আগস্ট ২০২৫(বাসস): চব্বিশের জুলাই গণঅভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ৩০ মিস কেস-এ ২০৯ জন আসামির মধ্যে আটক রয়েছেন ৮৪ জন।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর গাজী এমএইচ তামিম এ তথ্য প্রকাশ করেছেন। ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন বরাবর মোট ৪৫০টি অভিযোগ জমা পড়েছে।
৩০ টি মিস কেস এর মধ্যে তদন্ত শেষে ৫টি মামলার অভিযোগ ট্রাইব্যুনালে দাখিল করা হয়। এর মধ্যে তিনটি আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। এর মধ্যে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়েছে। চব্বিশের জুলাই গণঅভ্যুত্থানে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে যাওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন একই মামলার আসামি। তাদের মধ্যে আবদুল্লাহ আল মামুন গ্রেফতার, অন্য দুজন পলাতক।
আমলে নেয়া অন্য তিনটি মামলা হলো রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদকে গুলি করে হত্যা, ঢাকার চানখাঁরপুলে ছয় আন্দোলনকারীকে গুলি করে হত্যা ও আশুলিয়ায় মৃতপ্রায় একজন ও পাঁচজনের লাশ পোড়ানোর মামলা। এছাড়া রামপুরায় কার্নিশে ঝুলে থাকা ছাত্রকে গুলির মামলায় ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দাখিল করা হয়েছে।
চব্বিশের জুলাই আগস্টে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে হওয়া মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে। এই মামলায় পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণ আগামী ১৭ আগস্ট। এই মামলায় এখন পর্যন্ত ৫ জন সাক্ষী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ তাদের জবানবন্দি দিয়েছেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ হত্যার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সূচনা বক্তব্য উপস্থাপন ও প্রথম সাক্ষ্য গ্রহণ হবে আগামী ২৭ আগস্ট।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় রাজধানীর চানখাঁরপুল এলাকায় ছয়জনকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ আট আসামির বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। এ মামলার সূচনা বক্তব্যের জন্য আজ ১০ আগস্ট এবং সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য আগামীকাল ১১ আগস্ট দিন ধার্য রয়েছে।
এছাড়াও জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় ঢাকার অদূরে আশুলিয়ায় আন্দোলনকারীদের হত্যার পর লাশ পোড়ানোর ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠনের বিষয়ে শুনানি শুরু হয়েছে।
চব্বিশের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করা হয়। পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনালে গণঅভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে প্রথম মামলাটি (মিস কেস বা বিবিধ মামলা) হয় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে। এছাড়া শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে আরও দুটি মামলা রয়েছে। যার মধ্যে একটি আওয়ামী লীগ শাসনামলের সাড়ে ১৫ বছরে গুম-খুনের ঘটনায় তাকে আসামি করা হয়েছে। অন্যটি রাজধানীর মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে হত্যাকাণ্ডের মামলা। এসব অপরাধের বিচার অনুষ্ঠিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে।
পৃথক দুটি ট্রাইব্যুনালে বিচার চলছে :
মামলা ও বিচারের অগ্রগতি প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বাসসকে বলেন, বিচারপ্রার্থীর প্রত্যাশা, আইন, আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ড, আসামির অধিকার, যথাযথ তদন্ত ও সাক্ষ্যপ্রমাণ, আইনি প্রসিডিউর অনুসরণসহ সার্বিক বিষয়গুলো সমন্বয় করতে হয় প্রসিকিউশনকে। তিনি বলেন, চব্বিশের জুলাই গণঅভ্যুত্থানে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার নিয়ে যেন পৃথিবীর কোথাও কেউ কোন প্রশ্ন তুলতে না পারেন সে বিষয়ে আমরা বদ্ধপরিকর। প্রথমবারের মতো ইতিহাসে বিচার কার্যক্রম টেলিভিশনে লাইভ করা হচ্ছে।
চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, মানবতাবিরোধী অপরাধে যেটা হয়েছে সেটা হলো সাধারণ মার্ডার থেকে আকাশ-পাতাল তফাৎ। একজন মানুষ খুন করে, সেটা অনুসন্ধান করে। আর এখানে দেড় হাজার লোক খুন হয়েছে। পোস্টমর্টেম রিপোর্ট হয়নি। ফ্যামিলি মেম্বারদের খবর দেয়ার সুযোগ তারা দেয়নি। বলেছে, কেউ যদি নিয়ে যাওয়ার মতো থাকে নিয়ে যাক। অজ্ঞাত পরিচয়ে লাশ হিসেবে দাফন করে ফেলতে হবে। সেখানে শহীদের সহযোগী ও পরিবারের সদস্যদের রাতে মানুষের অজান্তে কবর দিতে হয়েছে। তাই এসব মামলার তদন্ত অত্যন্ত জটিল। ইতোমধ্যে অকাট্য প্রমাণ হাতে এসেছে। আন্তর্জাতিক প্রধান প্রধান গণমাধ্যমে অপরাধের প্রমাণ উঠে এসেছে।
চিফ প্রসিকিউটর বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন-১৯৭৩ সংশোধন করা হয়েছে।
গত ১০ ফেব্রুয়ারি ও ১০ মে ২০২৫ তারিখে দুটি পৃথক অধ্যাদেশের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন, ১৯৭৩ সংশোধন করে যুগোপযোগী ও আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন করা হয়েছে। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করা হয়েছে। ১৪ অক্টোবর ২০২৪ তারিখে এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করা হয়েছে। এর আগে গত ৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪ তারিখে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন টিম ও ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ তারিখে তদন্ত সংস্থা পুনর্গঠন করা হয়। এরপর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে প্রাপ্ত অভিযোগ ও অভিযুক্তের সংখ্যা, দ্রুত বিচার-নিষ্পত্তির প্রয়োজন, কাজের চাপ ইত্যাদি বিবেচনায় গত ৮ মে ২০২৫ তারিখে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ গঠন করে প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার এবং একই প্রজ্ঞাপনে ১৪ অক্টোবর ২০২৪ তারিখে গঠিত ট্রাইব্যুনালকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
চিফ প্রসিকিউটর বলেন, বিচারিক কার্যক্রম শুরুর পূর্বে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ভবন সংস্কার ও আধুনিকায়ন সম্পন্ন করা হয়েছে। গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় দ্রুততম সময়ের মধ্যে পুরাতন হাইকোর্ট বিল্ডিং তথা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ভবন সংস্কার ও আধুনিকায়ন করা হয়।
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মামলায় ‘রাজসাক্ষী’ সাবেক আইজিপি:
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের এক মামলায় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠনের পর সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়েছে। ওই মামলার অন্যতম আসামি পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে ট্রাইব্যুনালে বক্তব্য দিয়েছেন। সেই সঙ্গে তিনি ‘অ্যাপ্রুভার’ (দোষ স্বীকার করে ঘটনার সত্য বিবরণ প্রকাশ করেন যে আসামি; সাধারণত তিনি রাজসাক্ষী হিসেবে পরিচিত) হিসেবেও ট্রাইব্যুনালে আবেদন করেন গত ১০ জুলাই। সাবেক আইজিপির এমন বক্তব্যের পর আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠনের আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। একই সঙ্গে সাবেক আইজিপি মামুন নিজেকে ‘অ্যাপ্রুভার’ হিসেবে যে আবেদন করেছেন, তা মঞ্জুর করেন ট্রাইব্যুনাল।
চব্বিশের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে সংগঠিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেফতার হয়ে বর্তমানে কারাগারে থাকা আসামিদের মধ্যে রয়েছেন ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেকমন্ত্রী আনিসুল হক, আমির হোসেন আমু, মো. আব্দুর রাজ্জাক, কামরুল ইসলাম, মুহাম্মদ ফারুক খান, ডা. দীপু মনি, গোলাম দস্তগীর গাজী, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ও তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, সাবেক মন্ত্রী ও বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, সাবেক মন্ত্রী ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের সভাপতি হাসানুল হক ইনু, সাবেক প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার ও জুনাইদ আহমেদ পলক, সাবেক সংসদ সদস্য সোলায়মান মোহাম্মদ সেলিম, সাবেক সচিব মো. জাহাঙ্গীর আলম ও অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক এবং ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (বরখাস্ত) জিয়াউল আহসান।