শিরোনাম
মোহাম্মদ আফজাল হোসেন তানভীর
ঢাকা, জুলাই ২৩, ২০২৫ (বাসস) : জুলাই গণআন্দোলনের সমন্বয়ক রিফাত রশীদ বলেছেন, ‘সবার সাথে সমন্বয় করেই জুলাই গণআন্দোলন করা হয়েছিল। হাসিনা সরকারের পতন মূলত একটি যৌথ প্রয়াসের ফলাফল। এখানে প্রত্যেকের অবদান আছে, প্রত্যেকের ত্যাগ আছে। তাই বলে অবদানগুলো কোন ব্যক্তি বা সংগঠনের একক নয়। প্রকৃত অর্থে যারা জীবন ও রক্ত দিয়ে এই সংগ্রামকে সফল করেছে তাদের অবদানটা এখানে সবচেয়ে বেশি।’
বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা’র (বাসস) সাথে এক সাক্ষাৎকারে তিনি এ কথা বলেন।
মোহাম্মদ রশীদুল ইসলাম রিফাত। তবে রিফাত রশীদ নামেই পরিচিত তিনি। তার গ্রামের বাড়ি কুমিল্লা। ঢাকায় বসবাস করেন সাভারের আশুলিয়ায়। যখন সরকারের ও গোয়েন্দা সংস্থার চাপে ছয় জন প্রথম সারির সমন্বয়ক আন্দোলন প্রত্যাখ্যান করে বিবৃতি পাঠ করেন তখন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এক রকম মুখ থুবড়ে পড়ে। এই দুঃসময়ে এসে আন্দোলনের হাল ধরেন চারজন সমন্বয়ক। তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন রিফাত রশিদ, যিনি কিনা এর আগে থেকেই আন্দোলনকে গতিশীল ও বেগবান করার জন্য বিভিন্ন কৌশলগত কাজ করেছেন।
কোটা আন্দোলন থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং সেখান থেকে সরকার পতন এই পুরো বিষয়টির সাথেই তিনি অনেকটা প্রত্যক্ষভাবে শুরু থেকে জড়িত ছিলেন।
এর জন্য ১৭ই জুলাই এর পর থেকে তাকে পালিয়েও বেড়াতে হয়েছে। পরিবারের বিষয়গুলোকে এক সাইডে রেখে আন্দোলনকে তিনি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। এর জন্য একাধিক বার আহত হয়েছেন। আন্দোলনের একজন সমন্বয়কারী হিসেবে তিনি দেশব্যাপী নেটওয়ার্ক তৈরির কাজও করেছেন একই সাথে। প্রকৃত অর্থেই তিনি একজন সমন্বয়ক।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের এক বছর পূর্তিতে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাথে এক সাক্ষাৎকারে তিনি তার আন্দোলনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন।
বাসস : রাজনীতিতে আপনার যাত্রা কখন থেকে?
রিফাত রশীদ : ক্যাম্পাসে দীর্ঘদিন যাবত আমরা বিভিন্নভাবে এক্টিভিজম করেছি। যদি ছাত্র সংগঠন বা এক্টিভিজমের সাথে জড়িত হওয়ার কথা বলি, সেটা শুরু হয়েছে ২০১৮ কোটা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। তখন সাভারে থাকতাম। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতাম এবং সেখানে এক্টিভিজম করতাম। ওই আন্দোলনের মধ্য দিয়েই আমার রাজনৈতিক যাত্রার শুরু। এরপর ২০২০ ২১ সেশনে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই এবং ক্লাস শুরু হওয়ার আগেই রাজনীতির সাথে যুক্ত হয়ে যাই। আমাদের একজন বন্ধু ছিল জার্নালিজম ডিপার্টমেন্টের। ওকে ছাত্রলীগ টর্চার করে এবং জলন্ত বাল্বের দিকে তাকিয়ে থাকতে বলেছিল। আমি তখনো চিনতাম না, ওর নাম জানি না, কারণ আমি তখনও ক্লাসে আসা শুরু করিনি। শুধু জানতাম সে একাত্তর হলের আমাদের সেশনের একজন ছাত্র। এই অত্যাচার নিয়ে একটি প্রোগ্রাম করেছিলাম। ক্যাম্পাসে আমার রাজনীতি মূলত এখানেই শুরু।
এরপর হলে উঠে দুদিনের বেশি টিকতে পারিনি, কারণ আমাকে হল থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল। পরবর্তীতে ওখান থেকে সরে গিয়ে হাজী মোহাম্মদ মহসিন হলে যাই।
থাকার চেষ্টা করি, সেখানেও থাকতে পারিনি ছাত্রলীগের যন্ত্রনার কারণে। সবচেয়ে বড় কথা ছিল আত্মসম্মান। তারা পরিবারসহ আত্মীয় স্বজনদের নিয়ে গালিগালাজ করতো যা আমার পক্ষে মেনে নেয়া সম্ভব ছিল না। এছাড়াও রাজনৈতিক দরবার ভাইদেরকে প্রটোকল দেওয়াও ছিল আমার নিজের জন্য চরম অসম্মানের। এসব বিষয় মানতে না পেরে আমি হল ছেড়ে বাইরে থাকার সিদ্ধান্ত নিই।
এরপর থেকে আস্তে আস্তে একটা পলিটিকাল সার্কেল যুক্ত হই। ওসময় বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদকে ক্যাম্পাসে ভাইব্রেন্ট এক্টিভিজমের সাথে জড়িত মনে হয়েছিল আমার। এছাড়া আমি নিজেও কোটা আন্দোলন করেছি এবং এই গ্রুপটার সাথে আগে থেকেই কানেক্টেড ছিলাম। রাজনৈতিক দলের সাথে আমার এভাবেই যুক্ত হওয়া। এবং ক্যাম্পাসে অন্যায়ের বিরুদ্ধেও বিভিন্ন প্রোগ্রাম করেছি। হামলার শিকার হয়েছি। এভাবেই চলত।
এরপর একটা সময় থেকে নাহিদ ভাইকে সামনে রেখে ছাত্র-শক্তি নামে একটি ক্যাম্পাস ভিত্তিক সংগঠন শুরু হয়। সেই সংগঠনের সাথে আমি যুক্ত ছিলাম।
বাসস : আপনি কীভাবে ২৪ এর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাথে যুক্ত হলেন?
রিফাত রশীদ : জুনের ৫ তারিখ যখন সরকারি চাকরিতে কোটা পুনর্বহাল করা হয় তখন ক্যাম্পাসের ছাত্ররা এটি নিয়ে বেশ সরব ছিল। আমরা যেহেতু এর আগে কোটা আন্দোলন করেছি আমাদেরও একটি বড় কনসার্নের জায়গা ছিল এই কোটা ফিরে আসা। সেদিন বিকেলে আখতার ভাই অনলাইনে একটি মিটিং ডাকেন। মিটিং চলাকালীন কোন সিদ্ধান্ত হওয়ার আগেই বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি গ্রুপে সন্ধ্যা সাতটায় মিছিল হবে বলে আমি একটি পোস্ট দেই। পরে মিটিংয়ে আমি বিষয়টি জানালে ভাইয়েরাও সেটিতে সায় দেয়। আমি পোস্টটি আগে আগে দিয়েছিলাম এই কারণে যে এই আন্দোলন ইতিপূর্বে বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী ও রাজনৈতিক দলের পৃষ্ঠপোষকতায় গ্রহণযোগ্যতা ও গভীরতা হারিয়েছিল। আমি ভয় পাচ্ছিলাম যে এভাবে এমন কিছু হবে যদি এই আন্দোলন কোন রাজনৈতিক দলের হাতে চলে যায়। তাই আমি আগে আগেই মিছিলের বিষয়টি ফেসবুকে জানান দেই।
সেদিনের মিটিং আরো বেশ কিছু সিদ্ধান্ত হয়। আমি যেহেতু ফেসবুক এবং ইন্টারনেটের বিষয়গুলো একটু ভালো বুঝতাম তাই আমাকে বিভিন্ন ক্যাম্পাসের সাথে নেটওয়ার্ক তৈরীর দায়িত্বটি দেওয়া হয়। সেদিন রাতেই আমি ফেসবুক গ্রুপ খুলি এবং অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচিত বন্ধুবান্ধব ও সিনিয়রদের মাধ্যমে ক্যাম্পাসের সাথে নেটওয়ার্ক তৈরি করি। এ সময় আমি ফেসবুকের চাকরি প্রত্যাশীদের গ্রুপগুলোর এডমিনদের রিচ করার চেষ্টা করি এবং তাদেরকে আমাদের গ্রুপের মডারেটর হিসেবে অফার করি।
তাদের অনেকে বিষয়টি ইতিবাচকভাবে নিয়েছিল। ফলে সেদিনই আমাদের গ্রুপটির মেম্বার দাঁড়ায় প্রায় ২০,০০০ এর কাছাকাছি। একই সময়ের মধ্যে তৈরি হওয়া অন্যান্য গ্রুপগুলোর মেম্বার সংখ্যা কখনো ৫০০ ছাড়ায়নি। এই কৌশলটি বেশ কাজে দিয়েছিল। এভাবে করে আমার প্রোগ্রাম দিচ্ছিলাম এবং সাড়াও পাচ্ছিলাম। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে আমাদের অনেক শক্ত নেটওয়ার্ক তৈরি হয়।
তখন চানখারপুলে আমাদের একটা বাসা ছিল। ওটার নাম ছিল স্বপ্ন। সেই বিল্ডিং এর ৬০১ নম্বর রুমে আমরা থাকতাম। আমাদের সিনিয়র ভাইদের ওখানে যাওয়া আসা ছিল। আন্দোলন জমে উঠতে না উঠতেই ঈদ চলে আসে। বিষয়টি নিয়ে আমরা একটু ভয়ে ছিলাম। কারণ আন্দোলনের বিষয়গুলো মোমেন্টামের সাথে জড়িত। মোমেন্টাম হারিয়ে গেলে আন্দোলন করে কোন কাজ হয় না। এর মধ্যে আমরা জুনের ৩০ তারিখ পর্যন্ত আল্টিমেটাম দিয়ে দিয়েছিলাম যে এর মধ্যে কোটা সংস্কার করতে হবে।
ঈদের সময় বলতে গেলে আমাদের অধিকাংশ বাড়িতে যায়নি। ঢাকায় থেকে আমরা কোঅর্ডিনেশন এর কাজগুলো করতাম। যারা বাড়িতে গিয়েছিল তারা ঈদের দুই-একদিনের মধ্যে আবার ঢাকায় ফিরে আসে। ততদিনে আমাদের নেটওয়ার্ক অনেক শক্ত হয়। ঈদের বন্ধে আমরা ইন্টারনেটে আন্দোলন সংক্রান্ত বিভিন্ন ক্যাম্পেইন করেছি। এরমধ্যে আমরা বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন যারা কিনা ক্যাম্পাসে আগে থেকে ফ্যাসিস্ট বিরোধী আন্দোলনের সাথে জড়িত ছিল তাদের সাথে যোগাযোগ করি।
বাসস : ক্যাম্পাস খোলার পর আপনারা কীভাবে ছাত্রদের সাথে সমন্বয় করেছিলেন?
রিফাত রশীদ : আমরা এর আগে ৩০ তারিখ পর্যন্ত আলটিমেটাম দিয়েছিলাম। কিন্তু এর মধ্যে সরকার কোন কিছুই করেনি। এ সময়ে শিক্ষকদের পেনশন স্কিম নিয়ে একটা আন্দোলন চলছিল। সকল ধরনের ক্লাস পরীক্ষা বন্ধ ছিল। ফলে ছাত্ররা আন্দোলনে আসতে পারে কোন ধরনের বাধা ছাড়াই। যারা কিনা আগে ক্লাস পরীক্ষার জন্য আন্দোলনে আসতো না তারা আন্দোলনে আসতে শুরু করল। ওই সময় শিক্ষকদের এই আন্দোলন আমাদের জন্য অনেকটা আশীর্বাদের মত ছিল।
একটা কথা বলে রাখি ওই সময় যে চার দফা দেওয়া হয়েছিল সেটা আমার হাতের লেখা। আমি খসড়া লিখে অন্যদের দিয়েছিলাম। সেখানে একটি দাবি ছিল যে কোটা ৫% করে রাখতে হবে। মূলত আমরা ৫% চাইনি আমরা বার্গেনিং পয়েন্টে রাখতে চেয়েছিলাম। ১০% হলেই আমরা মেনে নিতাম। কিন্তু তখনও আমারা কোন ইতিবাচক সাড়া পাইনি সরকারের পক্ষ থেকে। সময়ের সাথে সাথে ছাত্ররা ক্ষোভে ফুসতেছিল।
অন্যান্য ছাত্র সংগঠনগুলো আমাদের সাথে যোগাযোগ করত আমরা তাদের সাথে যোগাযোগ করতাম। বাম দলগুলো আমাদের সাথে সংহতি প্রকাশ করার ফলে আমরা দেখতে পাই শাহবাগ এলাকায় অনেক গ্রাফিতি দিয়ে ভরে গিয়েছিল। ততদিনে কোটা আন্দোলন বলতে গেলে দেশের প্রতিটি ক্যাম্পাসে ছড়িয়ে পড়ে।
আমরা আন্দোলনগুলোকে এনগেজিং করতে চাচ্ছিলাম। যাতে আন্দোলনকারীরা বিরক্ত হয়ে না যায়। আমরা শাহবাগের প্রোগ্রামগুলোতে বিভিন্ন ধরনের গান, রম্য গান, কবিতা, সুন্দর সুন্দর স্লোগান ইত্যাদি দিয়ে ছাত্রদেরকে ধরে রাখার চেষ্টা করতাম। সে সময়ের ছবি বা ফুটেজ দেখলে আপনি দেখতে পাবেন কেউ ওখানে বসে ক্রিকেট খেলছে, কেউ ফুটবল নিয়ে গিয়েছে, কেউ আবার কার্ড খেলছে, কেউ রাস্তায় বসে আড্ডা দিচ্ছে। আমারা আন্দোলনগুলোকে অংশগ্রহণমূলক করতে পেরেছিলাম।
অনেক প্রেমিক-প্রেমিকাও একসাথে এসেছে আন্দোলনে। সে সময় একটা স্লোগান খুব জনপ্রিয় হয়েছিল, ‘লাখো শহীদের রক্তে কেনা দেশটা কারো বাপের না।’ এই স্লোগানটি মূলত আমার মাথা থেকে এসেছিল।
আন্দোলনকে আরো বেশি স্বতঃস্ফূর্ত ও অংশগ্রহণমূলক করার জন্য আমরা গতানুগতিক নামগুলোর বাইরে গিয়ে আরো ক্রিয়েটিভ ভাবে চিন্তা করতে থাকি। বাংলা ব্লকেড ছিল এমনই একটি প্রোগ্রাম। এটি দেশব্যাপী সারা ফেলে দেয়। আরেকটা প্রোগ্রাম ছিল কমপ্লিট শাটডাউন।
বাংলা ব্লকেড চলাকালীন আমাদেরকে বিভিন্নভাবে বিভিন্ন লোভ দেখানো হয়, বিভিন্ন কিছু অফার করা হয় গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে সরাসরি এবং পরোক্ষভাবেও। কিন্তু আমরা সেগুলোকে সরাসরি না করে দেই।
আন্দোলন দমানোর জন্য কিছু শিক্ষার্থীদেরকে দিয়ে আদালতে রিটও করানো হয়। কিন্তু এগুলো তেমন কোন কাজে আসেনি।
বাসস : জুলাইয়ের ১৪ তারিখে শেখ হাসিনা এক প্রেস কনফারেন্সে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদেরকে রাজাকারের নাতিপুতি বলে সম্বোধন করে। সে সময় আপনারা বিষয়টিতে কীভাবে রিয়েক্ট করেছিলেন?
