বাসস
  ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৯:৩৬

স্মৃতি রোমন্থন করে অঝোরে কাঁদছেন খালেদা জিয়ার স্বজন ও দলীয় নেতাকর্মীরা

ফাইল ছবি

মোহাম্মদ শাহাদাত হোসেন

ফেনী, ৩০ ডিসেম্বর, ২০২৫ (বাসস): বিএনপি চেয়ারপার্সন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মৃত্যুর সংবাদ জানাজানি হলে ভোর থেকেই তাঁর পৈত্রিক বাড়ি জেলার ফুলগাজী উপজেলার দক্ষিণ শ্রীপুর মজুমদার বাড়িতে চলছে শোকের মাতম। 

এ বাড়িকে ঘিরে তাঁর অনেক স্মৃতি। প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনের সময় এমনকি প্রধানমন্ত্রী থাকার সময়ও তিনি মা-বাবার স্মৃতি বিজড়িত গ্রামের এ বাড়িতে বহু সময় এসেছেন। স্বজন ও প্রতিবেশীর খোঁজখবর নিয়েছেন, এমনকি বিপদে-আপদে সাহায্য সহায়তাও করেছেন। 

জেলার ছাগলনাইয়া, ফুলগাজী ও পরশুরাম উপজেলা নিয়ে গঠিত তাঁর নিজ নির্বাচনী এলাকা ফেনী-১ এর উন্নয়ন অগ্রগতিতে অসামান্য অবদান রেখেছেন।

তাঁর চাচাতো ভাই অধ্যক্ষ সালেহ উদ্দিন আহমেদ মজুমদার বাসসকে জানান, প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন ১৯৯৫ সালে পৈত্রিক বাড়ির অদূরে তাঁর দেয়া ১.৬৬ একর জমিতে গড়ে উঠে বেগম খালেদা জিয়া মহিলা কলেজ। এছাড়া তিনি ফুলগাজীকে উপজেলায় উন্নীতকরণ, আঞ্চলিক যুব উন্নয়ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স প্রতিষ্ঠা করেন। 

এর আগে ১৯৮৩ সালে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে সঙ্গে নিয়ে তিনি বাবার বাড়ি আসলে ওই সময়ে ফুলগাজীর পুলিশ ফাঁড়িটি তিনি থানায় উন্নীত করেন। আত্মীয় স্বজনদের সুখ-দুঃখে তিনি যতটা সম্ভব খোঁজ-খবর রাখতেন। বিশেষ করে দলীয় বা সরকারি সফরে এলাকায় আসলে পৈত্রিক বাড়িতে উঠতেন। এসময়ে তাঁকে ঘিরে আত্মীয় স্বজন ও প্রতিবেশীদের মিলনমেলা হতো।

বেগম খালেদা জিয়ার ঘনিষ্ঠভাজনদের অন্যতম ছিলেন বিএনপির কেন্দ্রীয় নেত্রী রেহানা আক্তার রানু। সংরক্ষিত আসনে তিনি দুই বার সংসদ সদস্য ছিলেন। সবশেষ ২০০৮ সালের নির্বাচনে বেগম খালেদা জিয়া ফেনী-১ আসনে নির্বাচিত হওয়ার পর এই আসনের উন্নয়ন ও সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড সমন্বয় করতেন রেহানা আক্তার রানু। 

তিনি জানান, ১৯৯১ এর জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময়ে ছাত্রদলের নেত্রী থাকাকালীনই বেগম খালেদা জিয়ার নির্বাচনী প্রচারণায় ফেনী আসেন। তখন থেকে তাঁর ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেন। তাঁর নানা স্মৃতির উল্লেখ করে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন রানু। 

তিনি বলেন, এ আসন থেকে বেগম খালেদা জিয়া বার বার নির্বাচিত হলেও ঘুরে ফিরে আসনটি তিনি নিজের জন্য রেখে অন্যগুলো ছেড়ে দিতেন। ১৯৯৬ এর ১২ জুনের নির্বাচনে ১১৬ আসন পেয়ে বেগম খালেদা জিয়া বিরোধী দলীয় নেত্রী হলে দলের নেতাদের পরামর্শে তাঁকে চট্টগ্রাম-১ (মীরসরাই) আসনটি রেখে অপর ৪টি আসন ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। সে অনুযায়ী কাগজপত্র তৈরি হলেও শপথ গ্রহণের ঠিক আগ মুহূর্তে তিনি মত বদল করেন। 

চট্টগ্রাম-১ এর পরিবর্তে তিনি ফেনী-১ আসনটিতে নিজে থাকবেন বলে জানান। তখন অন্য সংসদ সদস্যগণ শপথ গ্রহণ করলেও তাৎক্ষণিক কাগজপত্র প্রস্তুত করতে না পারায় তাঁর শপথ গ্রহণ পিছিয়ে যায়। ফেনীর প্রতি তাঁর এই প্রাণের টান আমাকে মুগ্ধ করেছে। এ জন্যই আমরা সবসময় স্লোগান দিতাম ‘ফেনীর মেয়ে খালেদা গর্ব মোদের আলাদা’। এই স্লোগানটি ম্যাডামও খুব পছন্দ করতেন।

বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও পরশুরাম পৌরসভার সাবেক মেয়র আবু তালেব আবেগ আপ্লুত হয়ে বলেন, ২০১৪ সালে তিনি আওয়ামী সন্ত্রাসীদের হামলায় গুরুত্বর আহত হলে বেগম খালেদা জিয়া তার চিকিৎসার ব্যবস্থা নেন। এমনকি উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে বিদেশে পাঠানোরও ব্যবস্থা করেন। বেগম খালেদা জিয়ার নির্দেশে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর তার বাসায় গিয়ে খোঁজ-খবর নেন। 

আবু তালেব বলেন, মুহুরী, কহুয়া, সিলোনীয়া নদী ছিলো পরশুরাম, ফুলগাজী ও ছাগলনাইয়াবাসীর দু:খ হিসেবে পরিচিত। বেগম খালেদা জিয়া ২০০৫ সালে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের কাজ উদ্বোধন করেন। এছাড়া এই এলাকায় গ্যাস সংযোগ ও ফেনী-বিলোনীয়ার সড়ক সম্প্রসারণও তাঁর নির্দেশেই হয়েছিল। বন্যার্তদের পাশে দাঁড়াতে ২০১৬ সালে শেষ বারের মতো নির্বাচনী এলাকায় এসেছিলেন বেগম খালেদা জিয়া।

২০২৩ সালের ৬ আগষ্ট দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে তার শেষ দেখা হয় বলে জানান আবু তালেব।

বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সাবেক সদস্য ও ফেনী সমিতি-ঢাকার আহবায়ক আবদুল্লাহর চৌধুরী বলেন, শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের অবর্তমানে বেগম খালেদা জিয়াকে রাজনীতিতে সক্রিয় করতে তিনিসহ দলের অনেক নেতারাই ভূমিকা রাখেন। যুবদলের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক থাকাকালে ১৯৮৩ সালে বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে তার প্রথম সাক্ষাত বলে জানান জনাব চৌধুরী। 

তিনি বলেন, ২০০১ সালে বেগম খালেদা জিয়া ফেনীসহ ৫টি আসনে জয় লাভ করলে, ফেনী-১ আসনটি ছোট ভাই মেজর (অব:) সাঈদ এস্কান্দারকে ছেড়ে দেন। সাঈদ এস্কান্দারের নেতৃত্বে এলাকার ব্যাপক উন্নয়নে তখন অনেকবার বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে তারা সাক্ষাত করেন। দেশের প্রথম কম্পিউটার ইনস্টিটিউট ও গালর্স ক্যাডেট কলেজ তখন ফেনীতে স্থাপন করা হয়। প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া এসব প্রতিষ্ঠানের উদ্বোধন করেন। এর আগে ১৯৯১ সালে প্রথম প্রধানমন্ত্রী হয়ে ফেনী জেলার সদর দপ্তর, দৃষ্টিনন্দন সার্কিট হাউজ স্থাপন, ফেনী ডায়াবেটিক হাসপাতালকে জমি দানসহ জেলার উন্নয়নে বহু অবদান রেখেছেন বেগম খালেদা জিয়া।

ফেনী জেলা ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, পৈত্রিক জেলা ফেনীর প্রতি অসামান্য টান ছিলো বেগম খালেদা জিয়ার। ১৯৮৫ সালে ফেনীর বেড়ি বাঁধ ভেঙ্গে গেলে তিনি পরিদর্শনে আসেন। তাঁর সঙ্গে এ ছিলো প্রথম সাক্ষাত। এরপর ১৯৯৩ সালে বেগম খালেদা জিয়া জাপান সফরে গেলে তাঁকে জাপান বিএনপির পক্ষ থেকে সংবর্ধনার আয়োজন করি। আমি তখন জাপান বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ছিলাম। ফেনীর পরিচয় জেনে বেগম খালেদা জিয়া পরম মমতায় মাতৃস্নেহে আমাকে তাঁর কাছে টেনে নেন। এই স্মৃতি কখনও ভোলার নয়।

ফেনী জেলা বিএনপির আহবায়ক শেখ ফরিদ বাহার বলেন, ফেনী জেলার একজন কর্মী হওয়ার সুবাদে বহুবার বেগম খালেদা জিয়ার সাক্ষাত পেয়ে নিজেকে ধন্য মনে করছি। আজ তাঁর মৃত্যুতে পুরো ফেনীর জনপদ কাঁদছে। আমরা সপ্তাহব্যাপী শোক পালনের কর্মসূচি দিয়েছি। জেলার প্রতিটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে ও বাড়ি ঘরে তাঁর মাগফেরাত কামনায় দোয়া করা হচ্ছে।

বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, বেগম খালেদা ব্যক্তিগত জীবনে খুবই বিনয়ী, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ও অমায়িক মানুষ ছিলেন। তিনি কখনও অন্যায়ের সঙ্গে মাথানত করেননি বলেই শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বব্যাপী তিনি আপোষহীন নেত্রী হিসেবে খ্যাতি পেয়েছেন। ওয়ান ইলেভেনের কঠিন সময়ে তিনি ন্যায়ের পক্ষে অটল ছিলেন বলেই তাঁকে এর বহুমূল্য দিতে হয়েছে। 

আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, বেগম খালেদা জিয়ার জনপ্রিয়তার কারণে ফেনী তথা গোটা চট্টগ্রাম বিভাগ বিএনপির দুর্ভেদ্য ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত।