শিরোনাম

আল সাদী ভূঁইয়া
ঢাকা, ৩০ ডিসেম্বর, ২০২৫ (বাসস) : যিনি ছিলেন একজন ‘অন্তর্মুখী গৃহবধূ’। স্বামীকে হত্যার পর সাদা শাড়ি পরে শোকাতুর হয়ে না থেকে দেশের মানুষের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য খুনি ও স্বৈরাচার সরকারের বিরুদ্ধে রাজপথে ন্যায় ও অধিকারের জন্য অগ্নিমূর্তি ধারণ করেছিলেন যে নারী তিনি আর কেউ নন তিনি হলেন বেগম খালেদা জিয়া। যার জন্য বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে ‘আপসহীন’ শব্দটি আর কোনো বিশেষণ নয়, বরং এটি তাঁর নামের সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তাঁর রাজনৈতিক জীবনের আচরণ ছিল সরলতা, নম্রতা, সম্মানসূচক ও ত্যাগের। ক্ষমতালোভী শত্রুদের বিরুদ্ধে ছিলেন আপসহীন। যিনি ছিলেন গ্রামের সাধারণ পরিবেশে বেড়ে ওঠা একজন মেয়ে যাঁর ছিল মিষ্টি হাসি, মানুষকে আপন করে নেওয়ার ভীষণ ক্ষমতা। নিজের মধ্যে ছিল না কোনো ছলতা। সবকিছু যেন একদম সোজা বলে ফেলতেন। যা বলতেন তা ভেবে বলতেন। যা বলতেন তা বিশ্বাস ও বাস্তবায়ন করতেন। কোনো কিছুতেই তা থেকে সরে আসতেন না। ভয়-ডর বলতে তাঁর যেন কিছুই ছিল না।
সেনাপ্রধানের স্ত্রী কিংবা ফার্স্ট লেডি কোনো কিছুই তাঁকে ধরে রাখতে পারেনি। ঢাকার রাজপথ কাঁপিয়েছিলেন। পায়ে হেঁটে মিছিল করেছেন। তাঁর অদম্য সাহসিকতা ও সাধারণ বক্তব্য মানুষকে ব্যাপকভাবে আকৃষ্ট করেছিল। সাধারণ শাড়ি পরে ঢাকার রাজপথে লড়াই করা এই নারীকে নিয়ে বাংলাদেশের কট্টর কোনো ইসলামিক স্কলারসও তাঁকে নিয়ে কোনো নেতিবাচক মন্তব্য করেননি। তিনিও ভোটের জন্য কখনো বোরখা বা অন্যকোনো ধর্মীয় পোশাক পরেননি। অথচ তিনি সবার মন জয় করেছিলেন নিজের স্বতন্ত্রতা দিয়ে। যা আর কেউ কখনো পারেনি।
খালেদা জিয়া বাংলাদেশের গ্রাম-বাংলার সবচেয়ে সাধারণ মানুষটির প্রতিনিধিত্ব করতেন। তাঁর সঙ্গে জোট করেছেন বাংলাদেশের ইসলামপন্থী, মধ্যমপন্থী, সংখ্যালঘু ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নেতারাও। তাঁর আপসহীনতার কাছে হার মানতে বাধ্য তাঁর দীর্ঘদিনের প্রতিদ্বন্দ্বীরাও। তাঁর দৃঢ় অবস্থানের কৃতিত্ব স্বীকার করতে হয়েছে তাদের।
বেগম জিয়ার আপসহীনতার যাত্রা শুরু হয়েছিল আশির দশকে। স্বামী শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আকস্মিক শাহাদাতবরণের পর যখন দল ও দেশ এক চরম সংকটে, তখন তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন। তৎকালীন সামরিক স্বৈরশাসকের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া চষে বেড়িয়েছেন তিনি। সেই নয় বছরে বহুবার তাঁকে গৃহবন্দী করা হয়েছে, কিন্তু তিনি ক্ষমতার ভাগ নিতে কোনো আপস করেননি। ১৯৯০-এর ডিসেম্বরে তাঁর সেই অনড় অবস্থানের কাছেই নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিল স্বৈরাচার।
বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে কঠিন ও চ্যালেঞ্জিং সময় ছিল ১/১১-এর সময়। ২০০৭ সালে যখন সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার দেশের বড় বড় নেতাদের দেশত্যাগে বাধ্য করছিল বা চাপের মুখে আপস করাচ্ছিল, তখন বেগম জিয়া দাঁড়িয়েছিলেন পাহাড়ের মতো অটল হয়ে। তাঁকে দেশ ছাড়ার জন্য অকল্পনীয় চাপ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি দৃঢ়কণ্ঠে বলেছিলেন— ‘বিদেশে আমার কোনো ঘর নেই, কোনো ঠিকানা নেই। এ দেশের মাটি আর মানুষই আমার সব। মরলে এ দেশের মাটিতেই মরব।’ কারাগারে তাঁর সেই নিঃসঙ্গ লড়াই আর দুই সন্তানের ওপর অমানবিক নির্যাতনের যন্ত্রণা সহ্য করেও তিনি মাথা নোয়াননি। তাঁর সেই সাহসিকতা আজ বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে এক কিংবদন্তি।
২০০৯ পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগের দীর্ঘ শাসনামলে বেগম খালেদা জিয়াকে রাজনৈতিকভাবে নিশ্চিহ্ন করার নানা চেষ্টা চালানো হয়েছে। নির্জন কারাগার থেকে শুরু করে পিজি হাসপাতালের কেবিনে বছরের পর বছর তাঁকে বন্দি রাখা হয়েছে। গুরুতর অসুস্থতা সত্ত্বেও চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার শর্ত হিসেবে কোনো ধরনের রাজনৈতিক সমঝোতা বা মাথা নিচু করার প্রস্তাব তিনি গ্রহণ করেননি।
বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু ঝুঁকির মুখে দাঁড়িয়েও তিনি তাঁর আদর্শ আর জনগণের দাবির প্রশ্নে ছিলেন হিমালয়সম অনড়। তাঁর এই কষ্টসহিষ্ণুতা আর ধৈর্যের মাধ্যমেই তিনি কোটি মানুষের হৃদয়ে ‘মাদার অব ডেমোক্রেসি’ বা ‘গণতন্ত্রের মাতা’ হিসেবে স্থান করে নেন।
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার রক্তঝরা বিপ্লব যেন ছিল বেগম খালেদা জিয়ার দীর্ঘ ত্যাগের এক ঐতিহাসিক প্রতিদান। ফ্যাসিবাদের পতন ঘটিয়ে ছাত্র-জনতা যখন রাজপথ দখল করে, তখন তাদের শ্লোগানে শ্লোগানে বেগম জিয়ার সেই দীর্ঘ লড়াইয়ের প্রতিধ্বনি শোনা গেছে। ৫ আগস্টের পর যখন তিনি মুক্ত বাতাসে ফিরে আসেন, তাঁর প্রথম বার্তাই ছিল সম্প্রীতি আর প্রতিহিংসাহীন সমাজ গড়ার। দীর্ঘ বন্দিত্ব তাঁর শরীরকে জীর্ণ করলেও তাঁর মনোবলকে যে স্পর্শ করতে পারেনি, তা দেশবাসী নতুন করে প্রত্যক্ষ করে।
বেগম খালেদা জিয়ার কাছে ক্ষমতা কখনোই মুখ্য ছিল না, বরং সার্বভৌমত্ব আর জনমতের সুরক্ষা ছিল অগ্রাধিকার। তাঁর রাজনীতি আবর্তিত হয়েছে বাংলাদেশের স্বাতন্ত্র্য রক্ষা নিয়ে। বারবার কারাবরণ, শারীরিক যাতনা এবং পারিবারিক বিয়োগ ব্যথা সহ্য করেও তিনি প্রমাণ করেছেন- ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, আর দলের চেয়ে দেশ।
বেগম খালেদা জিয়া আজ কেবল একটি দলের নেত্রী নন; তিনি বাংলাদেশের মানুষের কাছে সাহসের এক মূর্ত প্রতীক। যখনই এ দেশের গণতন্ত্র সংকটে পড়বে, যখনই সার্বভৌমত্বের ওপর আঘাত আসবে, তখনই বেগম জিয়ার ‘আপসহীন’ নেতৃত্ব আগামী প্রজন্মের জন্য আলোকবর্তিকা হয়ে কাজ করবে। তাঁর এই জীবনগাঁথা আমাদের শেখায়- বিপদের সামনে মাথা নত না করাই হলো প্রকৃত দেশপ্রেম।