রিফাত রশীদ : যেদিন শেখ হাসিনা আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদেরকে রাজাকারের নাতিপুতি বলে সম্মোধন করে, সেদিন আসলে অনেকগুলো ঘটনা ঘটেছিল। সেদিন আমাদের একটি পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচি ছিল রাষ্ট্রপতি বরাবর স্মারকলিপি জমা দেওয়া। আমরা মিছিল নিয়ে বঙ্গভবনের দিকে গিয়েছিলাম।
মিছিল শুরুর আগে আমরা ছাত্রলীগ কর্তৃক বিভিন্ন ভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছিলাম যদিও তা পরোক্ষভাবে। ক্যাম্পাসের বিভিন্ন পয়েন্টে ছাত্রলীগ প্রস্তুত ছিল আন্দোলনকারীদের উপর হামলা করার।
আমাদের কর্মসূচির বিপরীতে ছাত্রলীগও মধুর ক্যান্টিনে কর্মসূচি ডেকেছিল। সেদিন ছাত্ররা প্রথমে মধুর ক্যান্টিনে গেলেও যখন বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মিছিল শুরু হয়, তখন ছাত্রলীগের মিছিল ছেড়ে সাধারণ শিক্ষার্থীরা আমাদের মিছিলের শামিল হয় এবং দেখা যায় হঠাৎ করে অনেক শিক্ষার্থীর জমায়েত হয়ে গিয়েছে। মিছিল শুরুর আগে অনেকেই আমাদের সাথে যুক্ত হয়নি কিন্তু মিছিল শুরু হওয়ার পর রাস্তার দুপাশ থেকে এবং ছাত্রলীগের কর্মসূচি থেকে শিক্ষার্থীরা আমাদের সাথে যুক্ত হয় এবং আমাদের মিছিলিটি হঠাৎ ভারী হয়ে যায়।
এর মধ্যে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বড় একটি মিছিল আসে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মিছিলটি আসার পথে বিভিন্নভাবে পুলিশ এবং ছাত্রলীগের মাধ্যমে বাধাগ্রস্ত হয়। কিন্তু সব বাধা বিপত্তি পেরিয়েও তারা আমাদের সাথে যুক্ত হয়।
রাষ্ট্রপতির নিকট স্মারকলিপি জমা দেওয়ার পর আমরা ক্যাম্পাসে ফিরতে ফিরতে বিকেল হয়ে যায়। সেদিন বিকেল বা সন্ধ্যার দিকে শেখ হাসিনার একটি প্রেস কনফারেন্স ছিল। এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধার নাতি-পুতিরা সরকারি চাকরি পাবে না তো কি রাজাকারের নাতিপুতিরা চাকরি পাবে?’
যেহেতু আন্দোলনটা ছিল কোটা আন্দোলন আর আন্দোলনকারীদেরকে রাজাকারের নাতিপুতি বলে সম্বোধন করা ছিল তাদের জন্য চরম অসম্মানের। বিষয়টি কোন শিক্ষার্থী স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেনি।
সারাদিন মিছিল করার পর ক্লান্ত শরীরেও শিক্ষার্থীরা সেদিন রাতে শেখ হাসিনার বক্তব্যের প্রতিবাদে মিছিল বের করে। শিক্ষার্থীদেরকে রাজাকারের নাতিপুতি বলে সম্বোধন করেছিল তাই শিক্ষার্থীরা এটার প্রতিবাদে স্লোগান দেয়, ‘তুমি কে? আমি কে? রাজাকার, রাজাকার।’ পরে এর সাথে বিভিন্ন আনুষাঙ্গিক যুক্ত হতে থাকে যেমন ‘কে বলেছে? কে বলেছে? সরকার, সরকার। কে বলেছে? কে বলেছে? স্বৈরাচার স্বৈরাচার ইত্যাদি।’ মূলত এটি ছিল একটি প্রতিবাদ। রাজাকার শব্দটিকে আত্তীকরণ করা নয়।
মূলত সেই ঘটনাতেই ছাত্রলীগের সাথে সাধারণ শিক্ষার্থীর একটি দূরত্ব তৈরি হয়ে যায়। সেদিন হল ছেড়ে প্রতিটি শিক্ষার্থী বেরিয়ে আসে।
সেদিন মেয়েরা চরম সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিল, শেখ হাসিনার মন্তব্যের প্রতিবাদে তাদের হল থেকে সর্বপ্রথম মিছিল বের হয়। আমরা তখন চানখারপুল ছিলাম।
মিছিলের বিষয়টি জানতে পেরে আমরা দ্রুত ক্যাম্পাসে চলে আসি। আমরা মিছিল নিয়ে হল পাড়ায় গেলে ৭১ হলের সামনে আসিফ মাহমুদ ভাইকে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা পিটিয়ে আহত করে। অন্যান্য হলেও সাধারণ শিক্ষার্থীদেরকে ছাত্রলীগ হল থেকে বের হতে দিচ্ছিল না। বিশেষ করে জুনিয়র শিক্ষার্থীদেরকে। এর মধ্যে অন্যতম ছিল বিজয় ৭১ হল, সূর্যসেন হল, মহসিন হল, স্যার এফ রহমান হল ও সার্জেন্ট জহুরুল হক হল।
হাজী মুহাম্মদ মহসিন হলের সামনে দিয়ে মিছিল নিয়ে আমি যখন সার্জেন জহুরুল হক হলে পৌঁছাই তখন জুনিয়রদেরকে গেস্ট রুমে আটকে রাখা হয়েছিল। যাতে তারা মিছিল আসতে না পারে। আমি গিয়ে গেস্ট রুমের দরজায় লাথি দিয়ে দরজা খুলে ফেলি।
দরজা খোলার সাথে সাথে একজন জুনিয়র এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দেয়। বিষয়টি আমি সহ্য করতে না পেরে আমার সামনে ছাত্রলীগের যে ছিল তাকে বেধড়ক মারতে থাকি। খুব সম্ভবত আমিই প্রথম ছাত্রলীগের সাথে সরাসরি আক্রমনে যাই। সারাদিন ক্লান্ত থাকার কারণে তাকে মারতে মারতে আমি নিজেই অজ্ঞান হয়ে পড়ি।
পরে আন্দোলনকারীরা আমাকে ওখান থেকে নিয়ে আসে এবং ছাত্ররাও হল থেকে বেরিয়ে আসে। আমার মুখে পানির ছিটা দিলে আমার হুশ ফিরে আসে কিছুক্ষণ পর।
মিছিল নিয়ে আসতে আসতেই ভিসি চত্বর থেকে মসজিদের গেট পর্যন্ত বিশাল সমাবেশ হয়ে যায়। একই সময়ে ছাত্রলীগের নেতা কর্মীরা অবস্থান নেয় মধুর ক্যান্টিনের সামনে। বিভিন্ন বহিরাগত ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা শাহবাগের দিকে অবস্থান করছিল। মেইন রাস্তা থেকে সেন্ট্রাল মসজিদের ঢোকার রাস্তায় আমাদের সাথে ছাত্রলীগের কিছুটা ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়েছিল তখন।
আমরা চেয়েছিলাম সেদিন সারারাত বাহিরে অবস্থান করতে কিন্তু কয়েকজন নারীদের নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তোলায় আমরা সেদিন রাতে যার যার অবস্থানে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। ছাত্রদের হলে ফিরে যেতে প্রায় রাত তিনটা বেজে যায়।
পরদিন দুপুরে রাজু ভাস্কর্যে আমাদের একটি কর্মসূচি ছিল। আমাদের কর্মসূচির বিপরীতে ছাত্রলীগ একই সময়ে একই স্থানে একটি কর্মসূচি ডাকে। আমাদের কর্মসূচির একটি গ্রুপ যখন হল পাড়ায় মিছিল নিয়ে যায় তখন হল পাড়ায় বিজয়া ৭১ হল থেকে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা আমাদের উপর বড় বড় ইটের টুকরা, জুতা এবং মদের বোতল নিক্ষেপ করতে থাকে। কয়েকজন তখন আহত হয়। বিষয়টি জানতে পেরে রাজু ভাস্কর্য থেকে সবাই হল পাড়ার দিকে চলে আসে।
আমি তখন কোন স্লোগান দিতে পারছিলাম না আমার গলা ভাঙ্গা ছিল। এরপরও আমার গলায় যতটুক শক্তি ছিল আমি ততটুকু দিয়ে চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম। ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার এক পর্যায়ে কিছু শিক্ষার্থী ৭১ হলে প্রবেশ করে এবং ভাঙচুর করে। উপর থেকে যেহেতু পাথর মারছিল। তাই হলে ঢোকার সুযোগ ছিল না। পাথর নিক্ষেপ একটু কমে আসলে আমি মাইক ছেড়ে দিয়ে একরকম রিক্স নিয়েই হল গেটের দিকে দৌঁড় দেই। একটি বড় পাথর এসে আমার উরুতে পড়ে। কিন্তু আমি তৎক্ষণাৎ কোনো ব্যথা অনুভব করিনি। সবাই তখন সামনের দিকে এগোচ্ছিল।
কেউ একজন তখন মাইক থেকে সবাইকে ফিরে যাওয়ার ঘোষণা দেয়। ঘোষণাকারী আমাদের কেউ ছিল না এটা পরে বুঝতে পেরেছিলাম। আমাদেরকে ছত্রভঙ্গ করে দেওয়ার জন্য এটি করা হয়েছিল।
এরই মধ্যে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা নীলক্ষেত এবং মুজিব হলের পেছন দিয়ে ঢুকতে থাকে। আমরা নিরস্ত্র ছিলাম যদিও কয়েকজনের হাতে লাঠি ছিল। কিন্তু ছাত্রলীগের প্রত্যেকের হাতে অস্ত্র ছিল। কারো কারো হাতের রামদা পর্যন্ত ছিল।
আমাদের ধারণা ছিল যে আমাদেকে আক্রমণ করা হবে। কিন্তু ছাত্রলীগ এত বৃহৎ আকারে নৃশংসভাবে আমাদের উপর হামলা করবে এটা আমরা কখনোই ভাবি নাই। সেদিন আন্দোলনকারী নারীদেরকে দেখে দেখে মারা হয়। তাদেরকে ইচ্ছাকৃতভাবে মাথা ও মুখে আঘাত করা হয়।
আমাকেও বেশ মারধর করা হয় এবং মাথা লক্ষ্য করা মারা হয়। পরে চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজে গেলে আমাকে সিটি স্ক্যান দেওয়া হয়। কিন্তু আমার মনে হয় কোন কিছুই হয়নি, আমার চিকিৎসার প্রয়োজন নেই এর চেয়ে অনেক গুরুতর আহত আন্দোলনকারী ভাইয়েরা ও বোনেরা সেখানে ছিল। কারো কারো মাথায় ১৪-১৫ টি করে সেলাই। শরীর সম্পূর্ণ রক্তাক্ত। এসব দেখে চিকিৎসা নিতে গিয়ে আমি নিজেই ভলান্টারি শুরু করি।
এর মধ্যে আবার ছাত্রলীগের একটি দল মেডিকেলে এসে আমাদের কয়েকজনকে নাম ধরে খুঁজতে থাকে। বিষয়টি জানতে পেরে কয়েকজন যারা আমাকে চেনে তারা আমাকে জোর করে ধরে উপরে নিয়ে যায়। ঢাকা মেডিকেল কলেজের একজন শিক্ষার্থী ও আমাকে চিনে ফেলে। সে আমাকে একাডেমিক বিল্ডিং এর তৃতীয় তলায় একটি রিডিং রুমে নিয়ে আমাকে বসিয়ে দেয় এবং বলে ওখানে অবস্থান করতে।
সেখানে গিয়ে আমি দেখতে পাই সবাই পড়ছে। আমার মনে হচ্ছিল আমি তাদের বিরক্ত করছি। এটি ভেবে আমার নিজেরই বিব্রত বোধ হয়। নিজেকে খুব স্বার্থপর মনে হচ্ছিল যে নিজের সহযোদ্ধাদের রেখে আমি উপরে এসে আশ্রয় নিয়েছি। ওখানে আমার মন টিকছিল না। কিছুক্ষণ ওখানে থাকার পর আমি নিচে সিটি স্ক্যান রুমে নেমে আসি। সেদিন চিকিৎসা শেষে আমরা সবাই হলে ফিরি।
এরপর ১৬ জুলাইয়ে আমাদের কর্মসূচি ছিল শহীদ মিনারে। আমরা সেখানে অবস্থান গ্রহণ করি। আর ছাত্রলীগ ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে রাজু ভাস্কর্যে। সাইন্সের হলগুলোর দিকে তখনও সংঘর্ষ চলছিল। আমাদের সাথেও ছাত্রলীগের ধাওয়া পালটা ধাওয়া হচ্ছিল। চানখারপুলের দিক থেকে কিছু গুলিও চালানো হয়েছিল আমাদের দিকে। গুলি লেগে কয়েকজনও আহতও হয়েছিল। আমরা সেদিন সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলাম না যে আসলে কী করব?
কী করব এই প্রশ্নে আমাদের মাঝে ফাটল দেখা দিয়েছিল সেদিন। আমাদের একটি গ্রুপ রাজু ভস্কর্যের দিকে এসে ছাত্রলীগের সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে আগের দিনের প্রতিশোধ নিতে চাচ্ছিল। আরেকটি গ্রুপ চাচ্ছিল সংঘর্ষে না জড়াতে। সেই গ্রুপটি মিছিল নিয়ে দোয়েল চত্বরের দিকে চলে যায়। আমি চাচ্ছিলাম সেদিন ছাত্রলীগের সামনাসামনি হতে। তবে সিনিয়রদের কারনে সেদিন আর সামনাসামনি কোনো বড় ধরণের সংঘর্ষ হয়নি।
তবে অনেক স্টুডেন্টের ভয় ছিল যে আজকে যদি আমরা ডিল না করে যাই, তাহলে আমরা হলে ফিরে গেলে তো আমাদেরকে মেরে ফেলবে কারন তারা ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে গিয়েছে। আমরা সিদ্ধন্ত নিয়েছিলাম যে হলে গিয়ে আগে হল দখল নিতে হবে। হলে পজিশনিং করতে হবে। কারণ অ্যাটাক ইজ দা বেস্ট ডিফেন্স। সন্ধ্যার দিকে সবাই যার যার মতো হলে ফেরে।
সেদিন হলে ফেরার সাথে সাথে মুহসীন হলের ছাত্ররা স্লোগান দিয়ে হল থেকে ছাত্রলীগ মুক্ত করে। সেখানে কোনো ধরণের সংঘাত হয়নি। এর আগেই যেহেতু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগকে হল ছাড়া করা হয়েছে। বিষয়টি একটি দৃষ্টান্তের মত ছিল।
পরে রাতের দিকে সর্বপ্রথম রোকেয়া হলের ছাত্রীরা ছাত্রলীগের নেত্রী আতিকাসহ অন্যদেরেকে হলছাড়া করে হলকে রাজনীতিমুক্ত ঘোষণা করে। এই বিষয়টি ছড়িয়ে পড়লে একে একে সকাল নাগাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেকটা হল থেকেই ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের হলছাড়া করা হয়।
১৬ তারিখের আরেকটি বিষয় হল যখন আমি আবু-সাঈদের মৃত্যুর সংবাদ শুনি, আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারছিলাম না। এর আগের দিন সন্ধার দিকে উনার সাথে আমার ফোনে কথা হয়েছিল। উনি আমার সাথে পরামর্শ করেছিলেন কী করতে হবে এই বিষয়ে। আমি তাড়াহুড়ার মধ্যে থাকায় অল্প-কথা বলেই কল রেখে দেই। পরে যখন শুনতে পাই উনি শহীদ হয়েছে। তখন নিজেকে অপরাধী আর ছোটো মনে হচ্ছিল।
বাসস : ১৭ জুলাই তারিখের কী কী ঘটনা আপনি প্রত্যক্ষ করেছেন?
রিফাত রশীদ : দুপুর ১১ টা নগাদ ক্যাম্পাস ছাত্রলীগমুক্ত হয়ে যায়। এর কিছুক্ষণ পরেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন অনির্দিষ্ট কালের জন্য ক্যাম্পাস বন্ধ ঘোষণা করে। ছাত্ররা যদিও সেটা মেনে নেয় না। সেদিন আবার আমাদের পূর্বঘোষিত গায়েবানা জানাজার কর্মসূচী ছিল। কিন্ত সেই গায়েবানা জানাজার কর্মসূচী বাস্তবায়ন ছিল অনেক কঠিন। এর আগের দিন রাতের বেলা থেকেই পুরা ক্যাম্পাস আইনশৃংখলা বাহিনী ঘিরে ফেলে। আমরা কোনোভাবেই কফিনের ব্যাবস্থা করতে পারছিলাম না। পরে শিবিরেরে সাথে যোগাযোগ করা হলে তৎকালীন ছাত্র-আন্দোলন বিষয়ক সম্পাদক জায়েদ ভাই কফিনের ব্যাবস্থা করে। তিনি আমাদেরকে ফোন দিয়ে জানান, যে ক্যাম্পাসে কফিনগুলো ঢুকানো যাচ্ছে না। পরে আমি ছাত্রদলের কয়েকজন ভাইকে নিয়ে যাই কফিন আনার জন্য। প্রথমে পুলিশ আমাদেরকে কফিন আনতে দিচ্ছিল না। পরে একপর্যায়ে আমরা জোর করে কফিন নিয়ে আসি।
গায়েবানা জানাজা পড়ানোর কথা ছিল আখতার ভাইয়ের। তিনি এর আগে আন্দোলনে সামনে আসেননি এটা ভেবে যে যদি উনি সামনে আসেন তাহলে আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করা হতে পারে। কারণ উনার রাজনৈতিক পরিচয় ছিল। সেদিনের জানাজার মাধ্যমে আন্দোলনে তার সরাসরি সম্পৃক্ত হওয়ার কথা ছিল। কিন্ত আমরা কফিন নিয়ে এসে শুনতে পাই যে আখতার ভাইকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
সেদিন আমাদের কর্মসূচীতে মানুষ পাচ্ছিলাম না। হলের ছাত্ররা হল ছেড়ে আসতে চাচ্ছিল না, হল বেদখল হয়ে যাওয়ার ভয়ে। এমন সময় বুয়েট থেকে একটি বড় মিছিল এসে আমাদের সাথে যুক্ত হয়। এটা ছিল আমাদের জন্য লাইফ সেভিং। পরে গায়েবানা জানাজা হয়।
জানাজার পরে কফিন নিয়ে রাজু ভাস্কর্যের দিকে মিছিল করতে গেলে পুলিশ আমদেরকে দুইদিক থেকে আক্রমন করে। আমরা পিছু হটে মলচত্বর হয়ে হলপাড়ার দিকে ঢুকে যাই। পুলিশ হল পাড়ায় ঢুকে আমাদের ওপর গুলি চালায়, সাউন্ড গ্রেনেড ও টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করে। আমি তখন জসিম উদ্দিন হলের দিকে ছিলাম। হান্নান মাসুদ ভাই গুলিবিদ্ধ হন। আরিফ আদিব ভাই তখন সাংবাদিকতা করতেন। তিনি কোনোভাবে জানতে পেরেছিলেন যে, পুলিশ আমাদেরকে গ্রেপ্তার করার জন্য খুঁজছে। তিনি আমাকে ওখান থেকে সাংবাদিকদের ভিড়ের আড়াল করে বের করে আনেন।
ক্যাম্পাস থেকে বের হওয়া তখন মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার মত ছিল, কারণ ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা ক্যাম্পাসের প্রবেশ মুখগুলোতে অস্ত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র পেলেই তাদেরকে মারধর করতেছিল। আমি এক বন্ধুর সহযোগিতায় মুহসীন হলে যাই। তখন হলে বলতে গেলে কেউ-ই ছিল না। কিছু প্রতিবন্ধী ছাত্র ও তাবলীগের কিছু মানুষ ছিল। তারা আমাকে চিনতে পেরে জিজ্ঞাসা করে যে আমি এখানে কী করছি। পরে আমি তাদের বিস্তারিত জানালে তারা আমাকে একটি জুব্বা ও টুপি দেয়। আমি সেগুলো পরে প্রতিবন্ধী ছাত্রদের সাথে রিক্সায় করে বের হয়ে যাই। আমি ধানমন্ডি ভুতের গলিতে যেতে চাচ্ছিলাম এক ভাইয়ের বাসায়। রিক্সা কাঁটাবন মোড়ে পৌঁছলে আমি একাত্তর হলের ছাত্রলীগের আবু-ইউনুসকে দেখতে পাই। সে-ও আমাকে দেখে ডাক দিয়ে ধাওয়া করে। আমি রিক্সা থেকে নেমে একটা গলি ধরে সোজা দৌঁড়াতে থাকি। কাঁটাবনে একটি প্রকাশনীতে আমি কিছুদিন কাজ করেছিলাম। সেখানে গিয়ে আমি উঠি।
বাসস : ১৭ তারিখের পর থেকে আপনারা কীভাবে সময়গুলো অতিবাহিত করছিলেন। যোগাযোগ রক্ষা করেছিলেন?
রিফাত রশীদ : ১৭ তারিখ রাতের বেলা ওখান থেকে একটা সিএনজি নিয়ে ধানমন্ডি গন্তব্যে রওনা করি। আমার মোবাইল অফ ছিল। সেখানে গিয়ে আমি তারেক রেজা ভাইয়ের বড় ভাই সালাউদ্দিন ভাইয়ের বাসায় গিয়ে ঊঠি। আমার তখন ছররা বুলেট বিদ্ধ অবস্থায় ছিল। উনি আমাকে একটা লোকাল ফার্মেসিতে নিয়ে গেলে সেই বুলেট বের করার ব্যাবস্থা করেন। সেদিন রাতে আমি উনার বাসাতেই ছিলাম। এবং রাতটা আমি বলতে গেলে ১২ ঘন্টার মত আমি আন্দোলনের বাহিরে ছিলাম।
পরদিন খুব ভোরে আমি আকরাম ভাইয়ের সাথে দেখা করার জন্য উনার অফিসে রওনা হই। পথে জিগাতলার ওখানে আমি একটু আমার মোবাইল ওপেন করি। এর পাঁচ মিনিটের মধ্যেই দেখতে পাই আমার সামনে একটি কালো মাইক্রো গাড়ী আমাকে ফলো করছে। আমি বুঝতে পারি এটা গোয়েন্দা সংস্থার কাজ, আমাকে তুলে নেয়ার জন্য ব্যবস্থা। আমি সাথে সাথে মোবাইলে খুলে সিম ভেঙে দৌঁড় দিয়ে একটা বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়াই এবং দারোয়ানকে দরজা খুলতে বলি। উনি দরজা খুলছিলেন না। পরে আমি বুদ্ধি খাটিয়ে বলি যে আমি বাড়িওয়ালার আত্মীয়। উনার কাছে এসেছি। এটি বললে উনি দরজা খুলে দেয়। সেখানে কিছুক্ষণ ছিলাম আমি। এরপর আমি আকরাম ভাইয়ের অফিসে যাই। উনি আমাকে উনার একটা সিম দেন এবং সালাউদ্দিন ভাই আমাকে একটা বাটন মোবাইল কিনে দেন। আমি ওটা দিয়ে যোগাযোগ করতাম।
আকরাম ভাইয়ের অফিসে মোহাইমিন পাটোয়ারী ভাই ছিল। ১৮ তারিখ রাতের বেলা আমি উনার বাসায় ছিলাম, আমি ভাবতেছিলাম যে আমার জন্য সেইফ জায়গা কোনটা হবে। তখন আমার এক সাংবাদিক আপুর কথা মাথায় আসে। ১৯ তারিখ সকালবেলা আমি মোহাইমিন ভাইকে না বলেই ওই আপুর বাসায় চলে যাই। আপুর বাসায় আমি দুই-তিনদিন ছিলাম।
আপু যেহেতু সাংবাদিক ছিলেন, উনি অনেক কিছুই জানতেন। তখন আবার ইন্টারনেট শাটডাউন চলছিল। কী হচ্ছে না হচ্ছে তার অনেক কিছুই জানা সম্ভব ছিল না তখন।
আপুর বাসায় গেলে আপু আমাকে জানায় যে আব্বু মর্গে মর্গে গিয়ে আমার লাশ খুঁজতেছে। আম্মু অসুস্থ। তাকে আইসিইউতে ভর্তি করে রাখা হইছে। আমি জানতাম এমন হবে, আমাকে খুঁজে বের করার জন্য। আসলে আম্মুও অসুস্থ ছিল। আমি তখন বাড়িতে যাইনি তবুও। সরাসরি যোগাযোগও করিনি। আমি জানতাম আমার পরিবারের নাম্বারও ট্র্যাক করা হবে। তাই আমি আমার খালাতো বোনকে নতুন নাম্বার থেকে ফোন করে জানাই যে আমি নিরাপদ আছি। সে বাসায় গিয়ে আমার খোঁজ দেয় আর আমার নাম্বারটাও দিয়ে দেয়। এই নাম্বার দিয়ে বাসা থেকে আমাকে কল দেয়ার সাথে সাথে আমি বুঝতে পারি যে অবস্থান গোয়েন্দা সংস্থার কাছে চলে যাবে। আমি দ্রুত ওই জায়গাও ত্যাগ করি। পরে জানতে পেরেছিলাম যে ওই বাসাটি ছিল এক উর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তার। তিনি এসে আপুর কাছে আমার কথা জিজ্ঞাসা করেছিলেন এবং বলেছিলেন যে এখানে তার কিছুই করার নেই। উপর মহলের নির্দেশ এটি।
সেখান থেকে আমি সাভারে একটা বন্ধুর বাসায় যাই। কিন্ত গিয়ে দেখি তাদের বাসায় কেউ নেই। পরে আমি ওখান থেকে ফিরে আসি এবং হেমন্ত বাসের সাবেক সভাপতি রাকিব ভাইকে কল দেই। উনি আমাকে উনার বাসায় নিয়ে যান। সেদিন রাতে ইন্টারনেট আসে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে আসিফ ভাই, নাহিদ ভাই, বাকের ভাই সহ অন্যদের খবর পাই। সবার সাথে মিটিং করার সিদ্ধান্ত হয়। পরদিন আমরা গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে মিলিত হই।
আমরা গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে গিয়েছিলাম কারণ ওখানে নাহিদ ভাই ভর্তি ছিল। আমি ওখানে গিয়ে নাহিদ ভাইয়ের সাথে দেখা করি। এরপর আমাকে আসিফ ভাই বলে ওখান থেকে বের হয়ে যেতে। আমাদেরকে গ্রেফতার করার জন্য খোঁজা হচ্ছে, সবার একসাথে গ্রেফতার হওয়াটা ঠিক হবে না। কখন হাসপাতালের চারপাশে পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা ঘোরাফেরা করছিল। আমি ও আব্দুল হান্নান মাসুদ ভাই হাসপাতালের পেছন দিয়ে বের হয়ে যাই। বের হওয়ার সময় আমাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করার চেষ্টা করা হয় কিন্তু আমরা ওদিকে খুব একটা গুরুত্ব না দিয়ে রিকশা নিয়ে চলে আসি।
হাসপাতালের মিটিংয়ে একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে, আন্দোলনকে চালিয়ে নেওয়ার জন্য আমরা লিগ্যাল উইং করবো এবং হেলথ উইং করব। কেননা ততদিনে আন্দোলনের কারণে আহত, নিহত এবং গ্রেপ্তারের সংখ্যা অনেক বেড়ে গিয়েছিল।
এই প্ল্যান অনুযায়ী আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে, আমরা ঢাকা মেডিকেল কলেজে আহতদের দেখতে যাব এবং এরপর সেখানে প্রেস কনফারেন্স করব। কিন্তু সেদিন ঢাকা মেডিকেল কলেজে শেখ হাসিনা যাওয়ায় আমরা সেখানে যেতে পারিনি। পরে আমরা কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালের দিকে যাই। হাসপাতালে গিয়ে মনে হল এটি কোন হাসপাতালে একটি ভুতের বাড়ি। পরিছন্নতাকর্মীরা হাসপাতালের ফ্লোর থেকে রক্ত মুছছিল। হাসপাতালের বাহিরে শৃঙ্খলা বাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থার লোক ছিল। আর আমাদের সাথে তখন একজন সাংবাদিক ছিল।
অবস্থা একটু সমস্যাজনক মনে হলে আমরা সেখান থেকে সরে আমেরিকার এম্বাসির দিকে চলে যাই। একটা এম্বুলেন্সে করে গিয়েছিলাম, চালক বেশ দক্ষ ছিল। একবার রাস্তায় শৃঙ্খলা বাহিনীর মানুষজন আমাদের থামালে সেই সাংবাদিক ভাই গাড়ি থেকে বের হয়ে সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে আমাদেরকে নিয়ে যায়। তখন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী আর গাড়ি চেক করেনি।
এখান থেকে আমরা একজন মানবাধিকার কর্মীর রেফারেন্সে একজন কূটনীতিকের আশ্রয়ে উঠি। সেদিন রাতে আমরা ওখানে কোন ইন্টারনেট পাইনি। পরদিন সকালবেলা আমাদেরকে ইন্টারনেট এক্সেস দেয়া হয়। একজন বড় ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি আমাকে একটি ঠিকানা দেন এবং তার সাথে যোগাযোগ করতে বলেন।
আমাদেরকে যে ব্যক্তির ঠিকানা দেওয়া হয় তিনি একজন বড় মাপের ব্যবসায়ী। তিনি আমাদেরকে বনানীর একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের তৃতীয় তলায় থাকার ব্যবস্থা করেন। তখন স্কুল বন্ধ ছিল। ওখানে আমি, আব্দুল হান্নান মাসুদ ভাই, মাহিন সরকার ভাই ও আব্দুল গাফফার ভাই তখন একসাথে থাকতাম। আব্দুল গাফফার ভাই ছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র তিনি আমাদেরকে দেখভাল করতেন এবং রান্নাবান্না করে খাওয়াতেন ও বিভিন্ন বিষয়ে সমন্বয় করতেন।
এরই মধ্যে আমাদের আন্দোলনের নেতাদেরকে গ্রেফতার করা হয়। এবং ২৮- জুলাই ডিবি অফিস থেকে জোর করে আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণা দেওয়া হয় তাদেরকে দিয়ে।
বাসস : জুলাইয়ের ২৮ তারিখ যখন ডিবি অফিস থেকে সমন্বকরা আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয় তখন আপনারা কেন সেটির বিরোধিতা করেছিলেন? তারা তো আপনাদের-ই সিনিয়র ছিলেন এবং বিশ্বাসযোগ্য ছিলেন।
রিফাত রশীদ : বিষয়টি বিশ্বাসযোগ্যতার নয় বরং বিষয়টি হচ্ছে পরিস্থিতির। তাদেরকে ডিবি অফিসে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে এবং বিবৃতি পড়তে বাধ্য করা হয়েছে। একটু স্পষ্টভাবে বুঝা যাচ্ছিল। গ্রেফতার এর আগে আসিফ ভাই আমাদেরকে বলে গিয়েছিল যে বা যারা মাঠে থাকবে তারা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিবে। সেই হিসেবে আমরা তাদের ওই বিবৃতি মেনে নেইনি। আর যখন আমি দেখেছি তারা এমন বিবৃতি দিচ্ছে আমি সত্যিই খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। ভাবছিলাম এখন কি হবে। মানুষ কী আমাদের কথা শুনবে? এরপরে আমরা পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নেই যে, আমরা এর বিরোধিতা করবোই। সিদ্ধান্ত নিয়ে আমরা ডিবি অফিস থেকে পাঠ করা বিবৃতি প্রত্যাখ্যান করি এবং আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিই।
ওই সময়টা আমাদের জন্য আসলে খুবই কঠিন ছিল। আমাদের সিনিয়ররা একদিকে আর আমরা আরেকদিকে। পরিস্থিতির কারণে এমন অবস্থান নিতে আমরা বাধ্য হয়েছিলাম।
বাসস : এরপর আপনার আন্দোলন কীভাবে চালিয়ে গিয়েছেন?
রিফাত রশীদ : আন্দোলন শুধু যে আমরা চালিয়ে গিয়েছি বিষয়টা এমন নয়। ততদিনে আন্দোলন একটি গণআন্দোলনে পরিণত হয়েছে। সবকিছু বন্ধ, রাস্তায় মানুষজন তাদের সন্তান হত্যার বিচার চাইছে। ৩০ তারিখে আমরা একটি ঘোষণা দেই সবার ফেসবুক প্রোফাইল লাল করার। এটিতে আমরা ব্যাপক সাড়া পাই। শুধু আমাদের ব্যানারে না, বিভিন্ন ব্যানারে যখন প্রোগ্রাম হচ্ছিল। ডাক্তার, শিক্ষক, আইনজীবী ও সাংস্কৃতিক কর্মীরাও ততদিন আন্দোলনে নেমে পড়েছে।
সরকারের সাথে আমাদেরকে বেশ কয়েকবার আলোচনার টেবিলে বসার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। আমরা সেগুলো সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছি। আমি বলেছিলাম শহীদের রক্তের সাথে বেইমানি করে কোন আলোচনা হবে না। আলোচনা করতে হলে যারা মারা গিয়েছে তাদের জীবন ফিরিয়ে দিতে হবে।
এরমধ্যে নাহিদ ভাইদেরকে ছেড়ে দেওয়া হয়। উনারা শহীদ মিনারে কর্মসূচির ডাক দেন। সেদিন শহীদ মিনারে বিশাল জনসমাগম হয়, এটি আমাদের জন্য অনেক অনুপ্রেরণার ছিল। আমরা বুঝতে পারছিলাম যে আন্দোলন সঠিক পথে যাচ্ছে।
তবে ঘোষণার দিন আমি ওখানে ছিলাম না। কারণ গ্রেফতার হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। আমাকে আসিফ ভাই ওখানে আসতে নিষেধ করেছিলেন।
বাসস : লং মার্চ টু ঢাকা প্রোগ্রামটির বিষয়ে কিছু বলুন।
রিফাত রশীদ : লং মার্চ ঢাকা প্রোগ্রামটি মূলত মানুষের সেন্টিমেন্ট দেখেই দেওয়া হয়েছিল। আমরা এখানে একটি মনস্তাত্ত্বিক গেম খেলছিলাম। প্রথমে আমরা ৬ তারিখে ঘোষণা করি। এতে সরকার ভেবেছিল যে তার হাতে কিছুটা হলেও সময় আছে। কিন্তু সন্ধ্যার দিকে গিয়ে যখন আসিফ ভাই ঘোষণা দেয় যে, আগামীকালই মার্চ টু ঢাকা, তখন হাসিনা সরকারের হাতে কোনো সময়ই ছিল না। এমন মনস্বাত্ত্বিক বিষয়টি চিন্তা করেই আমরা প্রথমে ৬ তারিখে কর্মসূচি দিয়েছি। মূলত হাসিনাকে সারপ্রাইজ করার জন্যই আমরা এই বুদ্ধি করেছিলাম এবং ৫ তারিখে আমরা দেখতে পাই আমাদের কর্মসূচিতে অনেক মানুষের সমাগম হয়। এবং সেদিনই হাসিনা সরকারের পতন হয়।
বাসস : আন্দোলনের সময় আপনি আপনার পরিবারের সাথে কীভাবে যোগাযোগ রক্ষা করেছিলেন? তাদের উপর কি কোনো ধরনের চাপ এসেছিল?
রিফাত রশীদ : সত্যি কথা বলতে আন্দোলনের সময় আমি আমার পরিবারের সাথে তেমন একটা যোগাযোগ করিনি। আমি জানতাম আমাকে ঘায়েল করার জন্য সরকারের সবচাইতে সহজ এবং প্রথম টার্গেট হবে আমার পরিবার। তাদের মাধ্যমেই আমাকে ঘায়েল করা সম্ভব। সেজন্য আমি পরিবারের সাথে তেমন একটা যোগাযোগ করতাম না।
আব্বুর সাথে কথা হলে তিনি আমাকে অনেকবার বলেছিলেন যে, বাসায় যেতে আমাকে দেখতে চায়। কিন্তু আম্মু সাহসিকতার কারণে আমার বাসায় যেতে হয়নি।
আর ভাই ও ভাবিদেরকে আমি আগেই নিরাপদ কোন একটি জায়গায় চলে যেতে বলেছিলাম। এতে তাদের খুব একটা চাপে থাকতে হয়নি।
তবে যত যাই বলি- আমি যখন দেখেছিলাম আমার বাবা আমার লাশ বিভিন্ন হাসপাতালের মর্গে গিয়ে খুঁজছে। আমার মা অসুস্থ। তখন নিজেকে ধরে রাখা অনেক কষ্ট ছিল। এরপরও আমি ওসব বিষয়কে আন্দোলনের চেয়ে গুরুত্ব দেইনি।
বাসস : জুলাই আন্দোলনের একবছর হতে চলল। এখন পর্যন্ত জুলাই ঘোষণাপত্র দেওয়া হয়নি। বিষয়টি আপনি কীভাবে দেখছেন?
রিফাত রশীদ : জুলাই ঘোষণা পত্র দেওয়া হচ্ছে না শুধুমাত্র রাজনৈতিক দলগুলোর কারণে। কিন্তু আমার কথা হচ্ছে জুলাই ঘোষণাপত্র তো রাজনৈতিক দলগুলোর বিষয় নয় বরং ঘোষণাপত্র দেওয়া হবে কি দেওয়া হবে না এতে সিদ্ধান্ত নেয়ার সবচেয়ে বড় অংশীজন হল জুলাইয়ে শহীদ পরিবার এবং আহত যোদ্ধারা। তাদের সাথে আলোচনা না করে শুধুমাত্র রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনা করে জুলাই ঘোষণাপত্র না দেওয়া বা দেরি করাটা এই আন্দোলনের সাথে ও শহীদদের সাথে বেইমানি করার শামিল।
বাসস : এমন কোন ঘটনা আছে যে আপনি বিশেষ করে বলতে চান?
রিফাত রশীদ : তারিখটা আমি খুব মনে করতে পারছি না সেদিন আমি সাইন্স ল্যাবের আন্দোলনে ছিলাম। একটু পিছনের দিকেই ছিলাম। এরপর আমি একদম সামনে চলে আসি আন্দোলনের। এলিফ্যান্ট রোডের দিক থেকে পুলিশ গুলি করছিল। আমি সেদিন একটা ছেলেকে ধরে থাপ্পড় দেই। কারন সে বারবার সামনে চলে যাচ্ছিল। তার বয়স সর্বোচ্চ ১৬ /১৭ হবে।
সে আমাকে বলে যে পুলিশের কাছে আর বেশি বুলেট নাই অনেকক্ষণ ধরে গুলি করতেছে। আর অল্প কয়েকটা গুলি করলেই গুলি শেষ হয়ে যাবে। এরপর আমরা গিয়ে তাদেরকে ধরবো।
তার কথা শুনে আমি বেশ অবাক হই, কারণ সে পুলিশের গুলি নিজের গায়ে লাগিয়ে পুলিশের গুলি কমাতে চাচ্ছে। পৃথিবীর অবাক করা বিষয় ছিল। তখন আমার মনে হয়েছে মানুষ দেশের জন্য কি না করতে পারে!
তখন আমি মাস্ক পরা ছিলাম। এ অবস্থাতে একজন আমাকে চিনতে পারে। সে আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলে ভাই আপনি এখানে কি করতেছেন এখান থেকে এখনই চলে যান। এটি বলতে বলতেই তার বুকে এসে একটি গুলি লাগে, সে আমার বুকের সামনেই কাভার হয়ে ছিল। সে আমার সামনে না থাকলে গুলিটা আমার বুকেই লাগতো।
বিষয়টি আমি এখনো ভাবলে শিউরে উঠি। পরে ওখানকার ছাত্ররা ছেলেটিকে ধরাধরি করে হাসপাতালে নিয়ে যায় আমাকেও জোর করে ওখান থেকে নিয়ে আসে। আমি ছেলেটির এখন পর্যন্ত কোন খোঁজ পাইনি। তার নামও জানিনা। আমি বেশ কয়েকবার আশেপাশের হাসপাতাল গুলোতে এবং শহীদদের লিস্ট গুলোতে তাকে খুঁজেছি কিন্তু পাইনি। তার রক্তাক্ত চেহারা ও রক্তে ভেজা শার্ট আমার চোখে এখনো ভাসে। আমি তাকে যতটুকু চিনি সেটি হলো তার রক্তে ভেজে চেহারাটাই।
বাসস : আন্দোলনকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জন নিজেদের একক ভূমিকা বলা দাবি করে থাকে। বিষয়টি আপনি কীভাবে দেখেন?
রিফাত রশীদ : সত্যিকার অর্থে আন্দোলন সবার সাথে সমন্বয় করেই করা হয়েছিল। হাসিনা সরকারের পতন মূলত একটি যৌথ প্রয়াসের ফলাফল। এখানে প্রত্যেকের অবদান আছে প্রত্যেকের ত্যাগ আছে। তাই বলে অবদানগুলো কোন ব্যক্তি বা সংগঠনের একক নয়। প্রকৃত অর্থে যারা জীবন ও রক্ত দিয়ে এই সংগ্রামকে সফল করেছে তাদের অবদানটা এখানে সবচেয়ে বেশি।